ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

পরোক্ষ ধূমপান প্রত্যক্ষ ধূমপানের মতোই ক্ষতিকর

শানু মোস্তাফিজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪১, ২ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১৪:৪৫, ২ অক্টোবর ২০২০
পরোক্ষ ধূমপান প্রত্যক্ষ ধূমপানের মতোই ক্ষতিকর

অন্যের ধূমপানের ধোঁয়া পাশে থাকা অধূমপায়ীর নিঃশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে প্রবেশ করাকেই পরোক্ষ ধূমপান বলা হয়। এর ক্ষতিকর বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের ২৬ জুলাই প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায় ‘বিশ্বের ৭০ লাখ মানুষ সরাসরি তামাক সেবনে মারা যায়। এর মধ্যে ১০ লাখ ২০ হাজার মানুষ যারা ধূমপান করেন না, তারা পরোক্ষ ধূমপানের জন্য মারা যান। বিশ্বের শতকরা ৮০ ভাগ অর্থাৎ একশ কোটি ২০ লাখ ধূমপায়ী নিম্ন এবং মধ্য আয়ের দেশগুলোতে বাস করে।’

ওই একই রিপোর্টে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষেত্রে বলছে ‘বিশ্বের অর্ধেকের বেশি শিশু প্রতিদিন জনসম্মুখে ধূমপান থেকে দূষিত বাতাস নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করছে। পরোক্ষ ধূমপানের জন্য বিশ্বে প্রতি বছর ১০ লাখ ২০ হাজার প্রিম্যাচিউর শিশু মারা যায় এবং ৬৫ হাজার শিশু বিভিন্ন ধরনের অসুখে ভুগে মারা যায়।’ ওই একই রিপোর্টে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভয়াবহ এ বিষয়টি থেকে মানুষকে বাঁচাতে মানুষের অধিকারের প্রসঙ্গ এনেছে। তারা বলছে ‘প্রত্যেক মানুষের ধূমপানমুক্ত বাতাস গ্রহণের অধিকার রয়েছে। ধূমপানমুক্ত আইন যেমন অধূমপায়ীদের সুরক্ষিত করবে, তেমনি ধূমপায়ীদের ধূমপান ছাড়তে উৎসাহিত করবে।’

বাংলাদেশে ধূমপানকে নিরুৎসাহিত করার বিষয়ে অনেক ভালো আইন থাকা সত্ত্বেও মানুষ সচেতন হচ্ছে না। জনসম্মুখে এবং বিভিন্ন যানবাহনেও মাঝেমধ্যে ধূমপান করার দৃশ্য এখনো চোখে পড়ে বলে জানান বারডেম হাসপাতালের দন্তচিকিৎসক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী। তিনি ৩০ বছর ধরে ধূমপান ও মাদক নিয়ে আন্দোলন করছেন। তিনি বলেন, ‘সিগারেটে ৭ হাজার ৫৩৫টি রাসায়নিক দ্রব্য আছে। এর মধ্যে ২৫০টি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং ৭০টি দ্রব্য ক্যানসার হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যিনি সিগারেট খান, তার পাশে যিনি থাকেন, তিনিও সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এভাবে যারা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন, তাদের ২৫টি রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এগুলোর মধ্যে হলো হৃদরোগ, ব্রেন স্ট্রোক, মুখের ক্যানসার, গলার ক্যানসার, ফুসফুসের ক্যানসার, পাকস্থলির ক্যানসার, অকালে গর্ভপাত, যৌনশক্তি হ্রাস, গ্যাংগ্রিন, চুল পড়া, চোখের ছানি ইত্যাদি। তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, পরোক্ষ ধূমপান ভ্রুণের মৃত্যুঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় এবং গর্ভবতী নারীদের গর্ভকালীন জটিলতাসহ কম ওজনের শিশু জন্মানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।’

ধূমপানের কুফল যে কী পরিমাণ মারাত্মক, অনুধাবন করে জাতিসংঘ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম জাতিসংঘের ৫৬তম সম্মেলনে ধূমপান ও তামাক জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার জন্য ‘ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)’ নামীয় কনভেনশনে ২০০৪ সালের ১০ মে অনুস্বাক্ষর করেছে। কনভেনশনের বিধান কার্যকর করার লক্ষ্যে ২০০৫ সালের ১৫ মার্চ এ দেশে পাস হয় ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ বিল ২০০৫’। 

ওই সময় আইনটি যথাযথ না হওয়ায় ২০১৩ সালে এ আইনের সংশোধনী পাস হয়। ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন (সংশোধনী) ২০১৩’-এর ৪ নং ধারার ‘চ’-এ বলা হয়েছে ‘পাবলিক প্লেস অর্থাৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত অফিস, গ্রন্থাগার, আচ্ছাদিত কর্মক্ষেত্র, লিফট, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, আদালত, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, নৌবন্দর, রেলওয়ে স্টেশন, বাস টার্মিনাল, প্রেক্ষাগৃহ, প্রদর্শনী কেন্দ্র, থিয়েটার হল, বিপণি ভবন, চতুর্দিকে দেওয়াল দ্বারা আবদ্ধ রেস্টুরেন্ট, পাবলিক টয়লেট, শিশুপার্ক, মেলা বা পাবলিক পরিবহণে আরোহণের জন্য যাত্রীদের অপেক্ষার জন্য নির্দিষ্ট সারি, জনসাধারণ কর্তৃক সম্মিলিতভাবে ব্যবহার্য অন্য কোনো স্থান অথবা সরকার বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দ্বারা সময় সময় ঘোষিত অন্য যে কোনো বা সকল স্থানে’ ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এবং ৪-এর ‘ছ’-এ বলা হয়েছে ‘পাবলিক পরিবহণ অর্থাৎ মোটরগাড়ি, বাস, রেলগাড়ি, ট্রাম, জাহাজ, লঞ্চ, যান্ত্রিক সকল প্রকার জন-যানবাহন, উড়োজাহাজ এবং সরকার কর্তৃক সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্দিষ্টকৃত ঘোষিত অন্য যে কোনো যানে ধূমপান করা যাবে না। কেউ এ আইন ভঙ্গ করলে তার অনধিক তিনশ টাকা অর্থদণ্ড হবে।’ ওই একই আইনে সরকারি-বেসরকারি রেডিও এবং টেলিভিশন চ্যানেলেও তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশে প্রকাশিত কোনো বই, ম্যাগাজিন, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, বিলবোর্ড ও খবরের কাগজে, সাইনবোর্ড বা অন্য কোনোভাবে তামাক ও তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপন এবং তামাক কোম্পানিগুলোর যে কোনো ধরনের প্রচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

অধূমপায়ীদের সুরক্ষিত করার জন্য ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০১৫’ নামে একটি বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। এতে ২০১৩ সালের সংশোধনী আইনের কিছু বিষয় স্পষ্ট করা হয়েছে। এর ৯ ধারায় তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট, মোড়ক, কার্টন বা কৌটায় ক্ষতি সম্পর্কিত সচিত্র সতর্কবাণী মুদ্রণ করার ক্ষেত্রে কতকগুলো পদ্ধতি অনুসরণ করার বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর ‘খ’ ধারায় আছে: ‘পরোক্ষ ধূমপান মৃত্যু ঘটায়’ সংবলিত সতর্কবাণী মুদ্রণ করিতে হইবে। অথচ পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতিকর দিকটির বিষয়ে কতটা সচেতন আমরা? এ বিষয়ে ডা. অরূপ রতন বলেন, ‘সচেতনতা আমাদের মধ্যে একেবারে কম। এ বিষয়ে আমাদের দেশে অনেক ভালো আইন ও বিভিন্ন বিধিবিধান আছে। এমনকি পাবলিক প্লেসগুলোয় কেউ ধূমপান করতে চাইলে নির্দিষ্ট স্থানে এর ব্যবস্থা থাকার কথাও আমাদের আইনে আছে। কিন্তু এর কার্যকারিতা তেমন চোখে পড়ে না।’

পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতিকর দিককে গুরুত্ব দিয়ে ২০১৫-এর বিধিমালার ৬ ধারায় কোনো পাবলিক প্লেস বা পাবলিক পরিবহণে ধূমপানের জন্য কোনো স্থান চিহ্নিত বা নির্দিষ্ট করার কথা বলা হয়েছে। এসব নিয়ম মানলে পরোক্ষ ধূমপানের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যাবে বলে বলছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু বাস্তবে এ নিয়ম কতটা মানা হয়? আইনের বিষয়গুলো নজরদারি করার জন্য দেশব্যাপী টাস্কফোর্স আছে বলে জানা যায়। টাস্কফোর্স আইনের এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নজরদারি করে কি না জানতে চাইলে ‘জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল’-এর কো-অর্ডিনেটর এবং যুগ্মসচিব মো. খায়রুল আলম শেখ বলেন, ‘পাবলিক প্লেসে ধূমপানের জন্য চিহ্নিত বা নির্দিষ্ট স্থান প্রতিষ্ঠার বিষয়ে কাজ খুবই কম দেখা যায়। বলা যায়, এটা খুবই ধীরগতিতে চলছে। এটা করার দায়িত্ব সরকারের নয়, এটা ওইসব পাবলিক প্লেসের মালিকদের করার কথা।’

তিনি আরও বলেন, জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরির জন্য প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তারা কাজ করছে। শুধু সাধারণ মানুষ নন, শিক্ষিত সচেতন মানুষকেও এ বিষয়টিতে অবহেলা করতে দেখা যায়। আমরা টেলিভিশনসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করছি।’

মানুষকে সচেতন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে আহছানিয়া মিশন। মিশন তামাক ও মাদকবিরোধী কর্মসূচি নামে তাদের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ধূমপানকে নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে ৩০ বছর ধরে কাজ করছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও জাতীয় অধ্যাপক মরহুম ডা. নূরুল ইসলাম এদেশে ১৯৮৭ সালে প্রথম ‘আমরা ধূমপান নিবারণ করি’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ধূমপানবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। শুধু সচেতনতা নয়, তিনি ধূমপানবিরোধী আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে পলিসি লেভেলেও কাজ করেন। ধূমপান নিজের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনই ওই সময় যারা ধূমপায়ীর আশেপাশে থাকেন তাদের জন্যও সমান ক্ষতিকর।

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়