ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

নুহাশপল্লী ট্র্যাজেডি : নয় নম্বর বিপদ সংকেত

শাকুর মজিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩০, ১৯ জুলাই ২০১৪   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নুহাশপল্লী ট্র্যাজেডি : নয় নম্বর বিপদ সংকেত

প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ। আলোকচিত্র : মাসুদ আখন্দ

শাকুর মজিদ
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে একা একা ঘর থেকে বেরিয়ে যাই। রাতের অন্ধকারে নুহাশপল্লীর তেমন কিছুই দেখা হয় নি। এবার মনে হলো- হুমায়ূনের বহু নাটক সিনেমায় দেখা এই চত্বরটি আমার বেশ পরিচিত। নুহাশপল্লীর গেট আটকানো। এ গেট দিয়ে ভেতরে কেউ ঢুকতে পারে না। সিনেমার ইউনিটের লোকগুলো আছে ‘বৃষ্টিবিলাস’ নামক একটা ঘরে। ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’- এর সোবহান সাহেবের বাড়ি।

এ ঘরটির ডিজাইন ব্রিটিশ আমলে সিলেটের চা-বাগানগুলোতে ইংরেজ সাহেবরা যে সকল বাংলোবাড়ি বানিয়েছিলেন, তাদের ডিজাইনের অনুকরণে। সামনে তিনদিক খোলা প্রশস্ত বৈঠকখানা, তার পেছনে প্রশস্ত টানা বারান্দা, তার পেছনে ঘর। উপরে টিনের ছাদ। টিনের তলা দিয়ে নকশাদার কাঠের প্যানেলিং। এ কাজগুলো সিলেটের বাড়িতে একসময় হতো। মূলত আসাম অঞ্চলের সম্ভ্রান্ত বাড়িগুলোতে এ রকম নকশার আয়োজন ছিল দেশবিভাগের আগে পর্যন্ত। সিলেট থেকে এগুলো উঠে গেছে, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের প্রথম শৈশবের দিনগুলো এখানেই কেটেছিল বলেই হয়তো এই অঞ্চলের স্মৃতিমাখা একটা ঘর বানিয়েছেন। সিলেট বৃষ্টিপ্রধান অঞ্চল। টিনের চালে বৃষ্টির রিনিঝিনি শুনবেন বলেই হয়তো এমনটি বানানো। একসময় বৃষ্টি বাদলার দিনে তিনি এ ঘরে থাকতেন। এখন থাকেন না। কিন্তু নাম রয়ে গেছে। নাটক-সিনেমার ক্রুরা এখানে থাকতে পারেন। ছোটবড় মিলে ১০টি কামরা আছে এখানে।

তার সামনেই গাছের উপর একটা বাড়ি। ট্রি হাউজ! এ রকম ট্রি হাউজের সন্ধান পেয়েছিলাম চীনের শিশুয়ানবান্নায়। ওয়া উপজাতীয় জংবাজ চীনারা ষাঁড়ের পূজারী এবং তারা গাছের উপর ঘর বানিয়ে থাকে। অনেক খুঁজেও একটা গাছবাড়ি খুঁজে পেলাম না। আমাকে একটা জাদুঘরে নিয়ে গিয়ে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবি দেখানো হলো। হুমায়ূন আহমেদেরও হয়তো কখনো এমন গাছ ঘরে বসে বই পড়তে ইচ্ছে হয়েছিল, তাই বানিয়েছিলেন। তিনি নিজে যা করতে পারেন না, তার উপন্যাসের বা সিনেমার চরিত্র সেটা করে। যেমন হিমু।

কিছুদিন আগে তার সর্বশেষ ছবিটি দেখেছিলাম টেলিভিশনে। ছবির নাম ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’। এ ছবিটিতে হাবাগোবা, বইপড়ুয়া একটি তরুণের চরিত্র আছে, যে মুরগির খোপের মতো এই বৃক্ষবাড়িতে বসে বসে বই পড়তো। পরিবারের কোনো বড় অঘটনও তাকে স্পর্শ করতো না।

নুহাশপল্লী সম্পর্কে আমার একটা ধারণাই হয়ে গিয়েছিল এই ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ ছবিটি দেখে। বারবার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে, সম্পূর্ণ নুহাশপল্লীতে চিত্রায়িত এই ছবি। একসময় সিনেমার বিজ্ঞাপনে শুনতাম ‘সম্পূর্ণ ব্যাংককে’ বা ‘সম্পূর্ণ নেপালে’ চিত্রায়িত। এখন এটা চলে এসেছে দেশের বাগান বাড়িতে।

ইদানীং সিনেমাহলে গিয়ে আমাদের সিনেমা দেখার দরকার পড়ে না। শুধু পুরাতন সিনেমাই নয়, নতুন নতুন ছবিও এখন টেলিভিশনে প্রিমিয়ার হয়। ধন্যবাদ ফরিদুর রেজা সাগরকে। বেডরুমে শুয়ে শুয়ে নতুন সিনেমা দেখার এই মহান সুযোগটি তিনি করে দিয়েছেন বাংলাদেশের দর্শকদের জন্যে। ‘হঠাৎ বৃষ্ট’ দিয়ে শুরু, তারপর চলছে। তিনি পথ দেখিয়েছেন, বাকিরা তার দেখানো পথেই হাঁটছে। আমাদের কত আনন্দ। আমরা হুমায়ূন আহমেদের ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ দেখি ঘরে বসে।

২০০৭ সালে মুক্তি পাওয়া এ ছবিটি বেশিক্ষণ দেখতে ইচ্ছে করে নি আমার। মূলত তার নুহাশপল্লীকে দেখার জন্যই ছবিটি সম্পূর্ণ দেখা। এবং ছবি দেখতে দেখতে আমি টের পেলাম, এ ছবিটায়ও কি লেখক তার নিজের গল্প বলেছেন?

রহমত আলী (সোবহান সাহেব) একজন বিত্তবান  প্রৌঢ়। তিনি শহরের বাইরে একটা বিশাল বাগানবাড়ি বানিয়ে চাকর-বাকরদের নিয়ে থাকেন। কোনো এক অজানা কারণে তার পুত্র-কন্যারা তার কাছে আসে না। বাবার মন সব সময় তার পুত্রকন্যাদের জন্যে ব্যাকুল। একসময় তার মনে হলো যে, জীবিত অবস্থায় আমাকে দেখতে আসছে না ঠিক, কিন্তু আমার মৃত্যুর পর তারা নিশ্চয়ই আসবে আমার লাশ দেখতে। কিন্তু সে সময় তো তিনি তাদের দেখতে পাবেন না। এই চিন্তা থেকে বাড়ির ম্যানেজার (জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়) একটা নাটকীয় দৃশ্য সাজান। তারা তার সন্তানদের জানায় যে, তিনি মারা গেছেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী সব কাজ হয়। একটা কফিনের ভেতর ঢুকিয়ে রাখা হয় রহমত আলীকে। ভাড়া করা মৌলভিরা এসে দোয়া পড়তে থাকেন। একে একে তার দুই কন্যা ও এক পুত্র এসে হাজির হয় মরা বাবাকে দেখতে। আসার পর শুরু হয় নানা রকমের ক্যারিকেচার।
ছবিটি আমার মোটেই ভালো লাগে নি। তবে কয়েকটি গান ভালো লেগেছে। ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে/... কিছুতে কেন যে ভালো লাগে না’।

রবীন্দ্রনাথের গান, শাওনের গলায় গাওয়া এবং তানিয়া আহমেদের খুব সুন্দর কোরিওগ্রাফিতে উপস্থাপনা। নুহাশপল্লী বৃষ্টি বাদলায় কী চমৎকার রূপ নেয়, এ গানটা না দেখলে বোঝা যাবে না। আমি নিশ্চিত, নুহাশপল্লী কোনো বাদলেই এমন রূপ পায় নি, এ রূপটা হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি করা। সিনেমায় বৃষ্টিবাদলা তৈরি করার অনেক যন্ত্রপাতি এফডিসিতে আছে, ভাড়ায় পাওয়া যায়।

নয় নম্বর বিপদ সংকেতের অন্য গানগুলোও ভালো লেগেছে। হুমায়ূন আহমেদ নিজেই তার ছবির জন্যে গান লিখেন। কোনো জীবিত গীতিকারের সুযোগ নাই তার ছবির জন্যে গান লিখতে। এর আগে বিভিন্ন ছবিতে তিনি হাছন রাজা, রবীন্দ্রনাথ, রশিদ উদ্দিন, উকিল মুন্সি এসব মৃত গীতিকারদের লেখা গান ব্যবহার করেছেন। এ ছবির একটা রোমান্টিক গান-

                ‘...তোমাকে বলব, হ্যালো মিস্টার, খবর শুনেছো নাকি
                তোমার আমার প্রণয় নিয়ে দেশজুড়ে মাতামাতি
                ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে তোমার আমার পোস্টার
                সব পত্রিকায় ফ্রন্টপেজে ছবি তোমার এবং আমার।’

আরেকটা কাওয়ালি গান লিখেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। বাংলা-হিন্দি [বা উর্দু] মিলিয়ে। কাওয়ালি আসরে গান গাইছেন তানিয়া, পুরুষ ও মহিলার গলায়। পুরুষের গলা এসআই টুটুলের, মহিলার কণ্ঠ শাওনের। গানের কথাগুলো এমন-

                পুরুষ  : মজনু কাঁদিয়া কয়, লাইলী তুম কাহা
                                ফাগুন রজনী ফুরায় যায়
                মহিলা   : লাইলী হাসিয়া কয়, মজনু হাম ইয়াহা
                                কিউ তুমহারা ইতনা হায় হায়

গানের ক্ষেত্রে তিনি রবীন্দ্রনাথের পর বাংলার লোকগীতিকেই সব সময় প্রাধান্য দিয়েছেন। সবার আগে দিয়েছেন ‘হলুদিয়া পাখি, সোনালী বরণ’ গানটি। রশিদ উদ্দিনের লেখা এ গানটি আবদুল আলিমের গাওয়া ছিল। এরপর হাছন রাজা এসে ভর করেছিলেন হুমায়ূনের উপর। এ নির্ভরতা থেকে কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। নিজের  ভেতর একজন হাছন রাজাকেও তিনি লালন করতেন। হাছনের ছিল দেখার হাওড়, বজরা নাও, কুড়া শিকার, জ্যোৎস্নাবিলাস। হুমায়ূনও তার রাজত্ব গড়ে তোলেন ৪০ বিঘার সাম্রাজ্য নুহাশপল্লী।

এ সিনেমাটি নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ সম্ভবত নিজেই খুব সিরিয়াস ছিলেন না।  তার নুহাশপল্লীকে অবলম্বন করে বানাবেন বলেই হয়তো এমন পরিকল্পনা নিয়ে বানানো। তা না হলে সিনেমার টাইটেলে কেন তিনি লিখবেন ‘হুমায়ূন আহমেদের একটি অর্থহীন ছবি’। মজার কথা- এর শেষ দৃশ্যে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনেতা রহমত আলীকেও বলতে শোনা যায় এমন কথা যে, ‘ছবি দেখে ভালো লাগলে লাগল, না লাগলে নাই, আমাদের ছবি এখানেই শেষ।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ জুলাই ২০১৪/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়