ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

কোনো এক সুজনের গল্প

তানজিনা ইভা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:০৫, ১২ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কোনো এক সুজনের গল্প

ফাইল ফটো

তানজিনা ইভা : সুজন শেখ কুষ্টিয়া শহরেই রিকশা চালান। গ্রামের বাড়ি জেলার কলাবাড়ীতে। বাড়িতে আছেন বৃদ্ধ মা-বাবা, স্ত্রী, এক ছেলে আর ছোট একটা বোন। ছোট বোনটা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ছেলে পাভেলের বয়স সাড়ে চার বছর। সুজনের বাবার বয়স হয়েছে। কাজকর্ম তেমন করতে পারেন না। পরিবারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি একজনই। আর  তিনি হলেন সুজন শেখ।

 

পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ভিটাটুকু ছাড়া সুজনের আর কোনো সম্পত্তি নেই। সুজনের বাবা কেরামত আলী শেখ বেশ জমিজমা পেয়েছিলেন। তবে তা ধরে রাখতে পারেননি। দুই ভাই ছিলেন কেরামত আলীরা। ছোট ভাই ভালোই আছেন। বাবার যে জমিজমা পেয়েছিলেন তা বিক্রি করে তরুণ বয়সে বিদেশ গিয়েছিলেন কেরামত আলী।

 

তবে থাকতে পারেননি। চার মাস পরই তিনি দেশে ফিরে আসেন। পরিবারকে রেখে বিদেশে থাকা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। অবশ্য যাওয়ার সময় তা মনে হয়নি তার। তখন তো চোখে নতুন স্বপ্ন ছিল। একবার বিদেশ গেলে বাকি জীবন শান্তিতে পার করা যাবে।

 

সে আশার ‍গুড়ে বালি। দেশে যে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন তার সবই গোল্লায় গেছে। বিদেশ থেকে ফিরে এসে জমিজমা বিক্রি করেছেন আর আরাম আয়েশে দিন পার করেছেন। এভাবে আর কতদিন। কথায় বলে না, বসে খেলে রাজার ভাণ্ডারও শেষ হয়ে যায়। তাই হয়েছে কেরামত আলী শেখের। সম্পত্তি বলতে এখন শুধু বাড়ির অবশিষ্ট জমি আর ছেলে সুজনই একমাত্র ভরসা।

 

ছেলের ভবিষ্যতের চিন্তা করে কেরামত আলী শেখ কিছুই করেননি। তাই সুজন এখন রিকশা চালিয়ে সংসার চালায়। তাতে সুজনের তেমন আক্ষেপ নেই। সংসারের নিত্য দিনের চাহিদা মেটাতে পারলেই সে খুশি। তবে রিকশা চালিয়ে আর কতই বা আয় হয়। ছয়জনের সংসার চলে একজনের আয়ে।

 

সুজনের স্ত্রী পারভীন দ্বিতীয়বারের মতো মা হবেন। বেশ কিছুদিন হলো তার শরীর খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। সুজন আগে থেকে মোটামুটি টাকা পয়সা গুছিয়ে রেখেছেন। সন্তান আসবে এমন কথা বউয়ের কাছ থেকে শোনার পরই একটা মাটির ব্যাংক কিনে এনেছে সুজন। সেখানে প্রতিদিন ৫-১০ টাকা করে জমা করেন। শুধু সুজনই না তার স্ত্রীও হাঁস-মুরগির ডিম বিক্রির টাকা ওই ব্যাংকে জমা রাখেন। দুই দিন আগেই মাটির ব্যাংকটি ভাঙা হয়েছে। প্রায় ছয় হাজার টাকা জমা হয়েছে। প্রথম সন্তান হওয়ার সময়ও তারা এভাবেই টাকা জমা রেখেছিল।

 

সকাল থেকে পারভীনের শরীর ভালো না। হাসপাতালে নেওয়া দরকার। এদিকে সুজন রিকশা নিয়ে শহরে চলে গেছে। ফিরবে সেই দুপুরে। সুজনের বাবার যে অবস্থা সে নিজেই চলতে পারে না তারমধ্যে বউমাকে নিয়ে কেমন করে হাসপাতালে নেবে। সুজনের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া তো উপায় নেই। এদিকে সুজন একটা বড় ট্রিপ পেয়েছে। মনটাও ভালো, আজ ভালো আয় হবে। ট্রিপটা মেরেই বাড়ি ফিরবে। সে তো আর জানে না পারভীনের শরীরের অবস্থা এতো খারাপ। সুজনের বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা ৬টা বেজে গেল। বাড়ি ফিরে দেখে পারভীনের অবস্থা খুবই খারাপ। সুজন দ্রুত তাকে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করলেন।

 

ডাক্তাররা জানিয়েছেন, পারভীনের অবস্থা বেশি ভালো না। অপারেশন করতে হবে, রক্ত লাগবে। সুজন হাসপাতাল খেকে বেরিয়েছে রক্তের সন্ধানে। প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে খোঁজ করতে হবে। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে একটু এগিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে কোন দিকে যাবে। তার মাথা যেন কাজ করছে না। একটু দূরে পুলিশের একটি গাড়ি দাঁড়ানো। সেদিকে সুজনের কোনো খেয়াল নেই। গাড়ির কাছ থেকে একজন পুলিশ এগিয়ে আসলো সুজনের দিকে। সুজনকে জিজ্ঞেস করল, কিসের ধান্দায়?

 

সুজন পুলিশকে জানাল স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছে। ওই পুলিশ আরেক পুলিশকে ডেকে বলল তাকে আটক করে গাড়িতে তুলতে।কারণ, চলাফেরা সন্দেহজনক।

 

সুজন অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল। পুলিশ তার নিজের কাজ করছে। সুজনকে তুলে নিয়ে গাড়ি কুষ্টিয়া চৌড়হাঁস মোড়ের দিকে এগিয়ে গেল। ওই খানে পুলিশের গাড়ি দাঁড় করালো।

 

আগামীকাল কুষ্টিয়া জেলা শহরে হরতাল ডাকা হয়েছে। নাশকতা হতে পারে। এ কারণে পুলিশ বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে। সন্দেহজনক কাউকে দেখলে পুলিশ আটক করছে। ওখান থেকে আরেকজনকে আটক করে গাড়িতে তোলা হয়েছে। তার বয়সও বেশি না।

 

সুজন কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। যে পুলিশ তাকে আটক করেছে তাকে বার বার বোঝানোর চেষ্টা করছে, তার স্ত্রী হাসপাতালে। বাচ্চা হবে। অবস্থা ভালো না। তার জন্য রক্ত কিনতে বের হয়েছে। ওই পুলিশ তার কথায় কর্ণপাত করছে না। ড্রাইভারকে অর্ডার দিলো গাড়ি অন্যদিকে নিতে। পুলিশের গাড়ি বিভিন্ন রাস্তায় টহল দিচ্ছে। কোথাও থামছে, আবার কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছে। ফজরের আযান শোনা যাচ্ছে।

 

সুজন সারা রাত কেঁদেছে। চোখ ফুলে গেছে। পুলিশকে বার বার বলেছে, হাসপাতালে তাকে যেতেই হবে। তাকে যেন ছেড়ে দেয়। অবশেষে পুলিশের দয়া হলো। অন্য আরেক পুলিশকে অর্ডার দিলো তাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে। খবর নিতে ও সত্য বলছে না মিথ্যে।

 

সুজন হাসপাতালে গেল। সঙ্গে থাকা পুলিশ রোগি ভর্তির তথ্য থেকে জেনেছে সুজন সত্যি কথাই বলেছে। তাকে ছেড়ে দেয় পুলিশ।

 

সুজন হাসপাতালের ভেতরে গিয়ে দেখে যে বেডে তার স্ত্রীকে রেখে গেছে, সেখানে নেই। নার্সদের কাছে ছুটে গেল।

 

নার্সরা জানাল, তার মেয়ে হয়েছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে রোগির মৃত্যু হয়েছে। তারা বাচ্চাকে এনে সুজনের কোলে দিল। সুজন পারভীনের রেখে যাওয়া সর্বশেষ স্মৃতির দিকে তাকিয়ে আছে ভাবলেশহীন।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ অক্টোবর ২০১৫/ইভা/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়