ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

গাজীপুরের বলধা জমিদারবাড়ি

হাসমত আলী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ১ জানুয়ারি ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গাজীপুরের বলধা জমিদারবাড়ি

গাজীপুরের বলধা জমিদারবাড়ির সামনের একটি অংশ

গাজীপুরের বাড়িয়া ইউনিয়নের বলধা গ্রামে একসময়ে ‘বলধা জমিদারবাড়ি’ ছিল। ছিল এজন্য যে, সেটি আর আগের মতো নেই। এক প্রকার ধ্বংসপ্রাপ্ত। সেখানে রয়েছে জমিদারদের নির্মিত একটি কালীবাড়ি ও একটি স্কুল ভবন। যা এ এলাকায় যে এককালে জমিদারিত্ব চিল তার অস্তিত্ব প্রমাণ করে। কালী বাড়িটি ছয় কক্ষ বিশিষ্ট ‘ভি’ আকৃতির একতলা পাকা ভবন। সেগুলোও এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।


বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, বলধার জমিদার ছিলেন রাজ কিশোর রায় চৌধুরী। তার দত্তক পুত্র ছিলেন জমিদার হরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি। ধারণা করা হয়, হরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী এ জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করেন। জমিদার বাড়িটি ছিল ৪০ কামরা বিশিষ্ট। স্থানীয়ভাবে এটি ‘চৌধুরীবাড়ি’ বা ‘চদরিবাড়ি’ হিসেবে সমধিক পরিচিত।

এ জমিদার বাড়িটির দক্ষিণে একটি বিশাল মাঠ, স্কুল, কালীবাড়ি ও একটি দিঘি রয়েছে। অবশ্য স্কুলটি এখন স্থান পরিবর্তন করে মাঠের উত্তর পাশে স্থানান্তর করা হয়েছে।

বলধার জমিদার বাড়ির ধংসাবশেষ (ছোট ছোট ইটের ঢিবির মতো) ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। পূর্বপাশে প্রায় আড়াই শ’ ফুট লম্বা, দুই ফুট প্রশস্ত এবং কোথাও ২-৩ আবার কোথাও ৫-৭ ফুট উঁচু একটি দেওয়াল রয়েছে।

                              কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বলধা জমিদারবাড়ির কালি মন্দিরের একটি অংশ


স্থানীয় মুরব্বি আব্দুল বাতেন জানান, ওই দেয়ালটি ছিল বাড়ির সীমানা প্রাচীর। জমিদার বাড়িটি ছিল তিন তলা বিশিষ্ট। উনবিংশ শতাব্দির শেষ দিকে কিংবা বিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে এখানকার জমিদার (নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী) ঢাকায় চলে যান। মাঝে মধ্যে জমিদারের ভাগিনা ‘ভুটু বাবু’ এই স্টেট দেখাশোনা করতে এখানে আসতেন।


অবস্থান : গাজীপুর জেলা শহর তথা ভাওয়াল রাজবাড়ি থেকে পূর্বদিকে গাজীপুর সদর উপজেলার বায়িড়া ইউনিয়নে বলধা গ্রাম অবস্থিত। জেলা শহর থেকে দূরত্ব প্রায় ৭-৮ কিলোমিটার। সড়ক পথে দেশের যে কোনো স্থান থেকে গাজীপুরের জেলা শহরের শিববাড়ি মোড়ে আসতে হবে। আর ট্রেনে নামতে হবে গাজীপুর জেলা শহরের জয়দেবপুর জংশনে। সেখান থেকে জয়দেবপুর-রাজাবাড়ি সড়ক হয়ে এ জমিদার বাড়ির যাওয়া যায়।


জানা গেছে, বর্তমান গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া, শ্রীপুর, কালীগঞ্জ, গাজীপুর সদর উপজেলার বিভিন্ন মৌজার জমি বলধা জমিদারদের এস্টেটের আওতায় ছিল। এ ছাড়া ঢাকার কাফরুল এবং তেজকুনীপাড়া বলধা জমিদারীর অন্তর্গত ছিল। এ ছাড়া ভাওয়াল রাজবাড়ির সামনের বিশাল মাঠ এবং পুরনো ঢাকার বলধা বোটানিক্যাল গার্ডেন বলধার জমিদারদের সম্পত্তি ছিল।



জমিদার হরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি ছিলেন নিঃসন্তান। তিনি বলধার জমিদারী রক্ষায় গাছার জমিদারপুত্র ১৪ বছর বয়সি নরেন্দ্র নারায়ণকে দত্তক নেন। বলধার ভবিষ্যৎ বংশধরকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ছেলের জন্য গৃহ শিক্ষক রাখেন। নরেন্দ্র নারায়ণ শ্রী হরিনাথ দে’র কাছে ইংরেজি, হেকিম হাবিবুর রহমানের নিকট আরবী ও ফার্সি, শরৎ চন্দ্র কাব্য তীর্থের কাছে সংস্কৃতি শিখেছিলেন। নরেন্দ্র নারায়ণ ছিলেন নাট্যকার, কবি, গীতিকার, প্রকৃতি প্রেমিক।  তিনি বাংলা ও ইংরেজিতে কবিতা লিখেছেন।


নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরির জমিদারি শৈলাট, ধনুয়া ও ধামরাই মৌজায় বিস্তৃত ছিল। তিনি নিজের জমিদারি সীমানার বাইরে ক্রয়কৃত জমিতে একাধিক বাড়ি নির্মাণ করেন। তার মধ্যে কলকতায় ও দার্জিলিংয়ে দুটি করে, লখনৌ ও পুরিতে একটি করে। ঢাকার ওয়ারীতে তার নির্মিত বাড়িটি এখনো কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

 

                               বিদ্যালয়ের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে বলধা জমিদার বাড়ির এই অংশটি


নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী এ বাড়ির নাম দিয়েছিলেন ‘কালচার’, যা বলধা হাউজ নামে সমধিক পরিচিত। এর আগে তিনি ঢাকার তেজগাঁও নির্মাণ করেন ‘নিমফ’ হাউজ নামে অনিন্দ সুন্দর বাগানবাড়ি। ঢাকার ওয়ারী এলাকায় একটি যাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় প্রাচীন নিদর্শনাদি সংগ্রহ করেন। এ জাদু ঘরটি বিশেষ করে সমৃদ্ধ ছিল মুদ্রা, মধ্যযুগের যুদ্ধাস্ত্র ও পোষাকের জন্য। পাকিস্তান আমলে সরকার যাদুঘরটি অধিগ্রহণ করে সমস্ত সংগ্রহ ঢাকা জাদুঘরে স্থানান্তর করেন।


পুরাকীর্তি ও প্রাচীন ইতিহাসের উপকরণ সংগ্রহের পাশাপাশি জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী বিভিন্ন দেশের দামী ও বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ সংগ্রহ করে বিখ্যাত বলধা বোটানিক্যাল গার্ডেন তৈরি করেন।
নরেন্দ্র নারায়ণ বরিশালের বানারীপাড়া এলাকার গুহ ঠাকুরের মেয়ে মৃণালীনি দেবীকে বিয়ে করেন। তাদের নৃপেন্দ্র নারায়ণ এবং সুনীতি বালা নামে দুটি সন্তান হয়। নৃপেন্দ্র নারায়ণ ‘খোকা বাবু’ নামে সমধিক পরিচিত। খোকাবাবু ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি কালচার হাউজে থাকতেন।


এদিকে জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী পরিণত বয়সে আরো একটি বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম ছিল সুধাংশু কিরণ। এ নিয়ে প্রথম স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর পারিবারিক কলহ শুরু হয়।


গান শেখানোর জন্য জমিদার সুধাংশু কিরণকে বলধা হাউজেই রাখতেন। কিন্তু সুধাংশু কিরণ ছিলেন নিঃসন্তান। তিনি চেয়েছিলেন নিজের ভাইকে দত্তক নিতে। এ নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। জুন ১৯৪০ সালের সুধাংশু কিরণের পাঠানো প্রকাশ নামে এক কাজের লোক ঘুমন্ত অবস্থায় জমিদার পুত্র খোকা বাবুকে হত্যা করে। পরে বিচারে হত্যাকারী প্রকাশকে দীপান্তর দেওয়া হয়, আর সুধাংশু কিরণ হন নির্বাসিত। একমাত্র পুত্রের মৃত্যুর তিন বছর পর ১৯৪৩ সালে নরেন্দ্র নারায়ণ রায়ের মৃত্যু হয়।

 

 


তথ্য সূত্র : গাজীপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং আব্দুল বাতেন, গাজীপুর।

 

 



রাইজিংবিডি/গাজীপুর/হাসমত আলী/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়