ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

ছিচকাঁদুনে পেত্নি || ইবনুল কাইয়ুম

ইবনুল কাইয়ুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০১, ২৫ জুন ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছিচকাঁদুনে পেত্নি || ইবনুল কাইয়ুম

ইকবালদের বাড়ির একপাশে ঘন বাগান। নানা রকমের গাছে জড়াজড়ি করে একেবারে দুর্ভেদ্য করে রেখেছে যায়গাটা। দিনের বেলায়ও অন্ধকার থাকে। সেখানে একটা বারোমাসি বরই গাছ আছে। সেই গাছের বড় বড় রসাল এবং টক মিস্টি স্বাদের এই বরইয়ের সুনাম সারা গ্রাম জুড়ে। তবে সেই বরইয়ের স্বাদ সহজে কেউ নিতে পারত না। একটা পেত্নি নাকি থাকে ওই বাগানে।

 

সেখানে বরই কুড়াতে বা পাড়তে গেলে লোকে পেত্নির কান্না ‍শুনতে পেতো বলে শোনা যায়। অবশ্য আজো কেউ তাকে চোখে দেখেনি বা কান্না শুনেছে বলে সরাসরি বলতে পারে না। সবাই বলে শোনা কথা। শুধু  শোনা যায় একবার বরই কুড়াতে গিয়ে পটলার মা একটা কালো ষাড়ের তাড়া খেয়েছিল। তবে তাড়া খেয়ে পটলার মা যেই বড় পুকুর পাড়টা পার হয়েছে অমনি হুশ করে নাকি ষাড়টা বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছিল। আর দূর থেকে ইনিয়ে বিনিয়ে একটা নাকি সুরে কান্নার মতো শুনেছিল সে। এতেই ভিরমি খেয়ে পড়ে গিয়ে সেএক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার হয়েছিল তার।

 

সেদিন হলো কি- স্কুল ছুটির পর থেকেই বৃষ্টি পড়া শুরু হলো। প্রথমে ফিস ফিস করে পড়তে থাকে। তাই তেমন গুরুত্ব না দিয়ে ছেলেরা দল বেঁধে হুল্লোড় করতে করতে বেরিয়ে পড়ল। ঝন্টুও ছিল ওদের দলে। সে গায়ের শার্ট খুলে বইগুলো কষে বাঁধল। তারপর দিলো ছুট।

 

কিছু দূর যেতে না যেতেই যখন ঝম ঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। আশপাশে আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনো যায়গা নেই। কি করি করি ভাবতে ভাবতে ভিজতে ভিজতে বাড়ির দিকে যাচ্ছিল সে। হঠাৎ রাস্তার পাশে ঝোপের মধ্যে একটা মানকচু গাছ চোখে পড়ল। মানকচুর বড়বড় পাতা দেখে তার মাথায় বুদ্ধি ঝিলিক দিয়ে ওঠে।

 

খানিক পরে দেখা গেলো বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বড়সড় একটা মানকচুর পাতার নিচে ঝন্টু বাড়ির দিকে চলেছে। আকাশে জমাট মেঘ। প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে, মনে হচ্ছে এই ভর দুপুরেই সন্ধ্যা নেমে এসেছে। একা একা পথ চলছে ঝন্টু। বন্ধুরা সবাই হুল্লোড় করতে করতে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বাড়ির দিকে ছুটেছে। তার সে উপায় নেই। সর্দি বা জ্বর হলে আর নিস্তার নেই। মায়ের বকুনিতে প্রাণটাই চলে যাবে। তাই যতটুকু পারে নিজেকে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচিয়ে বাড়ি চলেছে সে।

 

পথে ওদের গ্রামের ঈদগাহ পড়ে। ঈদগাহ মাঠে গ্রামের ছেলেরা ফুটবল খেলছে। ওর বন্ধুরাও তাতে যোগ দিয়েছে। মিনারের মধ্যে শুকনো যায়গায় সবাই বই খাতা রেখে খেলায় নেমে পড়েছে। গোড়ালি সমান পানি জমেছে মাঠে। লাথি দিলে বল যায় এক হাত, পানি যায় দশ হাত। খুশিতে সবার দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। দাঁত বের করেই সবাই খেলছে।

 

ঝন্টুরও খুব খেলতে ইচ্ছে করে। সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওদের খেলা দেখে। বন্ধুরা তাকে ডাকে। সে মাথা নাড়ে। এইভাবে পানিতে ভিজলে নির্ঘাত জ্বর আসবে। মায়ের প্যাদানির ভয়ে সে খেলার চিন্তা বাদ দিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ায়। পেছন থেকে বন্ধুদের টিটকারি কানে আসে। তারা তাকে ‘বিদ্যা বোঝাই পণ্ডিত’ বলে খেপাতে থাকে।

 

ওদের কথায় কান না দিয়ে সে হাঁটা ধরে। আনমনে হাঁটছে ঝন্টু। খুব ঘন হয়ে বৃষ্টি নেমেছে। দুহাত দূরে আর দৃষ্টি চলে না। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া এসে ওর কচুর পাতার ছাতাটিকে উল্টে দেয়। মাথায় পানি পড়তেই দাঁড়িয়ে যায় ঝন্টু। পাতা ঠিক করতে করতে হঠাৎ চমকে ওঠে সে। ইকবালদের বাড়ির পাশের বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে।

 

নিজেই অবাক হয়ে যায় ঝন্টু। বৃষ্টিতে একমনে পথ চলতে চলতে কখন এখানে চলে এসেছে টের পায়নি। ইকবালদের বাড়ি পার হয়ে আরো খানিকটা পথ গেলে ওদের বাড়ি। তবে এ পথে সাধারণত সে আসে না। ওদের এই বাগানে নাকি পেত্নি আছে। সে আবার ভূত-পেত্নিদের খুব ভয় পায়। তাই একটু ঘুর পথে সে চলাফেরা করে।

 

দ্রুত পা চালায় সে। হঠাৎ কি যেনো একটা ঢিলের মতো এসে পড়ে ওর কচুর পাতার ছাতাটিতে। ছাতা ফুটো হয়ে যায়। ফুটো দিয়ে পানি পড়ে। সামনে তাকিয়ে দেখে একটা টসটসে পাকা বরই। খপ করে তুলে নেয় সে বরইটি। সাথে সাথে শিলা বৃষ্টির মতো দশ বারোটি বরই তার ছাতার ওপর পড়ে। এতগুলো ফুটো নিয়ে পাতাটিকে আর ছাতা বলে চালানোর উপায় নেই। সে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। কি করবে দিশা পায় না। বরই কুড়াবে নাকি ঝেড়ে দৌড় দেবে বুঝতে পারে না। বরইগুলো কোথা থেকে আসছে তাই ভাবতে গিয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ে। পাতার ফুটো দিয়ে পানি গড়িয়ে তাকে ভিজিয়ে দিতে থাকে।

 

বারো কয়েকটি বরই এসে পড়ে তার মাথায়। এবার তার হুশ হয়। তবু এতগুলো টসটসে বরই সে ফেলে যাবে! দ্বিধায় পড়ে যায়। এমন সময় একটা ভাবনা তার মাথায় আসতেই জোরে পা চালায় সে। এমন পেছন থেকে একটা চিকন গলার কান্নার সুর কানে আসে তার। ‘কিঁ রেঁ ছোঁড়া বঁরইগুঁলো নিঁলি নাঁ যেঁ।’

 

আর বেশি কিছু তার শোনার সময় নেই। কচুর পাতা ফেলে ঝেড়ে দৌড় লাগায় ঝন্টু। এমন সময় তার পিছন থেকে নাকি সুরের কান্না ভেসে আসে। কে কাঁদছে তার সেসব শোনার সময় নেই। এক দৌড়ে বাড়ি। তারপর তিনদিন কাঁপানো জ্বর। মা কিছু বলেননি অবশ্য। বলবেন কি, তার জ্বর ছাড়াতেই তো মা ব্যস্ত ছিলেন।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ জুন ২০১৫/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়