ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

জলকাব্য || সুহিতা সুলতানা

সুহিতা সুলতানা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ২৬ আগস্ট ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জলকাব্য || সুহিতা সুলতানা

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

একজন কবি খোলা চোখে বরষা কীভাবে দেখেন? তার কবিতায় বরষা কীভাবে রূপকময়তা সৃষ্টি করে তা কেবল কবির পক্ষেই অনুধাবন করা সহজ। আমার প্রিয় ঋতু বরষা; বরষাময় দিনরাত্রি আমি ভীষণভাবে উপভোগ করি। অপূর্ব এক কুয়াশাময় পরিবেশের ভেতর কবিকে টানতে থাকে।

 

‘গগনে গরজে মেঘ’, ‘অন্তহীন গগনতল/ফেনিল ওই সুনীল জল/নাচিছে সারা বেলা’। রবি ঠাকুরের কবিতা ও গানে অদ্ভুত এক বর্ষাময় শিহরণ রয়েছে যা থেকে আমরা কেউই অভিন্ন নই।

 

ষড়ঋতুর এ্‌ই দেশে দারুণভাবে বরষা নানা রকম সাজে আমাদের কাছে উপস্থিত হয়। কখনো মেঘ, কখনো রঙধনুর রং, কখনো বৃষ্টির অপরূপ শোভা মাতাল হাওয়ায় আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে চলে! কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যে মেঘ, বরষা ও জল কবির বিরহ যাতনা আরো স্পষ্ট করে তুলেছে:

‘শ্রাবণ বরিষণে কঠিন হবে খুব বিরহবাস/না-যদি মেঘ করি অমল দূত আর পাঠাই মঙ্গল বারতা’

 

জীবনানন্দ দাশের কবিতাতেও বরষার অপরূপ চিত্র পাই। সেখানে কবি লিখেছেন:

‘আমাকে সে নিয়েছিল ডেকে/বলেছিলো: এ নদীর জল/তোমার চোখের মত ম্লান বেতফল/সব ক্লান্তি রক্তের থেকে/স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি/এই নদী তুমি।’

 

অর্থাৎ কবির কবিতায় বরষাকে ছাপিয়ে গিয়েছে নদীর জল। এখানেও কবির নিঃসঙ্গতা ও বিষাদের চিত্র মূর্ত হয়ে উঠেছে ।

 

‘আমার কছে কোনো আগুন ছিল না /আমি চাঁদের  আগুনে/শাদা সিগ্রেট জ্বালিয়ে বসেছিলাম কুয়াশায়।’ আবুল হাসানের এ কবিতার ভেতরেও এক ধরনের নিঃসঙ্গতা ও কষ্ট যা সিগারেটের ধোঁয়ার ভেতরে আর্বতিত হয়েছে। কবির ভাবনার ভেতরে কুয়াশা ও ধূসরময়তা ভর করেছে । রবীন্দ্রোত্তর কবিদের কবিতায় বরষা এসেছে। তবে সব কবিকে যে বরষা আকর্ষণ করবে তা কেন? আমি তা মনে করি না । অনেক কবি শীতকেও প্রাধান্য দিয়ে থাকে আবার শরৎ ও নানা উপসর্গ তৈরি করে কবিতার ভেতর। স্মৃতির পটে জীবনের ছবি আঁকতে কে না চায়? ঘোর বর্ষণে বরষায় পা ডুবিয়ে বসে থাকার ভেতর যে আনন্দ ও নষ্টালজিয়া কাজ করে তা বোধ হয় একজন রোমান্টিক কবির পক্ষেই সম্ভব অনুভব করা।

 

প্রকৃতির সঙ্গে মিশে জীবনকে আলাদা করে দেখা এবং প্রকৃতির ওপর লগ্ন হয়ে থাকা অর্থাৎ সর্বতোভাবেই নিজেকে আলাদা

করে রাখা একজন কবির জন্য সবচে` বহুমাত্রিক দিক। জলের কোনো রং নেই। এই রঙহীন জীবনের সাথে প্রবল ঘনিষ্ঠতা

কবির। বনফুল, নদীর জল, পাখির কলতান ও অরণ্য বিহার কবির প্রত্যাশিত সময়কে আরও মধুময় করে তোলে। বর্ষার জল আর

শরতের হাওয়া উপলদ্ধিজাত মনকে অব্যর্থতায় ঢেউয়ের সাথে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়। বর্ষার অপরূপ শোভা কবিকে আচ্ছন্ন করে তোলে, বরষায় মনের ভাব প্রকাশের ওপর বিরহ বাসা বাধে। ছোট ছোট পাহাড়ের ওপর বৃষ্টির ফোঁটা আরও জীবন্ত করে তোলে প্রাণধারা।

 

চর্যাপদ থেকে শুরু করে বাঙালির মোহন আকুতি কখনো বরষায় কখনো খরায় কখনো শিকারে কখনো আবেগের উষ্ণ ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। অথই জল কবিকে মুগ্ধ টানে অবিরাম । মেঘপুঞ্জের অন্তরালে ঘন কালো মেঘ ক্রমশ কবিকে আচ্ছন্ন করে তোলে। এ থেকে যেন তার মুক্তি নেই । বরষামগ্নতা অপূর্ব কাব্যময়তা সৃষ্টিতে গভীরভাবে কবিকে পূর্ণতা এনে দেয়।  ভরা বরষায় কবি কাব্যবিরহকে প্রেমময় করে তোলে।

 

`এমন দিনে তারে বলা যায়

এমন ঘনঘোর বরিষায়`

আমরা বারবার রবীন্দ্রনাথের কাছে ফিরে আসি। বরষার মোহময় রুপ যেভাবে তিনি তাঁর কবিতায় চিত্রায়িত করেছেন তা

বোধ হয় অন্য কোন কবি করেননি। এক বিস্ময়কর ভাবনা তাঁর লেখার মধ্যে অসামান্য হয়ে উঠেছে। এই যে আমার ভাবনার ভেতরে বারবার বরষার নান্দনিকতা মোহগ্রস্ত করে তোলে তা থেকে যেন মুক্তি নেই । একাকিত্বের বিষণ্ন আলোয় শ্রাবণ বরিষণ কবি প্রকৃতির মোহন রূপ বরষার মতন অপরূপ করে তোলে। বরষাকে নানাভাবে উপভোগ করা যায়। `বিরহ` শব্দটির সাথে বরষার একটি যোগসূত্র রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের প্রেম পর্বের গানে একটা যোগসূত্র রয়েছে বরষার ও বিরহের  সাথে। রোমান্টিক কবির ভাবনার ভেতরেই বরষা অধিক উপভোগ্য হয়ে ওঠে। ভাবগত প্রেরণা আর প্রেয়সীর জন্য আকুলতা তৈরি হয় ঘন বরষায় ।

 

`ব্যাকুল বেগে আজ বহে যায়/বিজলি থেকে থেকে চমকায় / যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে / সে কথা আজি যেন বলা যায় /এমন ঘনঘোর বরিষায় `- এখানে বরষার ভাবগত প্রেরণা গভীরভাবে লক্ষ্যণীয়। অধিকাংশ কবির কবিতায় বরষার মোহময়তা উপলদ্ধি করা যায়।

কবির জীবনচক্রের সাথেও বরষার প্রেম- বিরহ আর্বতিত হয়, ঘন হয়ে পাশে বসে। রবীন্দ্রনাথের মতো এখনকার কবির মনও আনন্দে মেতে উঠতে চায়; কিন্ত সময় এবং সমাজ ব্যবস্থার জাতাকলে কবিকে অনবরত পিষ্ট হতে হয়, রক্তাক্ত হতে হয়। ভেজা পাতার ওপর মন লগ্ন হয়ে থাকতে চায়। রবি ঠাকুর মনের আনন্দে বিরহ ও বরষাকে উপভোগ করেছেন-এ কথা যেমন সত্য পাশাপাশি তার বিরহ যাতনাও কম ছিল না।

নদী, পাহাড়, সমুদ্র, অরণ্য, মাটি, আকাশ সবকিছু কবি তার ভাবনার ভেতরে গ্রোথিত করে।

 

‘আমিও তেমনি নামি ছদ্মবেশী বঙ্গোপসাগর/ বৃষ্টি বিবৃতি ঝরি, জলবিন্দু, নিস্তব্ধ তোমাতে`- আল মাহমুদের এ দুটি লাইনের ভেতরেও গভীরভাবে উঠে এসেছে বৃষ্টি বন্দনা। বরষা ধ্রুপদ মগ্নতা আমার মনও রাঙিয়ে দেয়। শ্রাবণের ঘোর তমসায় কুহকিনীর মতো মায়াজাল সৃষ্টি করে। মনের তৃষ্ণা মেটাতে বৃষ্টি ঐশ্বর্য ধীবরের জাল প্রেমময় করে তোলে। বারবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ও কবিতা বরষাকে আরো বরষাময় করে তুলেছে` আজি শ্রাবণঘন গহন মোহে গোপন তব চরণ ফেলে/ নিলাজ নীল আকাশ ঢাকি নিবিড় মেঘকে দিল মেলে`। এই যে বৃষ্টি ভেজা হাওয়ার উল্লাস উদ্বেলিত অপেক্ষা` গহনরাতে শ্রাবণধারা পড়িছে ঝরে`।

 

এভাবে বর্ষার বিশুদ্ধ রূপ করির কবিতায় আষাঢ় শ্রাবণের নান্দনিক সুষমা মনোভূমিতে জলকাব্য হয়ে ঢেউ তোলে। বরষা আমার ভেতরেও সমানভাবে রহস্য সৃষ্টি করে:

`ঘন বরষায় তৃষ্ণার ডাহুক জেগে থাকে। ঘুম ভেঙে গেলে / ভ্রুর নকশা জেঁকে বসে আনন্দঘন অনিদ্রার ওপর`।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ আগস্ট ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়