ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বড়ইতলার গণহত্যা, এখনো শিউরে ওঠে মানুষ

রুমন চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৪, ৪ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বড়ইতলার গণহত্যা, এখনো শিউরে ওঠে মানুষ

শহীদদের স্মরণে বড়ইতলায় নির্মিত স্মৃতিসৌধ

রুমন চক্রবর্তী, কিশোরগঞ্জ : বড়ইতলার গণহত্যার স্মৃতিচারণে এখনো শিউরে ওঠে মানুষ। একাত্তরের ১৩ অক্টোবর কিশোরগঞ্জের বড়ইতলায় রক্তের স্রোত নেমেছিল। এই গ্রামে পাক হানাদাররা স্থানীয় রাজাকারদের মদদে নির্মমভাবে হত্যা করে কয়েকশ’ গ্রামবাসীকে। বড়ইতলার স্মৃতিস্তম্ভ আজো স্মরণ করিয়ে দেয় ইতিহাসের নৃশংসতম ওই গণহত্যার কথা।

 

এখন যেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ হয়েছে তার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া রেললাইন ও আশপাশ এলাকায় চলে ইতিহাসের নির্মম ওই হত্যাযজ্ঞ। দেখা যায়, ওই সব শহীদের নাম সুউচ্চ দুটি স্তম্ভে পাথরে লেখা হলেও তা মুছে গেছে অনেক আগেই। মূল স্মৃতিসৌধটির অবস্থাও নাজুক। পাথরে লেখা শহীদদের নাম মুছে গেলেও, সেই বিভীষিকাময় দিনটির কথা মন থেকে মুছে যায়নি কারো। গণহত্যার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আজও আতঙ্কে শিউরে ওঠেন প্রত্যক্ষদর্শী ও নিহতের স্বজনরা। তারা বেঁচে আছেন সেই নৃশংস হত্যাযজ্ঞের স্মৃতি নিয়ে।

 

বড়ইতলা গ্রামটির অবস্থান কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলায়। হানাদাররা সেদিন একসঙ্গে হত্যা করেছিল ৩৬৫ জন নিরীহ মানুষকে। দেশের জন্য জীবন দিলেও, ওইসব হতভাগ্য লোকজন স্বাধীনতার এতবছর পরও, পাননি শহীদের মর্যাদা। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্বজনদেরও দেওয়া হয়নি কোনো সান্ত্বনা। শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হলেও অযত্ন-অবহেলায় সেটিও এখন জরাজীর্ণ।

 

যেভাবে গণহত্যা : সেই ১৩ অক্টোবর সকালে পাকসেনাদের একটি ট্রেন  এসে থামে বড়ইতলা গ্রামের কাছে। তারা এলাকাবাসীকে নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে প্রচার-প্রচারণামূলক একটি সভার আয়োজনের চেষ্টা করতে থাকে। তখন পথ হারিয়ে ফেলায় এক পাকসেনা দলছুট হয়ে পড়ে। সুযোগটি কাজে লাগিয়ে স্থানীয় রাজাকাররা গুজব রটিয়ে দেয়, গ্রামবাসীরা পাকসেনাকে গুম করেছে। এ খবরের সত্যতা যাচাই না করেই তারা পশুর হিংস্রতা নিয়ে গ্রামবাসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বড়ইতলা, চিকনিরচর ও দামপাড়াসহ আশপাশের এলাকার পাঁচ শতাধিক লোককে ধরে এনে কিশোরগঞ্জ-ভৈরব রেল লাইনের পাশে জড়ো করে তারা। এক পর্যায়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয় ৩৬৫ জনকে। এ সময় আহত হয় দেড় শতাধিক ব্যক্তি। পঙ্গুত্ব বরণ করে আরো অনেকে।

 

বর্তমান চিত্র : পুরো বড়ইতলা ও আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক গণকবর। প্রতিটি পরিবারই হারিয়েছে কোনো না কোনো স্বজনকে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় পূর্ব চিকনিরচর গ্রাম। এখানকার বহু মানুষকে হত্যা ছাড়াও জ্বালিয়ে দেওয়া হয় পুরো গ্রামটিকেই। কিন্তু স্মৃতিস্তম্ভে গণহত্যার শিকার লোকজনকে শহীদ উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে তাদের দেওয়া হয়নি শহীদের মর্যাদা। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে দেওয়া হয়নি কোনো ধরনের সহায়তা। এসব নিয়ে আক্ষেপ, ক্ষোভ ও হতাশার শেষ নেই এলাকাবাসীর। তারা গণহত্যায় মদদদাতা স্থানীয় রাজাকারদের বিচারও দাবি করেছেন।

 

গণহত্যা সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম : বড়ইতলায় ১৩ অক্টোবরে একসঙ্গে ৩৬৫ জনকে হত্যার ব্যাপারটি কিশোরগঞ্জের নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছেই অজানা। শুধু বড়ইতলা এলাকার কিছু সংখ্যক কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী এ ব্যাপারে জানলেও, গণহত্যা সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই তেমন কিছুই জানেন না। তারা জানে না, ওই দিন আসলে কি ঘটেছিল।

 

স্মৃতিসৌধের ফাটল ধরা স্থানের একটি চিত্র

 

সরকারি গুরুদয়াল কলেজের সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী নাসরিন আক্তার বলেন, ১৯৭১ সালে কিশোরগঞ্জে বড়ইতলা গ্রামে নৃংশসতম গণহত্যার কিছু কাহিনী আমি পত্র-পত্রিকায় পড়েছি। ১৩ অক্টোবর দিনটিকে বিশেষভাবে  পালন করা হয়। কিন্তু আমরা নতুন প্রজন্ম এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এ গণহত্যার ইতিহাস সম্পর্কে সঠিকভাবে জানাতে বই-পুস্তকে বা গল্পের বই আকারে প্রকাশ করে জানানো উচিত। ইতিহাসের এমন নৃশংস হত্যাযজ্ঞ  সম্পর্কে সারা পৃথিবীর মানুষের জানা উচিত।

 

কথা হয় স্মৃতিস্তম্ভের পাশের এলাকার একজন ক্ষুদে শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তার ভাষ্য, “এখানে বড় বড় পিলারে অনেক মাইনসের নাম আছে, কিন্তু হেরা কারা আমরা জানি না। আমরা বিকালে ওইখানে খেলাধুলা করি। তবে বছরে একবার এখানে শহরের লোকজন আইস্যা ফুল দেয়, মিটিং করে। তখন মুরুব্বীরারে জিগাইলে হেরা কয় আমরার গ্রামে নাকি মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক মাইনসেরে মাইরালছে, তাই শহরের মানুষ আইস্যা ফুল দেয়, মিটিং করে।”

 

স্বজনদের ক্ষোভ স্মৃতি কথা : গণহত্যায় স্বজন হারানো স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কালু মিয়া বলেন, ‘সাড়ে তিনশর বেশি মানুষকে নির্মমভাবে সেদিন হত্যা করা হলেও আজ পর্যন্ত সেই পরিবারগুলো শহীদ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। এখনো অনেক পরিবার নিঃস্ব অবস্থায় আছে। আমার মামা ও মামাতো ভাই এখানে শহীদ হয়েছে, আমাদেরকে শহীদ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছি।’

 

আরেক স্বজনহারা আব্দুর সাত্তার শহীদের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে জমি দিয়েছেন আর সেই জমির উপরেই দাঁড়িয়ে আছে বর্তমান স্মৃতিসৌধটি। আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘বর্তমানে সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে কিন্তু ইতিহাসের নৃশংসতম এ গণহত্যার পেছনে যে স্থানীয় রাজাকারদের ইন্ধন ছিল তাদের বিচারে কোনো উদ্যেগ নেওয়া হচ্ছে না।’

 

এই ব্যাপারে কিশোরগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. আসাদউল্লাহ বলেন, ‘আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করবো যেন স্মৃতিসৌধটি রক্ষণাবেক্ষণে এগিয়ে আসে। নাম ফলকে শহীদদের নামগুলোও মুছে যাচ্ছে। স্মৃতিসৌধটিতে বড় আকারের ফাটল দেখা দিয়েছে, যে কোনো সময় ধসে পড়তে পারে। খুব শিগগিরই যেন স্মৃতিসৌধটির মেরামত করা হয় সে ব্যাপারেও প্রশাসনের সঙ্গে আমি কথা বলব।’

 

 

রাইজিংবিডি/কিশোরগঞ্জ/ ৪ ডিসেম্বর ২০১৬/রুমন/টিপু/রুহুল

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়