ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

তুমি অধম বলিয়া আমি কি আরো অধম হইব?

সাইফুল আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২৫, ৩০ জুন ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তুমি অধম বলিয়া আমি কি আরো অধম হইব?

ফাইল ফটো

সাইফুল আহমেদ : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে নায়ক নবকুমারের একটি বিখ্যাত উক্তি রয়েছে। সেটি হলো, ‘তুমি অধম- তাই বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন?’

 

খুব চমৎকার কথা। এ ধরনের উক্তি আমাদের ভেতর যে দেবতূল্য গুণাবলি রয়েছে তা ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করে। কেউ আমাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করলেও তার প্রতি ভাল ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করে।

 

তবে আধুনিক ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এসব ধর্মের কাহিনী খুব একটা খাটে না। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে ‘অরিজিন অব স্পেসিস’ এর লেখক চার্লস ডারউইন ও ‘দাস ক্যাপিটাল’ এর লেখক কার্ল মার্ক্স ঈশ্বরকে গায়েব করে দিয়ে মানুষের শেষ আশ্রয়স্থলে যে ‘বিরাট শূন্যতা’র সৃষ্টি করেছেন, তা আজো মানুষ তাদের হৃদয়ে বয়ে বেড়াচ্ছে। অনেক তথাকথিত আধুনিক মানুষই ঈশ্বরকে সরিয়ে দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তার স্থলে অন্য কাউকে বসাতে পারেননি। সেই শূন্যতা মানুষের হৃদয়ে জন্ম দিয়েছে স্বার্থপরতা, বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতার। তাই কেউ অধমের মতো ব্যবহার করলে তার সঙ্গে উত্তম ব্যবহারের প্রত্যাশা করাটা একরকম বোকামিই। বর্তমানে অধিকাংশ মানুষই যারা খারাপ আচরণের শিকার হন, তাদের মনোভাবটা এমন, ‘তুমি অধম, তাই আমি উত্তম হইব কেন?’

 

সম্প্রতি ভারতে ‘মওকা, মওকা’ ভিডিও তৈরি এবং এ নিয়ে আমাদের প্রতিক্রিয়ায় তেমনটিই মনে হয়েছে।

 

গত বিশ্বকাপে স্টার স্পোর্টস টিভি চ্যানেল ‘মওকা, মওকা’ ভিডিও তৈরি করে। প্রথম ভিডিওতে পাকিস্তানকে খাটো করে দেখানো হয়। ভিডিওটির বিভিন্ন সিক্যুয়াল তৈরি করা হয়। বিশ্বকাপে ভারতের প্রতিটি ম্যাচের প্রতিপক্ষের আগে এসব সিক্যুয়াল প্রচার করা হয় স্টার স্পোর্টসে। এক পর্যায়ে একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সারা বিশ্ব একদিকে, ভারত আরেকদিকে হয়ে কাওয়ালিতে অংশ নিচ্ছে। স্টার স্পোর্টসের এই ‘মওকা, মওকা’ বিজ্ঞাপনের আদলে ভারতের কয়েকজন পরমত অসহিষ্ণু ব্যক্তি ইউটিউবে বাংলাদেশকে খাটো করে একটি ভিডিও প্রকাশ করে।

 

‘মওকা, মওকা’ ভিডিওটি নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। উল্লেখ্য যে, এ ভিডিও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তৈরি করেনি কিংবা এটির জন্য ভারতীয় ক্রিকেট দলকে কোনোভাবেই দায়ী করা যায় না। এ বিজ্ঞাপনের জন্য স্টার স্পোর্টসও ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। তবে বাংলাদেশকে খাটো করে যে ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে, তাতে তাদের কোনো হাত নেই।

 

তবে সাম্প্রতিক একটি বিষয়ে বেশ মর্মাহত হয়েছি। সেটি হলো, বাংলাদেশের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডে ম্যাচে ভারত দল যখন পরাজিত হয়ে মাঠ ছাড়ছিল, তখন স্টেডিয়ামে থাকা প্রায় ২০০ দর্শক তাদের লক্ষ্য করে হাত উঁচিয়ে টিজ করে বলতে থাকেন, ‘মওকা, মওকা।’ ভারতীয় দল দর্শকদের এমন ব্যবহারে উত্তেজিত না হয়ে মাথা নত করে মাঠ ছাড়ে। তবে এ ঘটনায় ভারতীয় দলের যতটা মাথা নত হয়েছে, কয়েকজন হঠকারী দর্শকের অপরিণামদর্শী ব্যবহারে জাতি হিসেবে আমাদের মাথা তার চেয়ে অনেক বেশি নত হয়েছে। হিন্দিতে একটি কথা আছে, ‘মেহমান ভগবান কি সমান হোতা হ্যায়,’ অর্থাৎ ‘মেহমান হলো ভগবানের সমান।’ সে হিসেবে, আমরা আমাদের মেহমানদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছি। জাতি হিসেবে এটি আমাদের জন্য লজ্জাজনক।

 

স্টার স্পোর্টস বিশ্বকাপ চলাকালে ‘মওকা, মওকা’ ভিডিও তৈরির মাধ্যমে অধমের মতো কাজ করেছে। তার প্রতিক্রিয়ায় অসভ্য কোনো আচরণ না করলেই আমরা ‘উত্তম’ হতাম। তবে ওই যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে গেছেন, ‘বিচিত্র বোধের এ জীবন, লক্ষ কোটি মন; একই বিশ্ব লক্ষ কোটি করে জানে, রূপে রসে নানা অনুমানে।’ বাংলাদেশের সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের মন সাড়ে ১৬ কোটি রকমের। সবার মানসিকতা এক হবে না, এটাই স্বাভাবিক। তবে আমার কথা হলো, ‘তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম না-ও হইতে পারি। তাই বলিয়া আমি কি আরো অধম হইব?’



 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ জুন ২০১৫/সাইফুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়