ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

নিয়ন্ত্রণহীন নিত্যপণ্যের বাজার

রিশিত খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০৩, ২ জুলাই ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নিয়ন্ত্রণহীন নিত্যপণ্যের বাজার

রিশিত খান : দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিষয়টি আবারও পত্রপত্রিকার শিরোনাম হয়ে আসছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো পত্রিকা, বেসরকারি টেলিভিশন কিংবা অনলাইন নিউজ পোর্টালসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে ছাপছে বাজার পরিস্থিতির অস্থিরতার খবর। নানামাত্রিক প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রকাশিত হচ্ছে সম্পাদকীয় এবং উপ-সম্পাদকীয়।

 

ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোতেও দেখানো হচ্ছে বাজার পরিস্থিতির সচিত্র প্রতিবেদন। এসব প্রতিবেদনে উঠে আসছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির নানা বিষয়।

 

বিশেষত পবিত্র রমজানে বেড়েই চলেছে নিত্যপণ্যের দাম। বিশেষ করে যেসব পণ্য রমজানে বেশি প্রয়োজন হয়- এমন পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। রমজানের দিন যত গড়াচ্ছে পণ্যের দাম যেন ততই বাড়ছে।

 

রমজান শুরুর দুই সপ্তাহ পর বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায় মূল্যবৃদ্ধির চিত্র। রমজান শুরুর আগে প্রতিটি পণ্যে ১০ থেকে ২৫ টাকা দাম বেড়ে গিয়েছিল। তার চেয়ে আরো ৫ থেকে ১৫ টাকা বেশি বেড়েছে। এই দাম বৃদ্ধি নিয়ে প্রতিনিয়ত একে অপরকে দুষছেন ব্যবসায়ীরা।

 

খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারি বাজারে দাম বেশি হওয়ায় বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি দামে। অন্যদিকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা সরকারের বেঁধে দেওয়া দরের চেয়ে বেশি নিচ্ছেন না বলে জানাচ্ছেন।

 

পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চিনির দাম মণপ্রতি ৫০ টাকা বেড়েছে। ডাল, গুড়োদুধ, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, ডিমসহ কাঁচাবাজারের বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর দাম প্রতিদিনই বাড়ছে।

 

নগরীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত সপ্তাহের তুলনায় কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়েছে। চাল, আটা, দুধ, মাছ, মুরগির দাম আরেক দফা বেড়েছে।

 

বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, ছোলা বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৬৫ থেকে ৭৫ টাকায়, মসুর ডাল ১২০ টাকায়, খেসারি ডাল ৬৫ টাকায়, তেল ৯৭ থেকে ১০২ টাকায়। চিনি ৪৫ টাকায়। খেজুর খোলা ১৫০ টাকা, আর মানভেদে প্যাকেট ২৫০ থেকে ৩৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

 

শান্তিনগর বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা চিনি পাইকারদের কাছ থেকে ৩৯ টাকায় কিনেছি। এখন ৪৫ টাকায় বিক্রি না করলে আমরা খাব কী?’ অন্যদিকে টিসিবি এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, চাহিদার চেয়ে পণ্যের মজুদ দ্বিগুণ আছে। ফলে দাম বাড়বে না।

 

বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মানুষের চাহিদার তুলনায় পণ্য যথেষ্ট পরিমাণ আছে। বাজারে কোনো সিন্ডিকেট নেই। ফলে পণ্যমূল্য মানুষের হাতের নাগালেই আছে। তবে মন্ত্রীর এই দাবির পর বাজারের চিত্র দেখা গেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

 

টিসিবির আমদানি বিভাগের কর্মকর্তা মো. হুমায়ূন কবির বলেন, রমজান উপলক্ষে প্রতিবছর আমাদের একটা লক্ষ্য থাকে, কী পরিমাণ পণ্য প্রয়োজন হবে? সেভাবে আমরা আমদানি করে থাকি। আর এটা করা হয় কয়েক বছরের পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে। সে অনুযায়ী আমাদের জোগান থাকে। এই বছর রমজান মাস সামনে রেখে আমাদের মজুদ আছে দ্বিগুণ পরিমাণ পণ্য। যে কারণে এবার টিসিবি সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে রাখতে পারছে পণ্যের দাম।

 

টিসিবি খোলা বাজারে বিক্রি করছে পণ্য। এ বছর খোলা বাজারে বিক্রির জন্য ৩ হাজার মেট্রিক টন তেল, দেড় হাজার মেট্রিক টন ছোলা, ১৫০ মেট্রিক টন খেজুর ও ২ হাজার মেট্রিক টন মসুর ডাল আমদানি করা হয়েছে। তিনি বলেন, টিসিবির নির্ধারিত বাজারদর হচ্ছে- কেজিপ্রতি মসুর ডাল ১০৩ টাকা,  সয়াবিন ৮৯ টাকা,  চিনি ৩৭ টাকা,  খেজুর ৮০ টাকা এবং ছোলা ৫৩ টাকা।

 

এর আগে টিসিবিতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী মাহে রমজান উপলক্ষে তেল ৯০ টাকা এবং চিনি ৩৮ থেকে ৪০ টাকার বেশি যাতে বিক্রি না করা হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক করেন খুচরা ব্যবসায়ীদের।

 

বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, বাজারে ব্যবসায়ীদের কাছে রমজান উপলক্ষে সব ধরনের পণ্য চাহিদার চেয়ে দেড় গুণ বেশি আছে। তা ছাড়া এখন কোনো হরতাল-অবরোধ নেই। ট্রাক ভাড়াও বেশি নয়। তাই দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

 

অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমানের একটি গবেষণা থেকে জানা গেছে, জোট সরকারের বিদায় লগ্নে রমজান মাসে জিনিসপত্রের দাম গত পাঁচ বছরের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, পণ্যের দাম বাড়ার নেপথ্যে ছিল জোটের প্রশ্রয়ে জন্ম নেওয়া ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। যা কিনা আবার একটি বিশেষ ভবন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ওই সিন্ডিকেট চক্রকে সন্তুষ্ট করতে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে ক্ষমতা থেকে সরকার বিদায় নিয়েছে।

 

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারের এ দুর্বিসহ অবস্থা দু’একদিনে সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়ানোর যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে তা থেকে দেশের সব পর্যায়ের ভোক্তা-ক্রেতা শ্রেণির যেন পরিত্রাণ নেই। নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের কাছে এখন বাজারে যাওয়া মানেই আতঙ্ক আর অস্থিরতা।

 

রমজান শুরুর আগেই সবকিছুতেই ১০ থেকে ২৫ টাকা বাড়িয়েছিলেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। এখন তার থেকে আরো একধাপ বাড়িয়েছেন সবজির দাম। বেগুন রমজান শুরুর এক সপ্তাহ আগেও ২৫-৩০ টাকা কেজি বিক্রি হতো। এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০-৭০ টাকায়। এ ছাড়া বেড়েছে পেঁয়াজ, মরিচ, আলু, ধনেপাতা, মরিচ, পেঁপে, শসাসহ সব ধরনের সবজির দাম। ধনেপাতা বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা কেজি। যা রমজান শুরুর আগে ৮০ থেকে বেড়ে ১৫০ টাকা হয়েছিল। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কেনা পড়ে বেশি, তাই বিক্রিও করতে হয় বেশি দামে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর নানা ক্ষেত্রেই বেশ কিছু ভালো কাজের নজির সৃষ্টি হয়েছে। ঘুষখোর দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, মজুদদারি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারিভাবে কোনো কার্যকর ব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল না দেশে।

 

এক সময় সরকারিভাবে পণ্য ডাইরেক্টরেটের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী মজুদের সময়সীমা দেখার নিয়ম ছিল। কিন্তু বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে অবাধ বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে ১৯৯৯ সালে সেই সংস্থাটি বিলুপ্ত করা হয়। এখন আমদানিকারক বা পাইকারি ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য গুদামে দীর্ঘকাল সংরক্ষণ করতেই পারে। মজুদদারদের এই একচ্ছত্র অধিকারে বাধা এসেছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে।

 

বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করার সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের যে দাম রেখে গিয়েছিল, সে দাম দ্বিগুণ করে বিদায় নেয় জোট সরকার। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের জুন মাস পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সময়কালে জিনিসপত্রের দাম এবং জোট সরকারের ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ এর অক্টোবর সময়কালে নিত্য ব্যবহার্য প্রতিটি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হারে রয়েছে বিশাল তফাৎ। জোট সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর গত পাঁচ বছরে প্রতিকেজি গরুর মাংসের দাম বেড়ে প্রায় চারগুণ হয়েছে।

 

২০০১ সালেও ৮০ টাকায় এক কেজি গরুর মাংস পাওয়া গেছে। কিন্তু এখন এই মাংস ক্রেতাদের কিনতে গুনতে হচ্ছে ৩৮০ টাকা। ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে আটার দাম ছিল ১২ টাকা। বর্তমানে সেই আটার দাম দাঁড়িয়েছে প্রতি কেজি ৩০ টাকা। ২০০১ সালে প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ২৮ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৪৫ টাকা। ২০০১ সালের অক্টোবরের দিকে প্রতি কেজি আলুর দাম ছিল ৮ টাকা। এখন সেই আলুর কেজি ২২ টাকা। ২০০১ সালে অক্টোবরে প্রতি কেজি গুড়োদুধের দাম ছিল ১৭০ টাকা। এখন যেই গুড়োদুধ বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৫০০ টাকায়।

 

একইভাবে সয়াবিন তেলের দাম প্রতি কেজি ৩৫ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০ টাকা। একইভাবে বেড়েছে বিভিন্ন ধরনের চাল, মসলা, শাকসবজিসহ বিভিন্ন ধরনের নিত্য ব্যবহার্য পণ্যসামগ্রীর দাম।

 

বাংলাদেশ কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশনের মূল্য তালিকা অনুযায়ী দেখা গেছে, গত ১০ বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দামই বেড়েছে। যেমন, পাঁচ বছরে বাজারে সব ধরনের চালের দামই অনেকাংশে বেড়েছে।

 

ক্যাবের অপর এক জরিপ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জোট সরকারের আমলে বাজার নিয়ন্ত্রণের কোনো অঙ্গীকারই তারা পূরণ করেনি। ২০০১ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছিল ৫ দশমিক ৪২ ভাগ আর দ্রব্যমূল্য বেড়েছিল ১ দশমিক ৪০ ভাগ। ২০০২ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৮ দশমিক ৫২ ভাগ আর দ্রব্যমূল্য বেড়েছে ৪ দশমিক ৭২ ভাগ।

 

২০০৩ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ১০ দশমিক ৪৮ ভাগ এবং দ্রব্যমূল্য বেড়েছে ৪ দশমিক ৮৪ ভাগ। ২০০৪ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ১ ভাগ এবং ৩ দশমিক ৪২ ভাগ। ২০০৫ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৯ দশমিক ৭৭ ভাগ এবং দ্রব্যমূল্য বেড়েছে ৬ দশমিক ৩২ ভাগ।

 

আর ২০০৬ সালে এ চিত্র আরো ভয়াবহ। এদিকে আমদানিকারক, পাইকারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের দাম চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের ওপর।

 

আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর বহু ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। মানুষ এসব পরিবর্তনকে স্বাগত জানাচ্ছে। মানুষ আশা করছে, বাজারে যে অরাজক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে- সেই জোট সরকারের পাঁচ বছরের কুশাসন থেকে, সেটা এবার দূর হবে। একটা নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। সিন্ডিকেটের কারসাজি বন্ধ হবে।

 

এ জন্য সরকারকে সতর্কভাবে গোটা পরিস্থিতি মনিটরিং করতে হবে এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ত্বরিৎ ব্যবস্থা নিতে হবে। জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চারের লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপের সঙ্গে বাজার নিয়ন্ত্রণেও সরকারের বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।

 

বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার সব ধরনের পদক্ষেপই নেবে। ক্রেতা-ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। এটা সরকারের নীতি নির্ধারকদের বুঝতে হবে। দেশবাসীর প্রত্যাশা  সেটাই।

 

তথ্যঋণ : রাইজিংবিডি

 

লেখক : জ্যেষ্ঠ গণমাধ্যমকর্মী

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ জুলাই ২০১৫/রিশিত/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়