ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০৯ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৬ ১৪৩১

পদ্মায় অভয়াশ্রমে ৫৫ প্রজাতির মাছের সন্ধান

তানজিমুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২৮, ১ জুলাই ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পদ্মায় অভয়াশ্রমে ৫৫ প্রজাতির মাছের সন্ধান

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী : বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হলেও দেশের নদী-নালাগুলো থেকে প্রতিনিয়তই দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

 

এ অবস্থায় দেশি মাছ রক্ষা ও এদের বংশ বিস্তারের লক্ষ্যে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পিরিজপুর এলাকায় পদ্মা নদীর কোলে সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে একটি মৎস্য অভয়াশ্রম। এতে অন্তত ৫৫ প্রজাতির প্রায় বিলুপ্ত দেশি মাছের সন্ধান মিলেছে।

 

জানা গেছে, শফিউল আলম মুক্তা নামের স্থানীয় এক যুবক নিজ উদ্যোগে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন এই অভয়াশ্রম। যদিও পদ্মার কোলে মাছের এই অভয়াশ্রম গড়ে তোলার কাজটি মোটেও সহজ ছিল না তার কাছে। তবে এই কঠিন কাজটিই জেলেদের বুঝিয়ে সহজ করে তুলেছেন তিনি।

 

পিরিজপুর গ্রামের পাশে শুষ্ক মৌসুমে আটকে যাওয়া পানিতে তিনি যে অভয়াশ্রম করেছেন, এখন সেখানে মিলছে দেশীয় নানা প্রজাতির প্রায় বিলুপ্ত মাছ। ৫০০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ২০০ মিটার প্রস্থের এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা এ আশ্রমে কিছুদিন আগেও জাল দিয়ে জেলেদের মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও বর্তমানে পদ্মায় পানি বৃদ্ধি শুরু হওয়ায় সে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে।

 

এখন জেলেরা পুরোদমে সেখানে নির্দিষ্ট আকারের মাছ ধরছেন। সেখানে পাওয়া যাচ্ছে পদ্মার বিলুপ্ত প্রায় ৫৫ প্রজাতির দামি মাছ। এসব মাছ ধরে এলাকার অনেক জেলের মুখে হাসি ফুটেছে। তবে নির্দিষ্ট আকারের চেয়ে মাছ ছোট হলে শর্ত মেনে সেসব মাছ জেলেরা আবারো পদ্মায় ছেড়ে দিচ্ছেন।

 

শুরুটা যেভাবে : পিরিজপুর মৎস্য অভয়ারণ্য গড়ে তোলার গল্পটা শোনালেন এর উদ্যেক্তা শফিউল আলম মুক্তা নিজেই। বলছিলেন, তার শৈশব-কৈশোরের দিনগুলোর কথা। সেসময় পদ্মায় যেমন সারা বছর পানি থাকতো তেমনি সারা বছর দেশীয় বহু প্রজাতির মাছও পাওয়া যেত। কিন্তু এক দশক আগে থেকে শুষ্ক মওসুমে পদ্মায় পানি কমে যাওয়ায় সেসব মাছ আর চোখে পড়ে না।

 

মুক্তা ভাবলেন, শুষ্ক মওসুমে পদ্মার কোলে যে পানি আটকে থাকে সেখানে কিছু দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ করতে পারলেই হয়তো মিলতে পারে দেশীয় প্রজাতির সেই হারিয়ে যাওয়া মাছ। আর এই ভাবনা থেকেই কাজের শুরু।

 

মুক্তা জানালেন, পদ্মার কোলে অভয়াশ্রমে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করতে গেলে স্থানীয় মৎস্য অধিপ্তরের অনুমতি প্রয়োজন। এজন্য জলাশয় নির্ধারণের পর ইন্টারনেট ঘেঁটে স্যাটেলাইটের তোলা ওই জলাশয়ের একটি ছবি সংগ্রহ করেন তিনি। প্রস্তুত করেন অভয়াশ্রমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের একটি খসড়াও। তারপর সেসব স্থানীয় মৎস্য অফিসার ও গোদাগাড়ীর ইউএনও’র কাছে জমা দেন। এরপর মৎস্য কর্মকর্তা ফারজানা হোসেন জলাশয় পরিদর্শন করে তাকে অভয়াশ্রম গড়ে তোলার অনুমতি দেন। অনুমতি পেয়ে মুক্তা স্থানীয় জেলেদের বুঝিয়ে সেখানে কয়েক মাসের জন্য মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেন। এভাবেই গড়ে ওঠে এই অভয়ারশ্রম।

 

ব্যয় সব মুক্তার : উদ্যেক্তা শফিউল আলম মুক্তা জানিয়েছেন, অভয়াশ্রম গড়ে তোলার কাজটি আর্থিক দিক বিবেচনায় তার জন্য সম্পূর্ণ অলাভজনক। এরপরেও এখন পর্যন্ত সেখানে তিনি প্রায় ৪১ হাজার টাকা ব্যয় করেছেন। জলাশয়ে বাঁশ ও গাছের ডালপালা ফেলে মাছের আবাসস্থল তৈরি এবং সংরক্ষণ বাবদ তার ওই অর্থ ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় মাত্র পাঁচ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছে স্থানীয় মৎস্য বিভাগ। তবে অভয়াশ্রম গড়ে তোলার শুরু থেকেই তাকে কারিগরিভাবে সহায়তা করেছে মৎস্য বিভাগ।

 

এখন মিলছে যে মাছ : পদ্মায় পানি কমে যাওয়ার পর থেকে বর্ষা মৌসুমের আগ পর্যন্ত অভয়াশ্রমে জেলেদের জাল দিয়ে মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিলো। তখন শুধুমাত্র হুইল অথবা বড়শি দিয়ে সৌখিন জেলেরা সেখানে মাছ ধরতে পারতেন। এতে গেল কয়েক মাসে অভয়াশ্রমে দেশীয় প্রজাতির মাছেরা যেমন নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছে তেমনি সেসব মাছের বংশ বিস্তারও ঘটেছে ব্যাপক। বর্তমানে স্থানীয় জেলেরা সেখানে জাল ফেলে পূর্ণবয়স্ক মাছ ধরার অনুমতি পেয়েছেন।

 

জেলেরা বলছেন, অভয়ারণ্য এর আশপাশে জাল ফেললেই চাপিলা, বৈচা, চাটুয়া, নাপতানি, চাঁদা, নামা চাঁদা, গোল চাঁদা, আইড়, গুলশা, পাবদা, দেশী পুটি, সরপুটি, তিত পুটি, মেনি, ভেদা, শিং, কৈ, টাকি, ফলি, চেলি, মলা, ঢেলা, কানপোনা, দারকিনা, বাচা, বাটা, রিটা, পিয়ালি, জয়া, খৈলশা, ছোট টেংরা, বড় টেংরা, বাতাশি, বড় বাইম, তারা বাইম, চিকরা বাইম, কুচিয়া, বেলে, রাণী, কাজলী, গুচি, লাচু, টাটকিনি, ভাংনা, গুতুম, কাকিলা, পিঠালি উড়োল, মাঘি, কালিবাউস, পাবদা, কাঁটা পাতাশি, বাসোট, রেওয়া, কুঁকড়ি, ড্যাড়কাসহ নাম না জানা অনেক প্রজাতির দেশীয় মাছের দেখা মিলছে।

 

স্থানীয় বাজারে প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির এসব মাছের দামও ভালো। এসব মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে ভালো আয়ও করছেন স্থানীয় জেলেরা।

 

নেই রাক্ষুসে মাছ : শফিউল আলম মুক্তা জানিয়েছেন, কয়েক প্রজাতির রাক্ষুসে মাছ আছে যেগুলো জলাশয়ের অন্যান্য ছোট ছোট আকারের মাছ খেয়ে সাবাড় করে ফেলে। এ জন্য জলাশয়টিকে অভয়াশ্রম ঘোষণার পর তিনি স্থানীয় ২২ জন জেলেকে নিয়ে সেখানে নিয়মিত জাল ফেলে চ্যাং, বোয়াল, গুজি আইড়, মাগুর, টাকি, শোল ও গজাড় মাছ ধরে ফেলতেন। ফলে এখন সেখানে এসব রাক্ষুসে মাছ পাওয়া যায় না বললেই চলে। এ জন্যই অভয়াশ্রমে এতো বেশি সংখ্যক বিলুপ্ত প্রজাতির মাছের দেখা মিলছে বলেও মন্তব্য করেন মুক্তা।

 

দরকার প্রশিক্ষণ ও সহায়তা : শফিউল আলম মুক্তা জানান, তিনি প্রথমবারের মতো এ ধরনের একটি অভয়ারণ্য গড়ে তোলার কাজ করলেও তিনি সফল। এরপরেও তিনিসহ স্থানীয় জেলেদের এ ব্যাপারে হাতেকলমে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। আগামী বছর স্থানীয় মৎস্য বিভাগ আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা নিয়ে তার পাশে দাঁড়ালে তিনি আরো বড় পরিসরে অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে পারবেন।

 

 

রাইজিংবিডি/রাজশাহী/১ জুলাই ২০১৫/তানজিমুল হক/রিশিত খান

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়