ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

মধুকবিরে করিনু স্মরণ এই নিশাতে

তাপস রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০৬, ২৮ জুন ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মধুকবিরে করিনু স্মরণ এই নিশাতে

তাপস রায়
‘তোমারে করিনু স্মরণ এই নিশাতে;
ভাবিনু তোমারই কথা কবিতা করে।
যেমনি ভেবেছো তুমি এ দেশের তরে;
হৃদয়ের উষ্ণ প্রণয় চেয়েছো দিতে।’

 

প্রায়ই ভাবি এ-ও কী সম্ভব! যখন ফিরে তাকাই তার জীবনপানে, আমার বিস্ময়বোধ বেড়ে যায়। মাত্র ৪৯ বছরের জীবন। অথচ ঘটনার ঘনঘটায় ঠাসা। ছাত্রজীবনেই অন্যরকম হয়ে উঠেছিলেন তিনি; স্বাধীনচেতা, উচ্চাভিলাষী। বড় কবি হবেন ছিল এমন স্বপ্ন। সব মিলিয়ে স্বপ্নতাড়িত এক যুবা। কিন্তু ছন্দপতন ঘটল সহসাই। বাবার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে চাইলেন না। ধর্ম পরিবর্তন করে খ্রিস্টান হলেন। দেশও ছাড়লেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। বিদেশেই পাতলেন সংসার। কবি প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু হলো ইংরেজিতে লেখালেখি। কিন্তু যে স্বপ্নে তিনি বিভোর তা টুটে গেল। ওদিকে শেতাঙ্গ স্ত্রী রেবেকার গর্ভে ততদিনে জন্ম নিয়েছে চার সন্তান। সংসারে অভাব, নিত্য অনটন। সেখান থেকে বুঝি পালিয়েই বাঁচলেন তিনি। বিচ্ছেদের পর কখনও আর খোঁজ নেননি রেবেকার।

 

বাবা-মা ততদিনে চিরশান্তির দেশে। এবার শুরু হলো সম্পত্তির অধিকার বুঝে নেয়ার যুদ্ধ। কিন্তু কাজটি সহজ হলো না। বাবা তাকে অনেক আগেই ত্যাজ্য করেছিলেন। এবার তিনি বাংলায় ফিরলেন। মানে বাংলায় লিখতে শুরু করলেন। স্বপ্ন বুঝি ফলতে শুরু করল। কিন্তু খেয়ালি জীবন অত খ্যাতি সইবে কেন? অভাব তখনও গলাগলি করে হাঁটছে। লেখালেখি ছেড়ে ব্যারিস্টার হতে চললেন বিলেত পানে। পরিচয় হলো হেনরিয়েটার সঙ্গে। বিয়ে ছাড়াই শুরু হলো সংসার। সে ঘরেও সন্তান হলো; পরপর তিনটি। কিন্তু শান্তি কোথায়? অর্থ সংকট পিছু ছাড়ল না। বিদ্যাসাগরের দারস্থ হলেন টাকা-পয়সার জন্য। এ নিয়ে তো অনেক গল্পও শোনা যায়। যাক সে কথা, তিনি ব্যারিস্টার হলেন। কিন্তু পসার জমল না। কলকাতায় কপর্দকশূন্য করুণ অবস্থায় মৃত্যু হলো তার। এই তো কবিজীবন!

 

আসলেই কী এত অল্প কথায় এই মহাজীবনের সবটা বলা হয়ে যায়। এ অসম্ভব। ‘মহাকবি’ যার অভিধা তার আরো অনেক বৈশিষ্ট্য আড়ালে রয়ে যায় বৈকি। কিন্তু তা পাঠকের অজানা নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি কবি ও নাট্যকার তিনি। বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। বাংলা ভাষায় সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দ তার হাতেই জীবন পেয়েছে। পাঠক এতক্ষণে ধরে ফেলেছেন তিনি কে? হ্যাঁ, তিনি মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

 

মধুসূদন দত্ত যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারটি সম্ভ্রান্ত, জাতিতে কায়স্থ। দিনটি ছিল ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি। বাবা রাজনারায়ণ বসু, মা জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি। মধুসূদনের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হয় মায়ের হাত ধরে। তেরো বছর বয়সে মাকে নিয়ে মধুসূদন কলকাতা আসেন। এখানে পড়াকালীন হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন ডি.এল. রিচার্ডসনের প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন। তিনিই প্রিয় ছাত্রের মনে কবি হয়ে ওঠার স্বপ্নবীজ বুনে দেন। মাত্র আঠারো বছর বয়সেই মহাকবি হওয়া ও বিলাত যাওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা মধুসূদনের মনে বদ্ধমূল হয়ে যায়। এর পরের ঘটনা কমবেশি সাহিত্যপ্রেমীদের জানা।

 

কবিজীবনের শুরুর দিকে মধুসূদন রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘রত্নাবলী’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করেন। এই কাজটি করতে গিয়ে তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যে উপযুক্ত নাটকের অভাব বোধ করেন। ফলে তিনি নাটক লিখতে শুরু করেন। যে কারণে মহাকবি হয়েও নাট্যকার হিসেবেই প্রথম বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে তার পদার্পণ। ‘শর্মিষ্ঠা` তার লেখা প্রথম নাটক। এটি বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক নাটকও বটে। এরপর একে একে ‘একেই কি বলে সভ্যতা` এবং `বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ` প্রহসন লেখেন। `পদ্মাবতী` তার পূর্ণাঙ্গ নাটক। এই নাটকেই তিনি প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন এবং এর ফলে তিনি বাংলা কাব্যকে ছন্দের বন্ধন থেকে মুক্তি দেন। এই সাফল্য তাকে ভীষণভাবে উৎসাহিত করে এবং এই ছন্দে একই বছর তিনি রচনা করেন ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’। ঠিক পরের বছর, ১৮৬১ সালে তিনি রচনা করেন তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’।এই কাব্য তাকে ‘মহাকবি’র মর্যাদা দিয়েছে। এখানে তিনি রাবণকে একজন দেশপ্রেমিক, বীরযোদ্ধারূপে বর্ণনা করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ভারতবাসীর চিরাচরিত বিশ্বাসের মূলে আঘাত হেনে প্রকৃত সত্য সন্ধান ও দেশপ্রেমের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বাংলা সাহিত্যে তা তুলনাহীন।

 

কাব্যসাহিত্যে মধুসূদন সব সময় নতুনত্বের ধারক। রামায়ণ উপজীব্য করে লেখা হলেও মেঘনাদবধ কাব্য সম্পূর্ণ মৌলিক। মধুসূদন এখানে আশ্চর্যরকম উজ্জ্বল কৃতিত্বের অধিকারী। তিনিই প্রথম পাশ্চাত্য সাহিত্যের আদর্শ বাংলা সাহিত্যে সার্থকভাবে প্রয়োগ করেন। মধুসূদনের কাব্যের নারীরা ঘরের হয়েও বিদ্রোহী। ভারতীয় নারীরা সেখান থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজে পান। তাদের মধ্যে যুগ যুগ ধরে যে বঞ্চনা, অবহেলা জমাট হয়ে আছে মধুসূদনের কাব্যের নারীরা এর বিরুদ্ধে আত্মসচেতন বলেই প্রতিয়মান হয়। তারা পুরুষের নিকট নিজেদের ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ এবং কামনা-বাসনা প্রকাশে হয়ে ওঠে প্রতিবাদী। তার ‘বীরাঙ্গনা’ পত্রকাব্যের নায়িকাদের দিকে তাকালে এ কথার সত্যতা উপলব্ধি করা যায়।

 

মধুসূদন কাব্যের বিষয় সংগ্রহ করেছিলেন প্রধানত সংস্কৃত কাব্য থেকে। কিন্তু এর সঙ্গে তিনি যুক্ত করেন পাশ্চাত্য সাহিত্যের রস। ফলে সমকালীন শিক্ষিত বাঙালির জীবনদর্শন ও রুচির ছাপ তাতে পাওয়া যায়। এবং এ ভাবেই তার হাত ধরে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। এ এক অনন্যসাধারণ প্রতিভা। জীবনে বহু কষ্ট সয়েছেন। রাজপুত্রের জীবন, সে জীবন কেটেছে দুঃখে-দারিদ্র্যে। অবহেলা সয়েছেন অবলীলায়। জাতি, সমাজ বিশেষ করে পরিবার; বাবার কাছ থেকেও তিরস্কার জুটেছে অবিরাম কিন্তু ভেঙে পড়েননি। আত্মমর্যাদা আবিষ্কারে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে দেশ ছেড়েছেন কিন্তু মনের গভীরে কোথাও প্রেম ছিল। সেই টানেই আবার ফিরে এসেছেন। শুধু তাই নয়, প্রতিভা দিয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন ‘মধুকবি’ নামে। শেষ জীবনটা যদিও মধুময় ছিল না। ঋণের দায়, অর্থাভাব, অসুস্থতা ইত্যাদি কারণে জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। শেষ জীবনে তিনি উত্তরপাড়ার জমিদারদের লাইব্রেরি ঘরে বসবাস করতেন। স্ত্রী হেনরিয়েটার মৃত্যুর তিনদিন পরে ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মধুকবির মৃত্যুদিনে আমাদের প্রণতি রইল।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ জুন ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়