ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছাড়া রাজনীতি সহজ হবে না

আবুল কাশেম চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০৬, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছাড়া রাজনীতি সহজ হবে না

আবুল কাশেম চৌধুরী : হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত বোমা ফাটালেন কেন বেগম জিয়া? যে বোমা আত্মঘাতি। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর মুখে এ কথা শোভা পায়? তিনি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামি হলেন কেন? এরকম বোমা ফাটিয়ে কী অর্জন করলেন তিনি? মিথ্যাচার করে রাজনীতিতে টিকে থাকা যায় কি?

 

গত ২৫ জানুয়ারি বিএনপি নেত্রীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা রুজু করা হয়েছে আদালতে, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করার কারণে। বেগম জিয়া গত ২১ ডিসেম্বর এই কুট চালটি দিয়েছিলেন। তিনি সফল হননি, আর সফল হওয়ার সম্ভাবনাও নেই কেননা, জনগণ তাঁর বক্তব্য গ্রহণ করেনি।

 

বিচারিক বিষয় নিয়ে কিছু বলা বা লেখা সমীচীন নয়। বিএনপি নেতাদের কথাবার্তা শুনলে হাসব না কাঁদব বুঝে উঠা যায় না। বিশেষ করে সিনিয়র অ্যাডভোকেট জনাব মাহবুব হোসেন যা বলেন তাতে কেউ কেউ বিভ্রান্ত হবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। জনাব মাহবুব হোসেনের বাসায় থেকে আমি ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ করেছি। তিনি সেদিন বঙ্গবন্ধুকে মুজিব ভাই বলে সম্বোধন করতেন। বর্তমানে খালেদা জিয়ার আঁচলে নিজের অবস্থান করে নিয়েছেন। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শেষ গভর্নর ডাক্তার আবদুল মালিক মল্লিকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ হয়ে কলোবারেটর আইনে আদালতে মামলা লড়েছিলেন। মাহবুব সাহেব স্বীয় রাজনীতির স্বার্থে খালেদা জিয়ার সঙ্গে একীভুত হয়ে গেছেন! যুদ্ধপরাধীদের অনুকূলে আদালতে মামলা লড়েন, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছেন! হায় বাংলাদেশের রাজনীতি!

 

অ্যাডভোকেট জনাব মাহবুব হোসেন যা বলেন তা শোনার পর অনেক মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়বেন। আদালত যদি রায় দেন বেগম জিয়া রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ করেননি এবং নির্দোষ তখন আর কিছু বলার থাকে না। তা হলে এত কথার প্রয়োজন কী? সারা দেশ তোলপাড় করার কি আছে? বেগম জিয়া কি আইনের ঊর্ধ্বে? আদালতে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে না? ভারত মাতা ইন্ধিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে এলাহাবাদ আদালতে মামলা হলে তিনি আদালতে হাজিরা দিয়েছিলেন, নিজের পাদুকা হাতে নিয়ে আদালত কক্ষে প্রবেশ করেছিলেন। অবনত মস্তকে বিচারকের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। খালেদা জিয়া কি আইন মানেন না? আদালত মানেন না? প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর কর্মকা- কি এ রকম হওয়া উচিৎ? নাগরিক হিসেবে সবাই সমান, সকলকে আইন মেনে চলতে হবে। আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আস্থাশীল হতে হবে সকল নাগরিককে। তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বলে আইন আদালত মানবেন না, তা কি সমীচীন? তিনি যদি আবার প্রধানমন্ত্রী হন দেশ চালাবেন কি করে? আইন/আদালত সততার সঙ্গে মোকাবিলা করা প্রত্যক নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।

 

বিএনপি নেতারা বলছেন, বেগম জিয়া শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সেটি কোন অপরাধ নয়। স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন, বঙ্গবন্ধুর কর্মকা- নিয়ে প্রশ্নের অবতারণা করেছেন তাও অপরাধ নয়। তা হলে অপরাধ কোনটি? চাকুরীরত কোন সামরিক কর্মকর্তা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন না- এ কথা ছোট শিশুও বোঝে, ১নং সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম সে কথা বলেছেন ১৯৭৪ সালে। শুধু বোঝেন না বিএনপি নেত্রী ও তার অনুসারীরা। বিএনপি নেত্রীর তার বক্তব্যে যে বিতর্ক তুলেছেন তা যদি রাষ্ট্রদ্রোহ না হয়ে থাকে তা হলে ১৯৯২ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্টিত গোলাম আযমের বিরুদ্ধে প্রতীকি বিচারকদের (২৪ জনের) বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া সরকার রষ্ট্রদ্রোহ মামলা  করেছিলেন কেন? সেটা কি আইনসিদ্ধ ছিল? জাহানারা ঈমামকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামি হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে কেন? গোলাম আযম গংদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছিলেন আর সে কারণে দেশের বরণ্য ব্যক্তিদের রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামি হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে কেন?

 

আমি গোলাম আযম বিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলাম। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বেগম জিয়া সরকার গঠন করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন। তাঁর সরকারের আমলে শাহরিয়ার কবির ও মুনতাসির মামুনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা রুজু করা হয়েছিলো। দুইজন বরণ্য ব্যাক্তি কি অপরাধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামি হয়েছিলেন? সে সব মামলা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়ে থাকলে আজ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হবে না কেন, দেশবাসী জানতে চায়। 

 

বেগম জিয়া পাকিস্তানকে খুশী করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী বিতর্কিত ও উসকানিমূলক বক্তব্য দেবেন, নানা ফন্দিফিকির করবেন তা রাষ্ট্রদ্রোহ হবে না কেন? খালেদা জিয়ার তো শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ ছিল আল্লাহ দরবারে যে, তিনি দুবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন সাধারণ নারী যিনি একজন মেজরের স্ত্রী হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন! বেগম জিয়ার আর কি চাওয়া পাওয়া থাকতে পারে? বিএনপি নেতারা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে ধরাকে সরা জ্ঞান করেছেন, গণতান্ত্রিক সুশাসনের বদলে অপশাসন চালিয়েছেন। বেগম জিয়াসহ বিএনপি নেতারা যা পাচ্ছেন তা তাঁদের প্রাপ্য ছাড়া আর কিছু নয়।

 

গয়েশ্বর রায় মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের গুণে গুণে হিসাব করে নাম ঠিকানা সংবাদপত্রে প্রকাশ করার দাবী করেছেন। এখন প্রশ্ন করতে হয়, জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে ছয় বছর দেশ শাসন করেছেন, পরে বেগম জিয়াও দুবারে ১০ দশ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। অথচ ক্ষমতায় থাকাকালে তারা কেউই এই বিতর্কের অবতারনা করেন নি এবং শহীদদের তালিকা তৈরী করেন নি, কেন?

 

স্ববিরোধীতার রাজনীতি কাকে বলে? ক্ষমতায় থাকাকালে সেটা না করে আজ একটা স্পর্শকাতর ইস্যুতে বিতর্কের অবতারণা করছেন কেন?

 

আমি প্রায় সময়ই গ্রামে নিজ বাড়িতে যাই এবং নতুন প্রজম্মের সঙ্গে মিশি ও কথা বলি। গতবছর ডিসেম্বরে এলাকার নতুন প্রজম্মের সন্তানেরা আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনতে চাইলো। আমি কথা বলছিলাম আর তার মধ্যে এক যুবক আমাকে প্রশ্ন করলো, বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা সম্পর্কে। আমি তাদেরকে উদাহরণ দিয়ে বললাম, আমরা সবাই ভাত খাই। ভাত খেতে হলে চাল উৎপাদন করতে হবে, চাল পেতে হলে ধান চাষ করতে হবে, চাষ করতে হলে ধানের জমিকে চাষ উপযোগী করে বীজ বুনতে হবে। বিজ থেকে চারা হবে, চারা রোপন করতে হবে, এরপর ধান হবে, ধান পাকলে কেটে এনে মাড়াতে ও শুকাতে হবে, চাল করে চুলোতে উঠাতে হবে, আগুন জ্বেলে রান্না করতে হবে, তার পর রান্না করা ভাত খাওয়া যাবে। মুক্তিযোদ্ধারা ছিল শুধু লাকড়ি আর পানি, উল্লেখিত সব কাজ বঙ্গবন্ধু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হলেন মূল নেতা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের রূপকার ও কারিগড়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত প্রবাসী সরকারের অধীনে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছে।

 

স্ববিরোধীতার রাজনীতি কাকে বলে? একটা কথা সবাইকে মনে রাখতে হবে একবার যদি কেউ রাজাকার হয় সে সর্বদা রাজাকার। ২০০২ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে বেগম জিয়ার সরকার। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রথম প্রতিমন্ত্রী ছিলেন অমুক্তিযোদ্ধা। দ্বিতীয় প্রতিমন্ত্রী রাজাকার ছিলেন (তিনি মন্ত্রী থাকাকালে মুক্তিযোদ্ধা বনে যান এবং বর্তমানে নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা গ্রহণ করে চলেছেন)। সে সময় তারা দলীয় নেতা কর্মীদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে সনদ দিয়ে সম্মানী ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছেন।

 

আজ কাদের মোল্লা, সাকা চৌধুরীর মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়ার পর পাকিস্তান সরকার যখন এই যুদ্ধাপরাধীদের জন্য মায়া কান্না করছে, তখন বেগম জিয়া ও তার সমর্থকরা কেন এ ধরনের অনভিপ্রেত কথা বলছেন? দেশপ্রেমিক বাঙালীর কাছে বেগম জিয়ার বক্তব্য জলের মত পরিষ্কার। মুক্তিযুদ্ধকে সম্মান না করে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ না করে কথা বললে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে যথাযথ মূল্যায়ন করা না হলে এবং মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা না হলে এ দেশে রাজনীতি করা সহজ হবে না- এটাই বাস্তবতা।

 

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও কলামিস্ট। প্রতিষ্ঠাতা/প্রাক্তন সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল।

 

বিশেষ দ্রষ্টব্য : উল্লেখিত অভিমত সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়