ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

শিশু নির্যাতন: সাম্প্রতিক ভয়াবহতা ও আমাদের দায়বদ্ধতা

নিশাত তাসনীম, নাজিয়া মোশারফ মিম, তাসনুভা ইয়াসমিন, পূর্ণ কুমার কোচ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩০, ২৬ মে ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শিশু নির্যাতন: সাম্প্রতিক ভয়াবহতা ও আমাদের দায়বদ্ধতা

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হুমকির মুখে বাংলাদেশের অস্তিত্ব। পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে সবাই যখন সোচ্চার তখন এই দেশের মানুষ ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা কতোটা ভাবছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। গত তিন বছরে ঘটেছে ৮৭৬ জন শিশু হত্যার ঘটনা। নৃশংস এই ঘটনাগুলো মানুষকে নিজের বিবেকের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।

 

১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ শিশু আইন পরিবর্তিত হলেও পরিবর্তন আসেনি শিশুদের প্রতি আচরণের। একের পর এক শিশু হত্যা, অপহরণ, উত্যক্তকরণ ও সামাজিক মাধ্যমে হয়রানি বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছর জানুয়ারি-মার্চ মাসে ৭৫ জন শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এই পরিসংখ্যানে উল্লেখিত চিত্রে দেখা যায় ২০১২ সালে ২০৯ জন, ২০১৩ সালে ২১৮ জন, ২০১৪ সালে ৩৬৬ জন এবং ২০১৫ সালে ২৯২ জন শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে। হত্যাকাণ্ডের ধরণগুলোর মধ্যে রয়েছে ধর্ষণ, অপহরণ, রাজনৈতিক সহিংসতা, পিটিয়ে হত্যা, বাবা-মায়ের দ্বারা হত্যা, নির্যাতন প্রভৃতি।

 

গতবছর ৮ জুলাই সিলেটে নির্মম পিটুনির শিকার হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সবজিবিক্রেতা কিশোর শেখ সামিউল আলম রাজন (১৪)। সেই নির্মমতার ভিডিওচিত্রও প্রকাশিত হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ৮ নভেম্বর, ২০১৫ এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মামলায় ৪ জনের ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। একই বছর ৩ আগস্ট খুলনার গ্যারেজকর্মী রাকিব (১২) তার গ্যারেজমালিকের নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করে। এই হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতার বিবরণ পড়ে শিউরে ওঠে দেশবাসী। এবছর ২৭ জানুয়ারি, ইমরান ও শাকিল নামের দুই শিশুকে অপহরণ করে অপহরণকারীরা। মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করা হয় ১ লক্ষ টাকা। অপহরণের দুইদিন পর হত্যা করা হয় এই দুই শিশুকে। রাজধানীর বনশ্রীতে নিজ শিশুসন্তানকে হত্যা করে শিশুসন্তানদ্বয়ের জন্মদাত্রী মা। জাতীয় দলের ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেন এবং তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে গৃহকর্মীকে নির্যাতনের অভিযোগের কথাও আমাদের অজানা নয়।

 

শুধু হত্যা, অপহরণ ও নির্যাতন নয়, ধর্ষণ করে খুনের ঘটনাও নেহাৎ কম নয়। এছাড়া মেয়েশিশুদের উত্যক্ত করা এবং হয়রানি করে তার ভিডিওচিত্র সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। এর ফলে তারা সামাজিকভাবে অপমানিত ও অপদস্ত হচ্ছে, যা অনেকসময় তাদের আত্মহত্যায় প্ররোচিত করছে। এমনকি বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় প্রাণ হারাতে হচ্ছে অনেক কিশোরীকে। গতবছরের শুরুতে রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৫ জন শিশু প্রাণ হারায় বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম।

 

প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে একের পর এক শিশু নির্যাতন ও প্রাণহানির ঘটনা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ঘটনার বাইরেও এই বিপর্যয়ের চিত্র বিস্তৃত। শিশু অধিকার সংরক্ষণ ও শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ নিশ্চিত করতে ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘের ১৯১টি দেশের সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছিল ‘জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ’। এই সনদ অনুযায়ী জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত সকল দেশ সনদের বিধানাবলী বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধ। এই সনদের অনুচ্ছেদ ২৬(১) এ বলা হয়েছে, ‘অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্র শিশুর সামাজিক বীমা সুবিধাসহ সামাজিক নিরাপত্তা থেকে সুবিধা পাবার অধিকারকে স্বীকৃতি দেবে এবং এই বিষয়টি কার্যকর করার জন্য নিজ দেশের আইন অনুসারে পূর্ণ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নেবে।’ অনুচ্ছেদ ৩২(১) এ বলা হয়েছে, ‘অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রসমূহ অর্থনৈতিক শোষণ থেকে শিশুর অধিকারকে রক্ষা করবে। স্বাস্থ্য অথবা শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক, সামাজিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর অথবা শিশুর শিক্ষার ব্যাঘাত ঘটায় অথবা বিপদ আশঙ্কা করে এমন কাজ যেন না হয় তার ব্যবস্থা নেবে।’ এ থেকে বোঝা যায় শিশুর অধিকার সংরক্ষণে পিতামাতার পাশাপাশি রাষ্ট্রের দায়িত্বও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে।

 

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের প্রতিফলনে ‘বাংলাদেশ শিশু আইন ২০১৩’ বাস্তবায়িত হয়। এই আইনানুযায়ী প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় শিশু বোর্ড ও শিশু ডেস্ক গঠন এবং শিশুদের অধিকার সুরক্ষিত রাখার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে তার বাস্তবায়ন আজও সম্ভব হয়নি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে শিশু অধিকার লঙ্ঘনের চিত্র গণমাধ্যমে বেশ গুরুত্বের সাথে উঠে আসায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে অপহৃত শিশুদের উদ্ধারের সংখ্যাও বেড়েছে।

 

শিশু অধিকার লংঘনের পেছনের কারণ হিসেবে সামাজিক অস্থিরতা, মানবিক বিপর্যয়, দাম্পত্য কলহ, পারিবারিক বিরোধ, ব্যবসায়িক শত্রুতা ও আরো বিভিন্ন বিষয় জড়িত। শিশুদের কেবল মৌলিক চাহিদা পূরণ করলেই পিতামাতা বা রাষ্ট্রের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আমাদের উচিত তাদেরকে পৃথক সত্তা হিসেবে গুরুত্ব প্রদান করা এবং তাদের মতামতের প্রতি সম্মান দেখানো। সমাজের মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রতিকারবিধানের পাশাপাশি বিবেকবোধকে জাগ্রত করা আজ সময়ের দাবি। যে শিশুটির হাত ধরে চলবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ, সেই শিশুটির হারিয়ে যাওয়া আত্মধ্বংসের পথে এগিয়ে যাওয়ারই নামান্তর। আমাদের অবহেলায় যদি শৈশবেই হারিয়ে যায় এই কোমলপ্রাণ শিশুগুলো তবে তার দায়ভার আমাদেরকেই বহন করতে হবে। সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখায় যে শিশু সে যেন তার অধিকার নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে এবং এগিয়ে যেতে পারে পূর্ণবিকাশের পথে, তার দায়িত্ব নিতে হবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকেই।

 

লেখক : নিশাত তাসনীম, নাজিয়া মোশারফ মিম, তাসনুভা ইয়াসমিন, পূর্ণ কুমার কোচ।

শিক্ষার্থী, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ মে ২০১৬/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়