ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

আত্মজৈবনিক : বিবর্তন এবং আমার বন্ধু হারানোর গল্প (এক)

কমল কর্মকার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ২৮ মে ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আত্মজৈবনিক : বিবর্তন এবং আমার বন্ধু হারানোর গল্প (এক)

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

কমল কর্মকার

আমাদের একটি গ্রাম ছিল- সোঁদা মাটির গন্ধে ভরা একটি সরল সবুজ গ্রাম। সে গ্রামে ছিল অসংখ্য পুকুর আর সার সার বৃক্ষ। একটু দূরেই প্রায় শান্ত ঘোলা জলের ধলেশ্বরী। বাড়ির পাশ দিয়েই শীর্ণ অথচ দীর্ঘ নয়ানীর খাল। বল্লাল কি লক্ষ্মণ সেনের আমলে যখন বিক্রমপুরে মহাবিক্রমে তাঁদের রাজধানী স্থাপিত হয়, তখন কোনো একসময় ভরা বর্ষায় এ খাল দিয়ে নয়টি সিন্ধুক কি মটকি, যাতে ভরা থাকত সোনা, রুপা আর হীরা-মুক্তা-জহরত- ভেসে যেত। সবশেষে যেত বৈঠাবিহীন সোনার নাও, যা ‘পবনের বৈঠা’য় চলত। সে নৌকার কোনো মাঝি থাকত না। পবনের বৈঠায় আপনিই ভেসে যেত নৌকা। অনেকেরই মুখে মুখে সেই গল্প বেঁচে ছিল অনেক কাল, এমনকি আমার মায়ের মুখেও।

সে গ্রামে ছিল ছায়াময় দুপুর আর সদ্য ঘুমভাঙা কাকলিতে ভরা সবুজ আলোর সকাল। বর্ষায় অনাদরে বেড়ে ওঠা কচুখেতে ব্যাঙের গ্যাঁ-গোঁ ডাকাডাকি আর টিনের চালে বৃষ্টির একটানা ঝুমঝুম, টাপটুপ শব্দে নিদ্রাতুর হয়ে কিংবা বাদলা বিকেলে ভিজে-নেয়ে দুহাতের মুঠোয় কদম ফুলের হলুদ আর মুক্তোসাদা ভালোবাসা মেখে উদ্বেলিত হতে হতে আমরা বেড়ে উঠছিলাম। শীতের পাতাঝরা নগ্ন বৃক্ষের শরীর ছুঁয়ে, ধুলোবালি গায়ে মেখে পৌষের ফালতু আড্ডাময় দুপুরের রোদে পিঠ ঠেকিয়ে আমরা কতিপয় গ্রাম্য বালক বেশ জমিয়ে তুলতাম কোনো কোনো দিন। কখনো-বা সুনসান দুপুরে একাকী অর্থহীন হাঁটাহাঁটি করতাম। সঙ্গীহীনতার শূন্যতা হা হা করে বুকের মাঝে বেজে উঠত। হেমন্তের শেষভাগে বিকেলের কুয়াশার চাদরমোড়া হিমে ঈষৎ বেদনা জাগত বুকে। শরতে আকাশে ভেসে যাওয়া সাদা গুচ্ছ মেঘের মতোই ধলেশ্বরীর পাড়ে জেগে ওঠা পলল এক টুকরো চরে তুলট কাশফুল থরে থরে ফুটে থাকত। আমরা বালকেরা কাশফুলের মুগ্ধতার তুমুল টানে ছুটে যেতাম। তখন দুর্গাপূজার ঢাক বুকের ভেতরে গুড়গুড় বেজে উঠত। নতুন জামার গন্ধ বুক ভরে নিতে নিতে হারিয়ে যেতাম আনন্দের কাটাল স্রোতের অতল গহ্বরে।

গ্রীষ্মের খাঁ-খাঁ দুপুরে আমরা আমগাছের নিচে পাটি পেতে বসে থাকতাম আর টুপ করে ঝরে যাওয়া আম কুড়াতাম। কখনো কখনো প্রচণ্ড গরমে হাতে তালপাখা নিয়ে অলস ভঙ্গিতে গাছের ছায়ায় শীতল পাটিতে শুয়ে থাকত বাবা। তার গা ঘেঁষে ঘামের গন্ধে আদর খুঁজে বেড়াতাম। নিশ্চল গাছের ডালপালা একটু নড়ে উঠলে বাবার মুখ স্মিতহাস্যে ভরে উঠত, আর সে হাসির ছোঁয়াতেই বুঝি একরাশ শীতল বাতাস এসে জুড়িয়ে দিয়ে যেত আমাদের স্বেদসিক্ত তপ্ত শরীর। এভাবে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত আর বসন্তের ঐশ্বর্যে ভাসতে ভাসতে কাটছিল আমাদের শৈশব।

এমনই এক দিনে কিশোর সকালে আমার পরিচয় হয়েছিল তার সঙ্গে। কোনো এক সদ্যোজাত সকালে বিলাতি গাবগাছতলায় মল্লযুদ্ধে মেতেছিলাম আমরা। কোনো অর্থহীন খুচরো খুনসুটিই হয়তো ছিল এর উৎস। সে কোনো বালিকা নয়। বালিকা বিষয়টি তখনো মনে বিশেষ কোনো ছায়া ফেলেনি। মেয়েমানুষ তখন মগজের কোষে অভিশপ্ত অহল্যার মতো বন্দি পাষাণ। রামচন্দ্রের পদস্পর্শে তখনো প্রাণ পায়নি অহল্যা- মানে রমণী- মানে মেয়েমানুষ। তবে যেকোনো মেয়ের মুখাবয়ব সুশ্রী হলেই আকর্ষিত হতাম। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম আর রঙিন স্বপ্নের জাল বুনে চলতাম। কখনো-বা আনমনে অপলক চেয়েই থাকতাম সেই বালিকা বা রমণীর মুখপানে। পৃথুলা কিংবা কৃশকায় যেমনই হোক না কেন, মুখাবয়ব সুন্দর হলেই আপন মনের সুষমারেণুতে মাখামাখি হতো আমার দুচোখ। গায়ের রঙের তারতম্য- ফরসা আর কালোর পার্থক্য ছিল অবোধ্য। যে মুখাকৃতি সুন্দর, তা কালো হলেই কী আর ফরসা হলেই-বা কী? আমার এই রমণীয় যৌনানুভূতিহীন সরল সৌন্দর্যপানে বাধা পড়ত কদাচিৎ, যখন আমার অবলোকিত সেই নারীর চোখে ধরা পড়তাম, লজ্জায় মিইয়ে যেতাম তখন- নুইয়ে পড়তাম মাটির ধুলার সঙ্গে।

বাড়ির পাশে একচিলতে বাগানে অযত্নে বেড়ে ওঠা জঙ্গলে কয়েকটি বিলাতি গাবগাছ ছিল আমার মতো অর্বাচীন বালকের বিপুল সম্পদ, যা আর কোনো বালকের উত্তরাধিকারে ছিল না। সে গাছে ভূতেরা বাসা বেঁধে থাকত। অমাবস্যার নিকষ কালোয় যখন আকাশের তারা ঢেকে যেত, তখন ভূতেরা সে গাছের ডালপাতায় নাচানাচি করত। সেই ভূতেরাই সম্ভবত আমাদের দুজনকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। পরিচয়টা হয়েছিল এপাড়া-ওপাড়ার শিশুতোষ ঝগড়ায়, যা পরে মল্লযুদ্ধে রূপ নিয়েছিল।

মল্লযুদ্ধের খানিক পরেই পোকাসদৃশ স্বাস্থ্যাধিকারী দুজন মনে মনে কামনা করছিলাম- কেউ এসে আমাদের ছাড়িয়ে নিয়ে যাক। ছাড়িয়ে হয়তো নিত কেউ-না-কেউ কিন্তু বিপত্তি ঘটাল হঠাৎ বৃষ্টি। স্বভাবতই আমাদের সঙ্গীরা যে যার মতো চারদিকের বাড়িঘরের চালের আচ্ছাদনে উধাও হলো। এদিকে মল্লযুদ্ধরত আমাদের হাফপ্যান্টের নিচে কৃশকায় চারখানা পা ক্লান্তি আর উত্তেজনায় টলটলায়মান। মনস্থির করতে পারছিলাম না- দৌড়ে পালাব, নাকি যুদ্ধ চালিয়ে যাব। মল্লযুদ্ধে হেরে গেলেও চলবে না, পাড়ার ইজ্জত বলে কথা! মূলত ইজ্জত রক্ষা করতেই কেউ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে পারছিলাম না। যদি কেউ মিটিয়ে দিত আমাদের এই অর্থহীন মারামারি, যদি গাবগাছের ভূতেরা হঠাৎ কোনো ফন্দি এঁটে আপস করে দিয়ে যেত!
ভূতদের অসীম ক্ষমতার কথা বড়দের মুখে অনেক শোনা। রাতের বেলা গাবগাছের ডাল নড়ে উঠলেই বুকে থুতু দিয়ে জপমন্ত্র আওড়াতাম-

ভূত আমার পুত, পেতনি আমার ঝি
রাম-লক্ষ্মণ সাথে আছে করবে আমায় কী?

মা বলত, রামনাম জপলে ভূত-পেতনি, দৈত্য-দানো কাছে ঘেঁষতে পারে না। যেদিন আগুনের গোলার মতো দানোটা আমাদের ঘরটা পার হয়ে যাচ্ছিল শোঁ-শোঁ আওয়াজ করে, আর ঘরটা কোনো রকম ঝড়তুফান ছাড়াই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে গেল, সেদিন আমার মা রামনাম জপ করেছিল কি না, জানা হয়নি। এ জীবনে আর জানাও হবে না। মা তো চলে গেছে নক্ষত্রের দেশে, আর তো ফিরে আসবে না কোনো দিন।

তখন আমি খুবই ছোট। সেদিন পরিবারের সবাই বিছানায় ঘুমানোর আয়োজনে ব্যস্ত ছিল। আমি তো ঘুমে কাদা। সর্বংসহা মা প্রতিদিনের মতো যথানিয়মে সবার খাওয়া শেষে খেতে বসেছে। খাবার ঘরে দক্ষিণের জানালা খোলা ছিল। জানালায় চোখ মেললে সবুজ খোলা মাঠ। সে রাত জ্যোৎস্নামাখা ছিল কি না, নাকি অমানিশার অন্ধকারে ঢাকা পড়েছিল সবুজ প্রান্তর- জানা হয়নি, মায়ের কাছেও জানতে চাইনি কোনো দিন। আকাশে বিমান ওড়ার মতো আওয়াজ শুনে জানালা দিয়ে মা তাকিয়ে দেখে, হাওয়াই জাহাজ নয়, আগুনের মতো গোলাকৃতি একটা পিণ্ড ধেয়ে আসছে আমাদের টিনের ঘরের ওপর দিয়ে। আগুনের গোলাটা পার হওয়ার পরই ভেঙে পড়ল আমাদের ঘর। কিন্তু কোনো জীবনহানি ঘটল না আমাদের, এমনকি আহতও হলো না কেউ। পেছন-বারান্দা-ঘেঁষা কাঁচামিঠা চারা আমগাছটা ভাঙা ঘরের সমস্ত ভার নিজের শরীরে নিয়ে আগলে রাখল আমাদের সবাইকে। পরদিন বাবার কোলে উঠে ক্ষয়ক্ষতি পর্যবেক্ষণ করা হলো। বিস্ফারিত চেখে দেখলাম, দোমড়ানো সদ্য পাকা কলার কাদি চাপ লেগে গলে গেছে প্রায়! সেটা ছিল আমাদের নিজেদের বাগানের কলা। আমার সাধারণ মানের বাবার কোনো চাষাবাদের জমিজমা ছিল না, কিন্তু অদম্য শখ ছিল কলাবাগান করার। সেই বাগানের গাছপাকা কলার এহেন দুর্দশা দেখে আমার মনটা খারাপ হয়েছিল কি না, তা মনে নেই। তবে দুধ-কলা মাখা ভাত ছিল আমার ভীষণ প্রিয়।

পাড়ার সবাই দেখতে এল এই আশ্চর্য কাণ্ড! তারা আমাদের অবস্থা দেখে আফসোস করল। সবাই মতামত জানাল এটা ‘দেও’-এরই কাণ্ড। তখন আমাদের পাড়ায় কেউ ‘সসার’ জাতীয় শব্দই শোনে নাই, ধারণা  তো দূরের কথা। কোনো ঝড়-তুফান ছাড়া আমাদের ঘর ভেঙে যাওয়ায় গ্রামে সাড়া পড়ে গেল! টিনের চাল নাকি ঘুমন্ত বাবার গলার এক হাত দূরত্বে এসেই আর অগ্রসর হতে পারেনি, থেমে গিয়েছিল, পেছন-বারান্দার কাঁচামিঠে আমগাছের কল্যাণে। সেই থেকে ওই আমগাছটা ছিল আমাদের সবার ভীষণ প্রিয়, আমাদের পরিবারেরই একজন। পাড়ার সবার মুখে মুখে এ গাছের ফলের বেশ সুনাম রটে বেড়াত। এ গাছের আম ছিল কাঁচা খেতে মিঠে স্বাদে ভরা, আর ছিল সুগন্ধ। তাই আমাদের জীবন রক্ষাকারী ওই গাছের নাম হয়ে যায় কাঁচামিঠা গাছ।

মায়ের কাছে অনেক বার আমাদের এই ঘর ভাঙার গল্প শুনেছি। মা বলত, ‘ঐটা আছিল দেও।’
আমি বলতাম, ‘দেও আমাগো ঘর ভাঙল কেন, মা?’
‘কে জানে! দেও-দত্যির মনে কী আছিলো! ওগো মনের কথা কি কইতে পারি, বাবা? হয়তো আরো বড়ো কোনো বিপদ হইতে পারতো! হেই বিপদ থেইক্কা বাঁচাইছে আমাগো।’
দেও বা দৈত্যির প্রতি অনুযোগহীন বরং কিছুটা ভয় ও শ্রদ্ধা মেশানো মায়ের কথায় অন্যমনস্ক হয়ে যেতাম মাঝে মাঝে। সন্ধ্যার পিদিম-জ্বলা-আলোয় মাটির মেঝেতে পাতা বস্তা-কাটা চটের ওপর থেকে কখনো বা শাঁই করে উধাও হয়ে যেতাম আকাশে- মেঘের আড়ালে, যেখানে পরির দেশ- পরিরা থাকে, নাচে-গায়, গাছে গাছে ফুল ফোটায়।   (চলবে)



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ মে ২০১৫/তাপস রায়

 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়