ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

২১৬ কোটি টাকার তথ্যে আল-আরাফা ও সোস্যাল ব্যাংকের গড়িমসি

এম এ রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ৬ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
২১৬ কোটি টাকার তথ্যে আল-আরাফা ও সোস্যাল ব্যাংকের গড়িমসি

আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ও দুদকের লোগো

এম এ রহমান : আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের বিরুদ্ধে তথ্য না দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

পণ্য আমদানির নামে দুবাইয়ে প্রায় ২১৬ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ঢাকা ব্যাংকের কাছে নথিপত্র চায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু ব্যাংকিং আইনের অজুহাত তুলে আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকে কর্তৃপক্ষ দুদককে কোনো তথ্য সরবরাহ করেনি। তবে তথ্য সরবরাহ করেছে ঢাকা ব্যাংক। দুদকের একটি সূত্র বিষয়টি রাইজিংবিডিকে নিশ্চিত করেছে।

রাসায়নিক পণ্য ও খাদ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স ফয়েজ উদ্দিন অ্যান্ড কোম্পানির বিরুদ্ধে ওই অর্থপাচারের অভিযোগ উঠে। আর এ সংক্রান্ত নথিপত্র তলব করে চলতি বছরের ১৬ আগস্ট চিঠি দেয়। পরবর্তী সময়ে সেপ্টেম্বরে আরো একবার তাগিদপত্র দেয় সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধান কর্মকর্তা।

উভয় ব্যাংকই তাদের নিজেদের ব্যাংকিং আইন উল্লেখ করে আদালতের নির্দেশ ব্যতীত কাউকে গ্রাহকের তথ্য দিতে নিষেধ রয়েছে, এমন অজুহাতে তথ্য দেওয়া সম্ভব নয় বলে চিঠিতে জানিয়েছে। অথচ দুদকের চিঠিতে মেসার্স ফয়েজ উদ্দিন অ্যান্ড কোম্পানির আমদানি সংক্রান্ত বিভিন্ন নথিপত্র চাওয়া হয়েছে, যা আইনের ওই বিধি-নিষেধের আওতায় পড়ে না।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে বলেন, ব্যাংক দুটি ব্যাংকার্স বুকস এভিডেন্স অ্যাক্ট (বিবিইএ) ১৮৯১-এর ৫ ও ৬(১) ধারা এবং কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর ১৮৯৮-এর ৯৪(১) ধারা উল্লেখ করে ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার অজুহাতে তথ্য দিচ্ছে না। অথচ দুদক থেকে মেসার্স ফয়েজ উদ্দিন অ্যান্ড কোম্পানির ঋণপত্র খুলে দুবাইভিত্তিক কোম্পানি মোহসেন আল ব্রাইকি জেনারেল ট্রেডিং পণ্য আমদানি সংক্রান্ত ব্যাংকে রক্ষিত রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত ছায়ালিপি যেমন- এলসি, বিল অফ এন্ট্রি, কমার্শিয়াল ইনভয়েস এবং বিল অফ ল্যাডিং ইত্যাদি চাওয়া হয়েছে, যা ব্যক্তিগত তথ্য নয়। তা ছাড়া প্রায় একই ধরনের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও ঢাকা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করেছে। তাই তাদের নথিপত্র সরবরাহ না করা দুঃখজনক।

তবে দুদকের অন্য একটি সূত্রে জানা যায়, এ সংক্রান্ত ওই দুই ব্যাংকের নথিপত্র অনেকটাই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে দুদক সূত্রে জানা যায়, দুবাইভিত্তিক কোম্পানি মোহসেন আল ব্রাইকি জেনারেল ট্রেডিং কোম্পানির ৪৯ শতাংশ শেয়ারের মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাংলাদেশি নাগরিক আবুল আহসান চৌধুরী। ওই প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য আমদানির নামে তিন ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণপত্র খোলে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকার রাসায়নিক পণ্য ও খাদ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স ফয়েজ উদ্দিন অ্যান্ড কোম্পানি। কিন্তু পণ্য আসেনি। অথচ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রায় ২১৬ কোটি টাকা। আর পণ্য আমদানির নামে দুবাইয়ে অর্থপাচারের এ প্রমাণ মিলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন অনুযায়ী, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের বেগম রোকেয়া সরণি শাখায় ফয়েজ উদ্দিন অ্যান্ড কোম্পানির নামে ২০১১ সালের ৭ জুন হিসাব খোলা হয়। অনুরূপভাবে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের মৌলভীবাজার শাখায় হিসাব খোলা হয় ২০০৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ও ঢাকা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখায় ২০১২ সালের ১২ আগস্ট। হিসাব খোলার পর লেনদেনের পাশাপাশি বাকিতে ঋণপত্রও খোলে ব্যাংক তিনটি।

দুবাইয়ের মোহসেন আল ব্রাইকি জেনারেল ট্রেডিং কোম্পানি থেকে পণ্য আমদানির জন্য সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণপত্র খোলা হলেও ৩৩টি ঋণপত্রের মধ্যে ১৮টির বিল অব এন্ট্রির সত্যতা ছিল না। এ ছাড়া ছয়টি ঋণপত্রের প্রকৃত নথি গ্রহণ না করায় পণ্য আমদানি হয়নি। অর্থাৎ পণ্য আমদানি না করেই ২৪টি ঋণপত্রের বিপরীতে ৯৬ লাখ ডলার দুবাইয়ে পাঠিয়ে দেয় মেসার্স ফয়েজ উদ্দিন অ্যান্ড কোম্পানি।

এ ছাড়া আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের মৌলভীবাজার শাখায় খোলা হয় ৫৮টি ঋণপত্র। তবে ১১টির প্রকৃত নথি ও ৩৩টির বিল অব এন্ট্রির সঠিকতা পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ কোনো পণ্যই আমদানি হয়নি। তার পরও বিদেশে পাঠানো হয়েছে ১ কোটি ৬৯ লাখ ডলার।

সূত্র আরো জানায়, ঢাকা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখায় দুবাইয়ের ওই প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হলেও পণ্য আসেনি। অথচ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ১২ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে পণ্য না এনেই তিন ব্যাংকের মাধ্যমে ৭১টি ঋণপত্রের বিপরীতে বিদেশে পাঠানো হয়েছে ২ কোটি ৭৭ লাখ ডলার।

মোহসেন আল ব্রাইকি জেনারেল ট্রেডিং কোম্পানির ৪৯ শতাংশ শেয়ারের মালিক আবুল আহসান চৌধুরী। তার পাসপোর্ট নম্বর কিউ০৪৬৯৬২৭। বাকি ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক সংযুক্ত আরব আমিরাতের মোহসেন আওয়াদ ওমর সালেহ আল ব্রাইকি। অস্ট্রেলিয়া, চীন, ভারত ও বাংলাদেশ থেকে খাদ্য, খেলনা, কসমেটিক ও কেমিক্যাল পণ্য আমদানি করে প্রতিষ্ঠানটি। আর রফতানি করে সৌদি আরব, বাংলাদেশ, ভারতসহ আরো কয়েকটি দেশে। ফয়েজ উদ্দিন অ্যান্ড কোম্পানি এর অন্যতম গ্রাহক। দুবাইভিত্তিক এ মোহসেন আল ব্রাইকি জেনারেল ট্রেডিং কোম্পানির কাছেই পাঠানো হয়েছে ২ কোটি ৭১ লাখ ডলার। এ ছাড়া আরো তিন রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে গেছে ৬ লাখ ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, পণ্য আমদানি না করেই জাল নথি দাখিলের মাধ্যমে আমদানি মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে, যা মানি লন্ডারিং আইন, ২০১২-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী মানি লন্ডারিং অপরাধ সংঘটনের নির্দেশক বলে প্রতীয়মান হয়।

মেসার্স ফয়েজ উদ্দিন অ্যান্ড কোম্পানির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ফয়েজ উদ্দিন ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ও তানভী ইন্টারন্যাশনাল। এর কর্ণধার হচ্ছেন রফিক উদ্দিন স্বপন, নাসির উদ্দিন বাবুল, ফিরোজ উদ্দিন খোকন ও নাফিজ উদ্দিন তুহিন। তবে রফিক উদ্দিন স্বপনই মূলত এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন।

চলতি বছরের ৬ আগস্ট ওই অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। দুদকের সহকারী পরিচালক দেবব্রত মণ্ডল অভিযোগটি অনুসন্ধান ও উপপরিচালক ঋত্বিক সাহা অনুসন্ধান কাজ তদারক করছেন।

 

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ অক্টোবর ২০১৫/এম এ রহমান/সাইফুল

 

**

 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়