ঢাকা     সোমবার   ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ৩০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

দুর্ভাগ্যপীড়িত একটি নীল শাড়ির গল্প

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ২৭ নভেম্বর ২০১৪   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুর্ভাগ্যপীড়িত একটি নীল শাড়ির গল্প

অলংকরণ : সংগৃহীত

রুহুল আমিন

ছয় মাস, কম সময় না। দিন-মাস-বছর এভাবেই কেটে গেছে রায়হানের। আজ সেইসব দিনগুলো মাঝে মাঝে বর্তমানের দেয়ালে শেওলার মতো ভেসে বেড়ায়। নাহ্ এমন একটি দিনে কোনো দুঃসহ স্মৃতিকে মনে করতে চায় না সে। আজ প্রথম শায়লার সাথে দেখা হবে। গত ছয় মাস কত কথা বলেছে শায়লার সাথে। গত ছয় মাসে পান থেকে চুন খসলে সবার আগে শায়লাকে জানিয়েছে সে। শায়লা কোনদিন এতটুকু বিরুক্তি প্রকাশ করেনি।


হ্যাঁ, ছয় মাস! শায়লাকে নীল শাড়ি পড়ে আসতে বলেছে সে। নীল শাড়ি কেন? নীল তো বেদনার রং। তার চোখের সামনে নীলময় অতীত সটান দাঁড়িয়ে গেল। মনে পড়ল সে যখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র তখনকার ঘটনা। একটা নীল শাড়ি কিনেছিল বান্ধবীর জন্য। কিন্তু পরে আর শাড়িটি তাকে দেওয়া হয়নি। সেই শাড়ি তার জীবনকে আনন্দের এক পশলা বৃষ্টিতে ভিজিয়েছিল। একইসঙ্গে সে প্রথমবারের মতো জেনেছিল মায়ের পছন্দের রং। মাকে সে কখনো কারও কাছে কিছু চাইতে দেখেনি। মা সব সময় কম চাহিদার মানুষ। তবুও সেবার কেমন করে জানি মা বলে ফেলেছিল।  বান্ধবীর জন্য কেনা নীল শাড়ি সে বাড়ি নিয়ে গেল। মা নীল রংয়ের শাড়ি পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলেছিল, কত দিন তোর বাবাকে বলেছি একটা নীল শাড়ি কিনে দিতে,  দেয়নি । বাবা তুই বুঝলি কি করে, আমার নীল শাড়ির শখ।


রায়হান আসলে বুঝতে পারেনি মায়ের এই আনন্দের মূল কারণ। সত্যিই কি শাড়ি দেখে মা খুশী হয়েছিল নাকি ছেলে এনেছে বলে তার এই উচ্ছ্বাস! রায়হান মাকে সুখী দেখার জন্য সব করতে পারে । কিন্তু মাকে তার মাঝে মাঝে বড় বেশি অচেনা লাগে। বাবার নিভু নিভু অর্থনৈতিক অবস্থায় এক সময় মা কঠিন এক অসুখে পড়লেন। প্রতি এক মাস অন্তর মাকে শাহবাগের পিজি হাসপাতালে আনতে হয় মেডিক্যাল চেকআপের জন্য । ঢাকায় আসলে মাকে অচেনা মনে হয়। প্রতিবার শাহবাগের উড়ন্ত সেতুতে উঠেই বলবে আমাকে একটা ভ্যানেটি ব্যাগ কিনে দে বাবা ! এই রকম পলিথিন ব্যাগ নিয়ে আসতে আর ভালো লাগে না। এখন কেউ এগুলো ব্যবহার করে?


মার চোখ খুলে গেছে। বিশ্বায়নের দমকা হাওয়া মায়ের গায়েও একটু লেগেছিল বোধ হয়। তাই তো মা একটু আধুনিক হওয়ার চেষ্টা করছিল। ছোটবেলায় মাকে দেখেছে পলিথিনের বা পাটের ব্যাগ নিয়ে মামা খালাদের বাড়ি যেতে। সেই মায়ের এখন একটি ভ্যানেটি ব্যাগ দরকার। মা প্রায় প্রতিবারই বলে। রায়হানেরও  ইচ্ছে ছিল জীবনের প্রথম মাইনের টাকা দিয়ে মাকে একটা ব্যাগ কিনে দিবে । তাই সে বরাবর এক কথাই বলত, এখানকার ব্যাগগুলো ভালো না। সামনের বার বাড়ি আসার সময় নিয়ে আসবো। বাড়ি যাওয়া হতো ঠিকই কিন্তু ব্যাগ আর নেওয়া হয়নি।  চাকরি পেয়ে সে প্রথম মাসের বেতন থেকে মায়ের জন্য একটা ব্যাগ কিনেছিল। মা ভীষণ খুশি হয়েছিল।


অতীতের দিনগুলোর কথা আজ হঠাৎ মনে পড়ছে কেন রায়হান ভেবে পেল না। অতীত তো কখনো মানুষকে আনন্দ দেয় না। তা সে আনন্দের হোক আর বেদনারই হোক।  এক বছর হলো সে চাকরি পেল। এই এক বছরে জীবনের সঙ্গে ম্যারাথন দৌড়াচ্ছে গন্তব্যে পৌঁছার জন্য। অনেক সীমাবদ্ধতার ভেতরে সর্বোচ্চ যেটুকু পাওয়া যায় তাই-ই কম কি তার জন্য। এই যে শায়লা। একজন শায়লার জন্য কতদিন সে আক্ষেপ করেছে। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ঢাকা এলো সব চাওয়ার মধ্যে একটা প্রেম হবে এটাও সে চেয়েছিল। এই চাওয়া খুব বেশি ছিল না নিশ্চই।  না, প্রেম আর করা হয়নি রায়হানের। অর্থনৈতিক দুরবস্থায় প্রেম করার সাহস পায়নি সে। ঢাকা শহরের প্রেম তো কেএফসি, বিএফসি আর চিলির বিল দেওয়া। তার জীবনে যাও বা কয়েকবার প্রেমের দেবতারা উঁকি দিয়েছিল, কিন্তু ফোনে ধানমন্ডি লেক বা কোনো রেস্তোরাঁর পাশে আসতে বলাতে পালিয়ে গেল। কখনো রেস্তোরাঁয় আসার কথা সে বলতে পারেনি। এই সব অতীত আজ মনে করতে চায় না সে ।


অনেক অপেক্ষার পর এই দিনটা পেয়েছে রায়হান। নাহ্! নীল শাড়ি পড়ে আসতে বলাটা ঠিক হয়নি । শায়লা আবার কি মনে করবে কে জানে! যে জীবনে পাহাড়সম দুঃখ সেই জীবনে এই রকম বালির মতো একটা ছোট আনন্দকে মনে রাখার কি দরকার? তবুও মাঝে মাঝে মনে পড়ে যায় আর রেডি হতে হতে ভাবে সেসব দিনের কথা। শায়লা নিশ্চয় ঠিক সময়ে বের হবে। শায়লা ভুলোমনা নয়, এটা তার একটা গুণ। রায়হান রওনা হলো। তারপর কথামতো ধানমন্ডি লেকের ধারে রেস্তোরাঁতে গিয়ে বসল। শায়লা তখনও আসেনি। হয়তো জ্যামে আটকে গেছে তাই একটু দেরি হচ্ছে। রায়হান ভাবতে ভাবতে আশপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল।


হঠাৎ কালবৈশাখীতে বাজ পড়ার মতো শোনা গেল একটা কণ্ঠ। ঠাস ঠাস দুহাতে তালি বাজাতে বাজতে এসে বলল, ও আচ্ছা! তুমিই রায়হান? হায় আল্লাহ  কতক্ষণ বসিয়ে রেখেছি! ছিঃ আমি দেখ কত খারাপ। কী গো তুমি কেমন আছো? আল্লাহ কত হ্যাণ্ডসাম! ইস্ বলো না তুমি কতক্ষণ বসে আছ? রায়হান পলকে চোখ ফিরিয়ে নিল। পড়নে নীল শাড়ি আছে কিনা দেখার জন্য পুনরায় আর তাকাতে ইচ্ছে হলো না তার। দ্রুত কোনোকিছু বুঝে উঠার আগেই দিল এক দৌড়। ভো দৌড় যাকে বলে।   


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ নভেম্বর ২০১৪/তাপস রায়    

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়