ঢাকা     সোমবার   ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ৩০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

দূর আকাশের তারা

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৫৯, ১৩ ডিসেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৩:০০, ১৩ ডিসেম্বর ২০২১
দূর আকাশের তারা

জীবনে যদি দীপ জ্বালাতে নাহি পারো, আকাশ এত মেঘলা যেও নাকো একলা, মরমীয়া তুমি চলে গেলে দরদী আমার কোথা পাবো, পাষানের বুকে লিখোনা আমার নাম, জানি একদিন আমার জীবনী লেখা হবে, হায় বরষা এমন ফাগুন কেড়ে নিও না, এখনো আকাশে চাঁদ ঐ জেগে আছে- এসব গান সতীনাথকে মনে করিয়ে দেয়। এসব গান আজো অনেকের মনে দোলা দেয়। 

কোথাও সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের গানের রেকর্ড বাজলে কানে আসার সঙ্গে সঙ্গে অনেক প্রবীণের মুখ থেকেই অকপটে বেরিয়ে আসে ‘এগুলো হচ্ছে গান’। এই অমর শিল্পীর ৩০তম প্রয়াণ দিবস আজ। 

সতীনাথ মুখোপাধ্যায় আজ দূর আকাশের তারা। তিনি ১৯৯২ সালের ১৩ ডিসেম্বর কলকাতার পিজি হাসপাতালে মারা যান। জন্ম  ১৯২৫ সালে ভারতের লখনৌতে। বাবার নাম তারকচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। ছোটবেলাতেই সতীনাথ চলে আসেন হুগলির চুঁচুড়ায়। এখানেই তার বেড়ে ওঠা ও বিএ পর্যন্ত লেখাপড়া। এরপর এমএ পড়ার জন্য চলে আসেন কলকাতায়। কলকাতায় এসে পড়া বাদ দিয়ে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চা করেন। তিনি আধুনিক বাংলা গান, নজরুল সংগীত ও গজল শিল্পী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। কণ্ঠশিল্পীর বাইরেও তিনি গীতিকার ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন।

তার জীবনীতে পাওয়া যায়- গানের কোনো লাইন যখনই মনে আসতো তখনই লিখে ফেলতেন। গান মনে এলো তো, সিগারেটের প্যাকেট ছিঁড়ে তাতেই কথা লিখেছেন। নোটেশন করেছেন। চাঁদনি রাতে গাড়িতে যেতে যেতে হঠাৎই লিখে ফেলছেন, ‘জীবনে যদি দীপ জ্বালাতে নাহি পারো’ কিংবা ‘এখনও আকাশে চাঁদ ওই জেগে আছে’।

পঞ্চাশ আর ষাট দশক ছিল বাংলা আধুনিক গানের স্বর্ণযুগ। কথা ও সুর সেই সময়ে একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শ্রোতাদের মন জয় করেছিলো। সুরকারদের মধ্যে ছিলেন সলিল চৌধুরী, সুধীন দাশগুপ্ত, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্রের মত দিক্পালেরা। আর গীতিকার হিসেবে ছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, শ্যামল গুপ্ত, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল ঘোষের মত প্রতিভাবান লেখকের দল।

১৯৬৮ সালে সতীনাথ সংগীত শিল্পী উৎপলা সেনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

সতীনাথ নজরুলগীতিরও তিনি জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন। ‘রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’ সম্ভবত তার কণ্ঠেই প্রথম রেকর্ড হয়েছিল। ১৯৪২ সালে সতীনাথ প্রথম রেকর্ড করলেন নজরুলগীতির। ‘ভুল করে যদি ভাল বেসে থাকি’। তুমুল সাড়া পড়ে গেল। কিন্তু পরের গানের রেকর্ড ‘আমি চলে গেলে পাষাণের বুকে লিখো না আমার নাম’ আর ‘এ জীবনে যেন আজ কিছু ভাল লাগে না’ যখন বেরোল, তত দিনে পেরিয়ে গেছে দশটি বছর!

তাকে নিয়ে ছড়িয়ে আছে মজার মজার গল্প। একটি এমন- সময়টা পঞ্চাশের শুরু। কলকাতার এক বিখ্যাত জলসার আসর। উস্তাদজির গানের পর মঞ্চে উঠবেন লতা মুঙ্গেশকর। এই দুই শিল্পীর মাঝখানের সময়টুকু ভরাট করতে গান গাইতে বসবেন এমন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। যুবক সতীনাথ এগিয়ে এলেন। আহীর-ভৈঁরো রাগে ধরলেন ‘না যেও না গো চলে যেয়ো না’। গান শেষ হতে শ্রোতারা উচ্ছ্বসিত। তন্ময় সতীনাথ শুনলেন ‘নো মোর নো মোর’। উঠে পড়তে যাচ্ছিলেন। ভুল ভাঙাতে মঞ্চে উঠে এলেন লতাজি। গ্রিন রুমে জড়িয়ে ধরলেন উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি। বলেন, ‘তুমি সতীনাথ নও, শিউনাথ (শিব)।’

আবার- রান্নার পাশাপাশি জমিয়ে বাজারও করতেন সতীনাথ। নিউমার্কেটে তার বাঁধা মুরগিওয়ালা ছিলেন আলাউদ্দিন। উর্দুভাষী। আর নিজে উর্দুটা যেহেতু বলতে, লিখতে পারতেন, সতীনাথ তার সঙ্গে উর্দুতেই কথা বলতেন। সে-উর্দু এতটাই চোস্ত ছিল, আলাউদ্দিন ধরেই নিয়েছিলেন তার খদ্দের বাবুটি মুসলিম। কিন্তু তার খটকা লাগত অন্য জায়গায়। একদিন আর থাকতে না পেরে বলেই ফেললেন, ‘আপ মুসলমান হোকে ধোতি কিঁউ প্যাহেনতে হ্যায়?’ শেষে গলার উপবীত দেখিয়ে তাকে বোঝানো গিয়েছিল, ‘না বাবা, আমি মুসলিম নই, হিন্দু ব্রাহ্মণ।’

আরেকটি ঘটনা এমন- নতুন গানের সুর ভাঁজতে গিয়ে বেখেয়ালে নিয়ম ভেঙে থানাতেও গেছেন। ভুল পার্কিং করে ফেলেছিলেন। ট্রাফিক পুলিশ সোজা পার্ক স্ট্রিট থানায় ধরে নিয়ে যান। তাতেও হুঁশ নেই। থানার চেয়ারে বসে বসেই সুর লাগাচ্ছেন। গলা শুনে ওসি ছুটে এসে দেখেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়! তখন সেই ট্রাফিক পুলিশেরই সাজা হয় আরকী!

আরেকটি ঘটনা তো আরো অবাক করারই মতো- চল্লিশের দশক। হুগলি মহসিন কলেজে ফুটবল ম্যাচ হচ্ছে। গোলকিপিং করছে যে ছেলেটি, সে মাঝে মাঝেই গুন গুন করে গান গায়। উপস্থিত দর্শক সতীনাথের কানে গেল। খেলা শেষে ছেলেটিকে ডেকে নিয়ে তিনি কলকাতায় গিয়ে ভাল গান শেখার পরামর্শ দিলেন। সে দিনের সেই গোলকিপার, পরবর্তী কালের শ্যামল মিত্র। অবিশ্বাস্য হলেও এটাই চরম সত্যি।

বাংলা সংগীত জগতের এই উজ্জল নক্ষত্র সংগীত শিল্পী উৎপলা সেন এর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৬৮ সালে। সম্পর্ক তো এক-আধ বছরের নয়, উৎপলা যখন বেণু সেনের ঘরণি, তখন থেকে। তিন জনের বন্ধুতা, হৃদ্যতা কখনো টাল খায়নি একটি বারের জন্যও। ১৯৬৫ সালের ১৩ নভেম্বর বেণু সেনের অকাল মৃত্যুর পর তার মায়েরই উদ্যোগে সতীনাথ বিয়ে করেন উৎপলাকে। সতীনাথের খুব ইচ্ছে ছিল যদি একটা মেয়ে হতো! আপত্তি ছিল না উৎপলারও। কিন্তু প্রথম পক্ষের ছেলে বাবুন যে তখন সদ্য যুবক। তাকে সতীনাথ পুত্রস্নেহে কোলে পিঠে আদরে আহ্লাদে বড় করছেন। তার যদি মনে লাগে! তাই নিজের ইচ্ছেটাকে চাপা দিয়ে কাপড়ের গার্গীই ছিল সতীনাথের মেয়ে। দিনের বেলা সে থাকত আলমারিতে। রাতে ঘুমোতে যাবার আগে মেয়েকে বের করে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে, চুল আঁচড়ে, কাপড়-জামা সাফসুতরো করে ফিরিয়ে দিতেন তার আলমারি-বিছানায়। অভিমানী উৎপলার এক বার সহ্য হয়নি। তুমি কেবলই তো গার্গীকে নিয়ে আছ! আমার দিকে ফিরেও তাকাও না। ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দোতলার বারান্দা থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন তাকে। কষ্ট পেয়েছিলেন সতীনাথ, বিড় বিড় করে শুধু বলেছিলেন, তুমি আমার গার্গীকে ছিঁড়ে ফেললে!বোধ হয় মৃত্যু অবধি এই হাহাকার তিনি বুকে বয়ে বেড়িয়েছেন।

ঢাকা/টিপু

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়