ঢাকা     সোমবার   ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ৩০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

যে কারণে শকুন সংরক্ষণ জরুরি

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যে কারণে শকুন সংরক্ষণ জরুরি

শাহ মতিন টিপু : এক সময় বাংলাদেশের লোকালয়ে শকুন দেখা যেত। তা এতোটাই যে, শকুনের ভয়ে ভীত থাকত মানুষ। ‘শকুনের দোয়ায় গরু মরে না’ জাতীয় প্রবাদ তৈরি হয়েছে শকুনের আধিক্য থেকেই। আমাদের দেশে আগের মতো গ্রামগঞ্জেও এখন আর দেখা মেলে না শকুনের।

 

‘প্রাধিকার’ নামক একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে মোট ৬ প্রজাতির দেখা পাওয়া যেত। শকুন, রাজ শকুন, সাদা গিদরী বা গিন্নী শকুন, লম্বা ঠোঁট শকুন আমাদের দেশীয় প্রজাতি। আর ভ্রমণকারী হিসেবে কালো শকুন আর গ্রিফন শকুন ছিল। রাজ শকুন শেষবারের মত দেখা গেছে ৮০’র দশকে। এখনও হয়ত কোথাও টিকে রয়েছে। তবে লোকচক্ষুর অন্তরালে।

 

লম্বা ঠোঁট শকুন ১৯৯২ সালে ভৈরবে পক্ষিবিদ পল থমসন শেষবারের মতন দেখেন। গিন্নী শকুনের শেষ দেখাও ১৯৮৪ সালে পল থমসনের চোখে। কালো শকুন ১৯৮৭ সালের নভেম্বরে ধরা পড়ে চাঁদপুরে। গ্রিফন শকুন ১৮ নভেম্বর ১৯৯২ সালে শেষবারের মত দেখা যায় ভৈরবে। বাংলা শকুন টিকে রয়েছে কোন রকমে। অথচ সত্তর দশকে রাজ শকুন আর বাংলা শকুনে ছেয়ে ছিল ঢাকা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ চিত্রগুলোতে দেখা যায় দল বেধে মৃতদেহের উপর বসে আছে তারা। সত্তরের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির নারিকেল গাছের সারিতে আর পলাশী ব্যারাকের কাছের উঁচু গাছগুলোতে দেখা যেত বাংলা শকুনের।

 

অসচেতনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে যে আবর্জনা নিত্যদিন সমস্যার সৃষ্টি করছে, শকুনের মতো বর্জভূক পাখিরা প্রাকৃতিকভাবে এসব মৃতদেহ ও আবর্জনা খেয়ে পরিবেশকে করছে দূষণমুক্ত। কোথাও কোনো মৃত প্রাণীর খোঁজ পেলে ঝাঁকে ঝাঁকে শকুন এসে নিমেষেই পরিস্কার করে দিতো। আমাদের অবহেলার কারণে যেসব আবর্জনা ও মৃতপ্রাণী সুষ্ঠুভাবে পরিশোধন হয় না, এই পাখিরা সেই কাজটি করে যায় প্রাকৃতিকভাবে। সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে পরোক্ষভাবে কাজ করে এরা। কিন্তু বর্তমানে উপকারী এই পাখিটি বিলুপ্তির পথে।

 

এ দেশে বেশি দেখা যেত বলেই তাদের নামের শেষে বাংলা শব্দটি চলে এসেছে। এখন গোটা পৃথিবীতেই এর অবস্থা খুবই ভয়াবহ। সংখ্যায় দশ হাজারের বেশি হবেনা। বাংলাদেশে বাংলা শকুন এখন বিরল প্রজাতি। সব মিলে এদেশেও এদের সংখ্যা ৫০০ এর বেশি হবে না। তাও আবার বেশিরভাগই দেখা যায় সুন্দরবন এলাকায়। এ ছাড়া বেশ বড় কয়েকটি দল এখন রয়েছে শ্রীমঙ্গলের কালাছড়া ও হবিগঞ্জের রেমা কালেঙ্গা এলাকায়। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এদেশও শকুন শূন্য হয়ে পড়বে। গোটা বাংলাদেশ জুড়ে মোট শকুনের সংখ্যা ২০০০টিও নয় বলে জানিয়েছেন বন অধিদপ্তরের ।

 

উইকিপিডিয়ায় প্রদত্ত তথ্য মতে, সারা বিশ্বে প্রায় ১৮ প্রজাতির শকুন দেখা যায়, এর মধ্যে পশ্চিম গোলার্ধে ৭ প্রজাতির এবং পূর্ব গোলার্ধে (ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া) ঈগলের সাথে সম্পর্কিত ১১ প্রজাতির শকুন দেখা যায়। ক্যামেরুন, সুদান, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা, তাঞ্জানিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, মাদাগাস্কার, নামিবিয়া, বতসোয়ানা, ঘানা, জাম্বিয়া, বাংলাদেশ, চীন, ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড অঞ্চলে শকুন দেখতে পাওয়া যায়। এরা সাধারনত মৃত হরিণ, গরু, মহিষ, জেব্রা ইত্যাদি ভক্ষণ করে থাকে।

 

প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম শনিবার পালিত হয় `আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস`। বিলুপ্তপ্রায় এই শকুনকে বাঁচাতে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধিই শকুন সচেতনতা দিবসের উদ্দেশ্য। ভালচার ডে ডট অর্গানাইজেশন প্রদত্ত তথ্যমতে, বর্তমানে পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রজাতির মাত্র ছয় হাজার শকুন আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে সাদা প্রজাতির পাঁচশ` শকুন। বিশ্বব্যাপী যেমন দিবসটি পালিত হচ্ছে, তেমনি আমাদের দেশেও সরকারিভাবে পালিত হচ্ছে। এ উপলক্ষে ৬ সেপ্টেম্বর রোববার বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বন অধিদপ্তর। সেদিন সকাল সাড়ে ৯টায় রাজধানীর দোয়েল চত্বর থেকে র‌্যালি বের হবে, শেষ হবে জাতীয় প্রেস ক্লাবে। প্রেস ক্লাবে শকুন সংরক্ষণে সচেতনতার ওপর বিশেষ আলোচনা সভারও আয়োজন করা হয়েছে। ৬ সেপ্টেম্বর সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যালি হবে। বাংলাদেশ বন অধিদপ্তর , আইইউসিএন,বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব সহ অন্যান্য পরিবেশবাদী সংগঠন দিবসটি উৎযাপন করবে।

 

বন অধিদপ্তর প্রদত্ত তথ্যমতে,  আমাদের দেশে গত শতকের সত্তর এর দশক থেকে এ পর্যন্ত শকুনের সংখ্যা হ্রাসের পরিমাণ ৯৮ শতাংশ বলে জানিয়েছে । ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার (আইইউসিএন) এর ক্রিটিক্যালি এন্ডেনজার্ড এর তালিকায় রয়েছে শকুনের সব ক’টি প্রজাতি। আর এ জন্যই প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার পাশাপাশি দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন রোগ। আর এর মধ্যে অন্যতম অ্যানথ্রাক্স। এ ছাড়াও রয়েছে গবাদিপশুর যক্ষা, খুরা রোগ।

 

দেশি বা বাংলা শকুন লম্বায় ৯০ সেমি ও ওজনে ৪ দশমিক ৩ কেজি। পালক ময়লা কালচে বাদামি। গলা লম্বা। লোমহীন মাথা ও গলা গাঢ় ধূসর। ঘাড় ও পিঠের সংযোগস্থলের ময়লা সাদা পালকগুলো দেখতে মাফলারের মতো। পশ্চাদ্দেশের পালক সাদা। ডানা, পিঠ ও লেজ কালচে বাদামি। পা কালো। স্ত্রী-পুরুষ একই রকম। বাচ্চার গাঢ় বাদামি, দেহ ও ডানার ওপরের অংশে চিকন সাদা দাগ থাকে। শকুনের দৃষ্টি অসাধারণ তীক্ষ, কিন্তু ঘ্রাণশক্তি নেই। সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ প্রজননকাল। বাসার আকার বেশ বড়। একই বাসা ঠিকঠাক করে বছরের পর বছর ব্যবহার করে। স্ত্রী শকুন সাদা রঙের একটি মাত্র ডিম পাড়ে। ডিম ফোটে ৪০-৪৫ দিনে।

 

শকুনের বিলুপ্তির অন্যতম প্রধান কারণ গবাদিপশুর জন্য ব্যবহৃত ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেনের ব্যবহার। এ দু’টো ওষুধের প্রভাব মৃত গবাদিপশুর দেহেও থাকে। এ ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছে এমন কোন মৃতদেহ শকুনের খাদ্য তালিকায় চলে এলে শকুনের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কেননা এর পার্শপ্রতিক্রিয়ায় শকুনের কিডনিতে পানি জমে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু ঘটে। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ অব ভেটেরিনারি মেডিসিন-এর গবেষক ড. লিন্ডসে ওক তার এক গবেষণায় প্রমাণ করেন, পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনের ব্যবহারই শকুন বিলুপ্তির অন্যতম কারণ।

 

বিজ্ঞানীরা দেখেছেন মাত্র ০.২২ মিলিগ্রাম ডাইক্লোফেনাক যথেষ্ট একটি শকুনের মৃত্যুর জন্য। ডাইক্লোফেনাক ৮০’র দশকের শেষদিকে বেশ সস্তায় ভারতীয় উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। মাত্র ২০ টাকায় পাওয়া যায় বলে এই ওষুধের ব্যবহার বেড়ে যায়। গবাদিপশুর যে কোন রোগেই এ ওষুধ ব্যবহার করতে থাকে সাধারণ মানুষ। অথচ পরে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের একটি গবেষণায় দেখা যায় মাত্র গবাদিপশুর চিকিৎসায় মাত্র ০.৪ শতাংশ ক্ষেত্রে ডাইক্লোফেনাকের মত কড়া ওষুধ প্রয়োজন।

 

শকুনের বিলুপ্তির কারণ হিসাবে এর পাশাপাশি আরো কিছু ব্যাপারকে উল্লেখ করেছে আইইউসিএন-এর সহযোগী সংগঠন বার্ডসলিস্ট অর্গানাইজেশন। তারা কীটনাশক ও সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পানির দূষণ, খাদ্য সঙ্কট, কবিরাজি ওষুধ তৈরিতে শকুনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহার, বিমান-ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষ, ঘুড়ির সূতার সাথে জড়িয়ে পড়া, ইউরিক এসিডের প্রভাবে বিভিন্ন রোগ, বাসস্থানের অভাব প্রভৃতি। শকুনের বাসা বাঁধার স্থানের অভাবের জন্য তাদের বংশবৃদ্ধির হার আশঙ্কাজনকভাবে কমছে।

 

পাশাপাশি আরো বড় একটি কারণ হল বাসস্থানের অভাব। শিমুল, ছাতিম, দেবদারুর মত বড় গাছগুলো এখন আর চোখে পড়ে না সেভাবে। এ গাছগুলো নির্বিচারে ব্যবহার হয়েছে চায়ের পেটি, প্যাকিং বাক্স আর দেয়াশলাইয়ের কারখানায়। ইটের ভাটা, তামাক শুকানো আর পিচ গলিয়ে রাস্তা বানানোর জন্য গায়েব হয়ে গিয়েছে রাস্তার পাশের বট, শেওড়া আর গাবের গাছ। সংরক্ষিত বনের ভেতরেও চলে নির্বিচারে বড় গাছগুলোর নিধন। শকুনগুলো বাসা বাঁধবে কোথায়?’

 

শকুনের সংরক্ষণ এ কারণেই বেশি জরুরি যে, শকুন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার অন্যতম সদস্য। শকুনকে বলা হয়, প্রকৃতির ঝাড়ুদার। শকুন মরা গবাদিপশু খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি রোগ জীবাণুর বিস্তৃতি রোধেও সহায়তা করে। অ্যানথ্রাক্স ব্যকটেরিয়া, খুরা রোগ, গবাদি পশুর যক্ষা, হগ কলেরার জীবাণু খুব সহজেই হজম করতে পারে শকুন। যেটা কুকুর, শেয়াল বা বেড়াল গোত্রের প্রাণীরা হজম করতে পারে না বরং ছড়িয়ে বেড়ায়।

 

দেরিতে হলেও টনক নড়েছে সরকারের। ভারত, পাকিস্তান, নেপালে বহু আগেই শকুন সংরক্ষণে উদ্যোগ নিয়েছে। নিষিদ্ধ করেছে ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেন, ব্যবহার করতে শুরু করেছে মেলোক্সিক্যান। সেখানে গবাদিপশুর জন্য ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেনের উৎপাদনই পুরোপুরি নিষিদ্ধ। বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পেরে গত মন্ত্রিপরিষদ ডাইক্লোফেন আমদানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

 

জানা যায়, জনসচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে বাংলাদেশ সরকারের বন বিভাগ, বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী ট্রাস্ট ও বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাব। যে সমস্ত স্থানে এখনো শকুন টিকে রয়েছে, সে স্থানের মানুষজনকে সচেতন করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া মৃত প্রাণীকে সঙ্গে সঙ্গে সৎকার না করে শকুনের জন্য ফেলে রাখার জন্যও উৎসাহিত করা হবে। যেমনটি করা হয়েছে স্পেনে।

 

এ ব্যাপারে বন অধিদপ্তর জানিয়েছে গাজীপুরে প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে তৈরি করা হচ্ছে ভালচার ব্রিডিং সেন্টার। এখানে বাংলা শকুনসহ অন্যান্য প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির শকুনের বংশবৃদ্ধির জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে। অসুস্থ শকুনকে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা ও শকুনদেহের থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন জীবাণুর নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থাও থাকছে। একই সাথে দেশের শকুন অধ্যুষিত এলাকার বড় গাছগুলোকেও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।

 

‘আইইউসিএন বাংলাদেশ’ প্রথমবারের মতো চুনারুঘাটের রেমাকালেঙ্গা বনে স্থাপন করেছে শকুনের খাবার স্টেশন। কোন গৃহপালিত প্রাণী মারা গেলে ডাইক্লোফেনাক, কিটোপ্রোফেন টেস্ট করে যদি ভালো হয় তবে দেওয়া হবে খাবার স্টেশনে। বিশেষ করে ব্রিডিং সময়ে খাবার অবশ্যই দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন আইইউসিএন এর প্রজেক্ট ম্যানেজার সীমান্ত দিপু।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়