ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

ক্যানসার চিকিৎসার খরচ যোগাতে নিঃস্ব মানুষ

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৪৮, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১১:০৯, ১৩ এপ্রিল ২০২৪
ক্যানসার চিকিৎসার খরচ যোগাতে নিঃস্ব মানুষ

ফাইল ফটো

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে ১৬ থেকে ১৭ লাখ মানুষ বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারে ভুগছেন। প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ মানুষ নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। ২০৩০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা আছে। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা ৭৫ শতাংশের বেশি বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, দেশের প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি সমন্বিত ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র দরকার। সে অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮ কোটি মানুষের জন্য প্রয়োজন ১৮০টি সেন্টার। তবে, বাস্তব চিত্র খুবই ভয়াবহ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশে সরকারিভাবে ২২টি সেন্টার এবং বেসরকারিভাবে ১০টি সেন্টার ক্যানসারের চিকিৎসা দিচ্ছে। নতুন করে হতে যাওয়া আটটি মেডিক্যাল কলেজে ক্যানসার ইউনিট থাকছে। তবে, হিসাব বলছে, নতুন সেন্টার যুক্ত হলেও যে হারে রোগী বাড়ছে, তা চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ক্যানসারে আক্রান্ত একজন রোগীর চিকিৎসার জন্য প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা পকেট থেকে খরচ করতে হয়। এ খরচ সর্বনিম্ন ৮১ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় ওষুধ কিনতে। ক্যানসারের প্রথম স্তরে গড়ে চিকিৎসা খরচ ৩ লাখ ৩১ হাজার টাকার কিছু বেশি। দ্বিতীয় স্তরে গড় খরচ প্রায় ৭ লাখ টাকা। ফলে, ক্যানসারের চিকিৎসার খরচ যোগাতে নিঃস্ব হচ্ছে অনেক মানুষ।

ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডা. মোয়াররফ হোসেন জানিয়েছেন, একজন মানুষের শরীরে অনেক ধরনের ক্যানসার হতে পারে। এর মধ্যে আছে সলিড ক্যানসার, যেমন: ব্রেইন, লাং, ব্রেস্ট, পাকস্থলি, কোলন, লিভার, কিডনি, জরায়ু, ওভারি, প্রস্টেট ক্যানসার ইত্যাদি। ব্লাড ক্যানসারেরর মধ্যে আছে—লিউকোমিয়া, লিম্ফোমা, মাল্টিপল মায়েলোমা ইত্যাদি।

ক্যানসারের ব্যথা উপশমের সবচেয়ে ভালো ওষুধ মরফিন। দেশে ব্যথানাশক এ ওষুধ ক্রমান্বয়ে দুষ্পাপ্য হয়ে পড়েছে। লাভ কম হওয়ায় ওষুধটি উৎপাদনে কোম্পানিগুলোর আগ্রহ কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবের বরাত দিয়ে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ব্যথানাশক এ ওষুধ বছরে দরকার কমপক্ষে ৬০০ কিলোগ্রাম। পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ২৩ কিলোগ্রাম, যা প্রয়োজনের মাত্র ৪ শতাংশ। ফলে, মরফিনের অভাবেই বিপুল সংখ্যক রোগী যন্ত্রণা নিয়ে মারা যাচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) একটি লিনিয়ার এক্সেলেটর রেডিওথেরাপি মেশিন আছে। এছাড়া, জরায়ুমুখের চিকিৎসার জন্য ব্রাকিথেরাপি মেশিন আছে একটি। কেমোথেরাপির জন্য একটি কেমো ডে কেয়ার সেন্টার আছে, সেখানে ২০ জনের মতো রোগী প্রতিদিন থেরাপি নিতে পারেন। এখানে ৬০টির মতো বেড আছে।

এ বিষয়ে বিএসএমএমইউ’র অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. নাজির উদ্দিন মোল্লা বলেছেন, ভেজাল খাবার, খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান, মদপান, পান, জর্দা, সুপারি এসবের কারণে অনেক মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। খাওয়ার সমস্যার কারণে আমাদের পরিপাকতন্ত্রের ক্যানসার, কিডনির ক্যানসার বেড়ে যাচ্ছে। কিছু ক্যানসার জেনেটিক কারণে হয়।

তিনি বলেন, জরায়ুমুখের ক্যানসারের বিষয়ে লজ্জায় কাউকে বলেন না অনেক নারী। সহ্য না করতে পেরে যখন বলেন, তখন একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে আসে। তাদের আর বাঁচানো সম্ভব হয় না। ক্যানসার তাদের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। অথচ, শুরুতে এলে সহজেই এ রোগ নিরাময় করা সম্ভব হবে। রেডিও, কেমো ও হরমোন থেরাপির মাধ্যমে শতভাগ কিওর করা সম্ভব। তাই, শুরুতে শনাক্ত করা এক্ষেত্রে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য স্ক্রিনিংয়ের প্রয়োজন অনেক বেশি। তবে, বর্তমানে জরায়ুমুখের ক্যানসারের ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে বলে এটি কমে আসছে।

ভেজাল খাদ্য গ্রহণের কারণে বেশি মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই, ভেজাল খাদ্য রোধে সরকারের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার বলে মনে করেন এই ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ। ডা. মো. নাজির উদ্দিন মোল্লা বলেন, কেউ মানুষকে ভেজাল খাদ্য খাওয়ালে এবং সেটা প্রমাণিত হলে প্রয়োজনে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আইন করতে হবে। কারণ, এসব মানুষের কারণে অনেকে ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন।

ক্যানসারের ওষুধের ব্যয় অনেক বেশি। তবে, আগের চেয়ে বর্তমানে কমেছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন আমাদের দেশের অনেকগুলো কোম্পানি ক্যানসারের ওষুধ তৈরি করছে। তাই, ব্যয় কিছুটা কমেছে। আগে যেখানে ৩০ হাজার টাকা খরচ হতো, এখন সেখানে ১০ হাজার টাকা লাগছে। এসব ওষুধের কাঁচামাল দেশে তৈরি করা গেলে ওষুধের খরচ আরও কমবে।

পরিস্থিতি বুঝে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হলে সবার আগে হাসপাতাল ও জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার রোগী নিবন্ধন জরুরি, যা এখন পর্যন্ত দেশে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা সম্ভব হয়নি। সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি ও গবেষণা ইনস্টিটিউট পাইলট প্রজেক্ট নিয়ে চেষ্টা করছে। এটিও সন্তোষজনক নয় বলে জানান বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দীন ফারুক।

তিনি বলেন, ক্যান্সারের বেশকিছু ওষুধ ফ্রান্স, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়ে আসা হয়। সরকারকে এসব ওষুধের ওপর ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখার অনুরোধ করছি। আগে চাহিদা অনুযায়ী বিএসএমএমইউতে কিছু ওষুধ রোগীদের ফ্রি দেওয়া হতো। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর একটি তহবিল আছে, সেখান থেকে কিছু রোগীকে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। সমাজকল্যাণ অফিস থেকে এলে সে ক্ষেত্রে কিছু পায়। তবে, এসব অপ্রতুল। আমরা অন্যান্য দেশ, যেমন: ভারতের মতো কাঁচামাল এবং ওষুধ নিজেরা উৎপাদন করলে খরচ অনেক কমে যাবে। আরেকটি কাজ সরকারিভাবে আপাতত করা যায়, সেটি হচ্ছে, ক্যান্সারের এসব ওষুধ সরকার কিনে কম দামে রোগীদের সরাসরি সরবরাহ করা। এটা করা গেলে, যেটি আমাদের দেশে ১০ হাজার টাকায় এখন পাওয়া যাচ্ছে, তা ১ বা ২ হাজার টাকায়ই পাওয়া যাবে।

অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দীন ফারুক বলেন, ক্যানসারের চিকিৎসা যেমন ব্যয়বহুল, তেমনই এর চিকিৎসা দীর্ঘদিন করতে হয়। প্রতি বছর বাংলাদেশে ২ লাখের মতো নতুন রোগী ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এদের মধ্যে ৫০ হাজার রোগীকে সুস্থ করা সম্ভব হচ্ছে। সবাইকে ভালোভাবে চিকিৎসা না দিতে পারাটাও এক রকমের বৈষম্য। গরিব রোগীদের যথাযথ চিকিৎসার আওতায় না আনতে পারাটাও বৈষম্য।

সরকারি হাসপাতালগুলোতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় রোগীদের ওষুধ সরবরাহ ও চিকিৎসা দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ক্যানসার রোগীদের সহযোগিতায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়া, সরকারের কাছে আমার আবেদন, সমাজকল্যাণ ফান্ড থেকে যে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হতো, তা ১ লাখ টকায় উন্নীত করা হোক। এতে ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসায় কিছুটা সুবিধা বাড়বে। অনেক রোগীকে বিভিন্ন জেলা থেকে রাজধানীতে যাতায়াত করতে হয়। তাদের একটি ক্যানসার কার্ড করে দিয়ে ৫০ শতাংশ যাতায়াত ভাড়া করে দেওয়া গেলে তারা এসে চিকিৎসা নিতে পারবেন। 

ডা. গোলাম মহিউদ্দীন ফারুক জানান, বাংলাদেশ সরকার ক্যানসার চিকিৎসায় উন্নতি করার ব্যবস্থা নিচ্ছে। আটটি বিভাগে আলাদা করে ক্যানসারের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান করে দেওয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর মান ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেলে রাজধানীমুখী রোগীদের সংখ্যা কমবে। বর্তমানে যারা জেলা বা বিভাগীয় শহরে চিকিৎসা পাচ্ছেন না, তারাও চিকিৎসার আওতায় আসবেন। তাদের অর্থ সাশ্রয় হবে। 

মেয়া/রফিক

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়