পোখরার দিন-রাত (শেষ পর্ব)
ভ্রমণের মুগ্ধতা তো থাকেই। অধিকাংশ ভ্রমণকারীই সৌভাগ্যবান। তারা একটা দেশের রূপ, আনন্দ বুকে নিয়ে আসে। আমার চোখটাই বোধহয় খারাপ। ধরা পড়ে যায় অন্য কিছু। কোনো এক চিলতে অন্ধকার, কোথাও একটু ব্যথা।
সূচনা পর্ব পড়ুন: পোখরার দিন-রাত
পোখরার জৌলুসময় নাইট ক্লাব, ডান্স বার, ফ্রি মিক্সিংয়ের এক মিলনমেলা। পথে পথে আনন্দ উল্লাস। কিন্তু আমার চোখ গেলো কয়েকটা দুর্ঘটনায়। একরাতেই। একটা দেখলাম একদম চোখের পলকে। একদম ফাঁকা রাস্তা। ভয়ঙ্কর গতিতে বাইক চালিয়ে এলো এক যুবক। একটা গলি থেকে আরেকটা গলিতে ঘুরতে গেলো। রাস্তার বুকে পিষে চাকার বিশ্রি শব্দ হলো। তারপর বিকট এক শব্দ! মুহূর্তে দেখলাম বাইক একদিকে আর ছেলেটা ছিটকে আরেক দিকে। ধরাধরি করে তাকে তুললো আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকজন। ভাগ্যিস হেলমেট পরা ছিলো। বড় কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, তাকে অন্য যে দু’চারজন সড়ক থেকে তুললো সে তাদের গালি দিচ্ছিলো। গালির ভাষা তো বুঝি না, ধরন বুঝি। ধরনেই বুঝলাম বিকট গালিগালাজ হচ্ছে। উদ্ধারকারীরা বিরক্ত হয়ে পাল্টা গালি দিয়ে চলে গেলো। তারপর ছেলেটা টলতে টলতে বাইকের কাছে গিয়ে বসলো। উপুড় হলো, বোধহয় বমি করলো। আমি সরে গেলাম। ছেলেটার জন্য মায়া হলো। ছেলেই সে, যুবক নয়, সদ্য কৈশোরে পড়েছে। কার ছেলে? কী কারণে এতো রাতে অমন জোড়ে ফাঁকা রাস্তায় মদ খেয়ে ছুটতে হবে তাকে? জীবন তাকে কোন পথে নিয়ে ছোটাবে?
পোখরার নয়নাভিরাম সৌন্দর্য
পালে তিন রাত পোখরায় ছিলাম আর তার আগে-পরে চার রাত কাঠমান্ডুতে। দু’খানেই দেখলাম, রাত্রি কেমন নেশাময়, উদ্দাম, উচ্ছৃঙ্খল। দিনের বেলায় যে নেপাল মন্দিরে মন্দিরে ধূপ, ঘণ্টা, আরতিতে ভরপুর, নানা বাহারি খাবার, কতো রঙ-বেরঙের উপহার, বুদ্ধ, শিব আর গণেশের আশীর্বাদে ভরপুর সেই নেপাল রাতে যেন কোনো ডাইনীর কাঁধে ভর করে। উদ্দাম সুর, তীব্র নেশা আর যৌনতার ছড়াছড়ি পোখরায় আর কাঠমান্ডুতে। আর জুয়া খেলা তো আছেই।
খুবই দুঃখের সঙ্গে খেয়াল করেছি নেপাল যেন ক্রমে তার তরুণ প্রাণগুলোকে ঠেলে দিচ্ছে সহজ টাকার দিকে। নেশা আর যৌনতায় ভরে ওঠে রাতের নেপাল, সে পোখরা কিংবা কাঠমান্ডু― যাই হোক। দু’কদম হাঁটতে গেলেই কানের কাছে এসে ফিসফিস করে কোনো দালাল হিন্দি ইংরেজি মিলিয়ে কথা বলে, ‘সুইট গার্ল, হট ড্যান্স, স্পেশাল ম্যাসাজ, চলে গা, মজা আয়ে গা, শস্তা হ্যায়, বড়িয়া হ্যায়।’
একসময় ঢাকার নীলক্ষেতে বই কিনতে গেলে বিব্রত হতাম। ওইটুকু ফুটপাত ধরে হাঁটতে গেলেই কানের কাছে এসে বলতো, ‘চটি লাগবো স্যার’ আরো পরে এসে বলতো, ‘নতুন সিডি আছে’। পথ আমার বড় প্রিয়। জীবনে চলার আনন্দ হলো পথে, পথে হাঁটা। কিন্তু যে পথে যৌনতার নানা উপসঙ্গ ছড়িয়ে থাকে সে পথ আমার নয়। মনে পড়ে, দেবদাসে একটা অংশ আছে, যেখানে দেবদাস মাতাল হয়ে ফুটপাতে পড়ে আছে আর চন্দ্রমুখী এসে বেহুঁশ দেবদাসকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। চলার পথে এমন বেহুঁশ, মাতাল বহু দেখেছি কাঠমান্ডুর ট্যুরিস্ট পাড়ায় (মূলত থামেলে) আর পোখরাতে। এইসব দেখে, হিমালয়ের কোলের এই নেপালকে তখন নিচে নেমে যেতে দেখি। তখন মনে হয় প্রদীপের নিচে অন্ধকার, পাহাড়ের নিচে অন্ধকার, সত্যের নিচে অন্ধকার স্তুপ হয়ে আসে, গাঢ় হয়ে আসে। মন খারাপ হয়ে যায়। গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থানে সুখ, শান্তি অনুসন্ধানের সাধন পথের বদলে এই নেশাময়, হৈহুল্লুড়ের বেপরোয়া পথ বড় বেদনার মতো বুকে বাজে।
অপূর্ব সুন্দর সব ছেলে-মেয়েকে দেখা যায় রাত্রির নেপালের পথে-ঘাটে। ক্যাসিনোতে, বারে, ক্লাবে কিংবা বারের নিচে, ক্লাবের নিচে। তারা চুমু খাচ্ছে, জড়াজড়ি করছি। তাতে কোনো দোষ নেই হয়তো। হয়তো তারা প্রেমিক-প্রেমিকা কিংবা ভাড়া করা আদরের লোক। দোষটা এইখানে যে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরা প্রাপ্তবয়স্ক নয়। ব্যাংককের মতো অপ্রাপ্তবয়স্ক যৌনতা আর অপ্রাপ্তমনস্ক ভোগের দিকে এগুচ্ছে হিমালয় কন্যা। এটুকু মানতে কষ্ট হয়। ট্যুরিজমের সঙ্গে পূঁজিবাদ বরাবর নেশা আর যৌনতাকে মিলিয়ে দিতে চায়। এই মেলানোর ভবিষ্যৎ কিন্তু ভালো নয়।
হোটেলের রিসিপশনে থাকা ছেলেটিও মাঝরাতে মদ আর মেয়ে মানুষ সংগ্রহের নোংরা ইঙ্গিত দিচ্ছে। সে ইঙ্গিত অস্বীকার করায় আমাদের পুরুষত্ব নিয়েই তাচ্ছিল্য করছে সে। এমনকি পরে আমাদের হেনস্তা করার পাঁয়তারা করেছে।
ফেওয়া লেক
পোখরায় ফেওয়া লেকের ধারে বসে আছি। এক তরুণ এসে হাজির। তার হাত ভর্তি উল্কি। সুন্দর করে হেসে বললো, ‘হ্যালো স্যার, হাউ আর ইউ’। কুশল বিনিময় করলো। জানতে চাইলো কেমন লাগছে পোখরা। আমি বললাম, ‘ইটস সো সিনিক অ্যান্ড পিসফুল’। এটুকু আর বলিনি যে রাতের পোখরা এতো সিনিকও নয়, পিসফুলও নয়। এক কথা দু’কথার পর জানালো সে ট্যাটু আর্টিস্ট। সবিনয়ে জানতে চাইলো, আমি ট্যাটু করাবো কি না? আমি বললাম, ‘মাই মাম উইল কিল মি, অ্যান্ড আই এম আ মুসলিম।’ কিন্তু চোরায় না-শুনে ধর্ম কথা। সে ইনিয়ে-বিনিয়ে বোঝাতে থাকলো, ট্যাটু জিনিসটা কতো ভালো। যখন আমাকে বুঝ দিতে পারছে না, সে নিজের টিশার্ট খুলে ফেললো, তার সারা শরীর ভর্তি ট্যাটু, একেকটা ট্যাটুর মাহাত্ম্য বোঝাতে থাকলো। যখন সে সুনিশ্চিত হলো যে, আমি ট্যাটু করাবোই না, তখন হুট করে বললো, ‘ক্যান ইউ বাই মি আ ড্রিঙ্ক মিস্টার’? আমি ধাক্কা খেলাম। আরে, এই অফার তো ছেলেরা মেয়েকে করে, কিংবা মেয়েরা ছেলেকে। যতোটুক ইংরেজি জানি আর পাশ্চাত্য সংস্কৃতি বুঝেছি তাতে বুঝি, ‘আমাকে একটু পান করাও’ মানে হলো ঘনিষ্ঠ হওয়ার ইঙ্গিত। এই ইঙ্গিত আমাকে একটা পুরুষ দিচ্ছে অপূর্ব সুন্দর ফেওয়া লেকের বেঞ্চে বসে। আমি হতভম্ব! এবার তার উদাম শরীরটার দিকে তাকাতেও আমার অস্বস্তি হতে লাগলো। আমি বুদ্ধের নাম জপে সামনে পাহাড় আর লেকের জলের দিকে মনোসংযোগ করলাম। লোকটা আমাকে ধ্যানস্ত দেখলো বোধহয় দু’তিন মিনিট। তারপর যা বললো তাতে বজ্রপাতের মতো, আমি সরে গেলাম। সে ইংরেজি-হিন্দি মিলিয়ে বোঝাতে চাইলো, তুমি খুব মিষ্টি, তোমাকে আমার ভালো লেগেছে, চলো আমার সাথে, আমিই তোমাকে পান করাবো, ম্যাসাজ দিয়ে দিবো, বিনা পয়সায় ট্যাটু করিয়ে দিবো, আমার জায়গাটা সুন্দর, চলো।
আমি তড়িঘড়ি করে বললাম, ওই দেখো, আমার বন্ধুরা আসছে, আজ আমরা প্যারাগ্লাইডিংয়ে যাবো, আজ সময় নেই। সে জানতে চাইলো, আমরা কোন হোটেলে উঠেছি, কতো নাম্বার রুমে। আমি অন্য একটা হোটেলের রুম নাম্বার দিয়ে দিলাম। আমার ফোন নাম্বার জানতে চাইলো, আমি বললাম, আমি ফোন ব্যবহারে অতো দক্ষ নই, এখানে এসে সিমকার্ড নেইনি। এর মধ্যে সত্যিই আমার সফর সঙ্গীদ্বয় এসে হাজির। ওদেরকে এক পশলা বকা দিলাম― তোরা কেন এতে দেরি করলি, সাজগোজ করছিলি নাকি! ওরা নাস্তা খাওয়ার আগে আমার বকা খেয়ে আহত। আমি ওদের চেয়ে বেশি ওই লোকটাকে আহত করে উঠে পড়লাম। দ্রুত বললাম, চল পাহাড়, প্রকৃতি বহুত দেখলাম, নাস্তা খাই, আজ কিন্তু আমি ইংলিশ ব্রেকফাস্ট করবো।
নাস্তার টেবিলে ওরা পুরা ঘটনা শুনে ব্যাপক হাসাহাসি করলো। একজন বললো, ‘আপনার প্রেমে পড়ছে, গেলেই পারতেন।’ আমি তখনও পুরো ব্যাপারটা হজম করতে পারিনি। পরে ভেবেছি, আরে, আমাদের রমনা পার্কে বেড়াতে গেলে পিচ্চিরা বাদাম নিয়ে আসে, বাদাম বিক্রির চেয়ে বিরক্ত করে বেশি। এখানে তো দেখি তারচেয়ে বেশি বিরক্ত করে লোকজন। এ তো নিজেকেই বিক্রি করতে চায়, তাও আবার বিনা পয়সায়। দুনিয়াটা কেমন বেচাকেনার জায়গা হয়ে গেলো সেই নিয়ে আমি ওদের একটা সংক্ষিপ্ত বক্তৃতাও দিয়ে ফেললাম। ওরা যে নাস্তার সঙ্গে আমার ফ্রি বক্তৃতা পছন্দ করেনি সেটা আমি লিখিত গ্যারান্টি দিতে পারি।
ছবি: লেখক
ঢাকা/লিপি