ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

পিছিয়ে গেলেও বইমেলা ভালো হবে: ফরিদ আহমেদ 

শিহাবুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:১৬, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৮:২০, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১
পিছিয়ে গেলেও বইমেলা ভালো হবে: ফরিদ আহমেদ 

ফেব্রুয়ারিতে নয়, মার্চের মাঝামাঝি হবে একুশে গ্রন্থমেলা। এর কারণ এখন আর কারো অজানা নয়। দেশের অন্যান্য শিল্পের মতো, প্রকাশনা শিল্প করোনাসৃষ্ট মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কতটা সহায়ক হবে এবারের গ্রন্থমেলা? প্রকাশকরা কী ভাবছেন, পাঠকের প্রস্তুতিই-বা কী, করোনা সতর্কতায় মেলায় কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে- ইত্যাদি বিষয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেছেন, বাংলাদেশের প্রকাশকদের অন্যতম সংগঠন জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ও সময় প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শিহাবুল ইসলাম।

রাইজিংবিডি: করোনাসৃষ্ট এই মহামারির সময়ে গ্রন্থমেলা কেমন হওয়া উচিত বলে প্রত্যাশা করছেন?
ফরিদ আহমেদ: আমরা মনে করছি, পিছিয়ে গেলেও বইমেলা ভালো হবে। কারণ আমাদের পাঠক-প্রকাশক সবাই বইমেলা চায়, সংস্কৃতিমনা যারা আছেন তারা মেলার জন্য অপেক্ষা করছেন। যদি ঝড়-বৃষ্টি হয় তাহলে কিছুটা বিঘ্ন ঘটতে পারে। এছাড়া ভালো হবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা।

রাইজিংবিডি: ঝড়-বৃষ্টির আশঙ্কার কথা বলছেন; সেক্ষেত্রে স্টলগুলো কীভাবে তৈরি করা হবে সে বিষয়ে বাংলা একাডেমির সঙ্গে আপনাদের আলোচনা হয়েছে কিনা? 
ফরিদ আহমেদ: প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। যিনি মেলার ডিজাইন করবেন তার সঙ্গে বাংলা একাডেমি কথা বলেছে বলে আমাদের জানানো হয়েছে। আমরা কিছু পরামর্শ দিয়েছি। বাংলা একাডেমিরও নিজস্ব কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। দর্শনার্থী আসার পর বৃষ্টি শুরু হলে তাদের আশ্রয় নেওয়ার জন্য শেড বানানো হবে। এমনিতে স্টল বানানোর জন্য টিন ব্যবহার করা হয়, এবার হয়তো কিছুটা বর্ধিত করে দেওয়া হবে। আর যারা স্টল বানাবেন তারা বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেবেন বলেই আমার বিশ্বাস।

রাইজিংবিডি: বইমেলার স্টলের ভাড়া গতবারের চেয়ে অর্ধেক করা হয়েছে- বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন?
ফরিদ আহমেদ: না, স্টল ভাড়া গতবার যা ছিল এবারও তাই আছে। তবে সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর কাছে আমরা সমিতির পক্ষ থেকে আবেদন করেছিলাম, প্রণোদনা হিসেবে এবারের বইমেলার স্টল ভাড়া কমিয়ে দেওয়ার। তিনি যাচাই-বাছাই করে তার রেঞ্জের মধ্যে যতটুকু করা যায়, তার মধ্যে থেকে স্টলের ৫০ শতাংশ ভাড়া বাংলা একাডেমিকে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দিয়ে দেবেন। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, স্টল ভাড়া কমানো হয়নি। বরং ৫০ শতাংশ প্রকাশকদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে, বাকি ৫০ শতাংশ টাকা বাংলা একাডেমি মন্ত্রণালয় থেকে পাবে। এভাবে ভাড়াটা কমার কারণে কিছুটা সহযোগিতা অন্তত হলো।

রাইজিংবিডি: দীর্ঘ সময় মানুষ ঘরবন্দি প্রায়। স্কুল-কলেজ বন্ধ। তরুণরা এ সময়ে অনেকটা বাধ্য হয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ইন্টারনেটমুখী- বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
ফরিদ আহমেদ: ফেইসবুক, সিনেমা দেখেই হোক বা নেট থেকে জ্ঞান অর্জন করা যায় না। জ্ঞান অর্জন করার জন্য আসলে জ্ঞানের যে ভাণ্ডার আমাদের সেখানেই যেতে হবে। লাইব্রেরিতে যেতে হবে, বইয়ের কাছে যেতে হবে। আমাদের তরুণরা অবশ্যই বইমুখী। আধুনিক প্রযুক্তি তারা ব্যবহার করে, কিন্তু তারা বইবিমুখ নয়। পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে তারা বই থেকে দূরে আছে। এজন্যই আমরা বইমেলা হোক চাচ্ছিলাম। আমাদের মূল ধারাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। আমার খুব বিশ্বাস, বইমেলা শুরু হলে সেই ধারাটা আবার ফিরে আসবে।

রাইজিংবিডি: বই বিপণন ব্যবস্থাকে গতিশীল ও অগ্রমুখী করতে কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন সমিতির পক্ষ থেকে?
ফরিদ আহমেদ: বই বিপণন আসলে ব্যবসায়ীক ব্যপার। সমিতি ব্যবসায়ীকদের সংগঠন কিন্তু এটা অবাণিজ্যিক। আমাদের রেজিস্ট্রেশন দেওয়াই হয় অবাণিজ্যিক হিসেবে। তো আমরা যে কাজটি করি, সেটা হচ্ছে বিপণন বৃদ্ধির চেয়ে পাঠক বৃদ্ধি। বই পাঠের প্রবণতা বৃদ্ধি, বই পাঠের উপকারিতা এবং আমাদের প্রকাশকদের বইয়ের তালিকাগুলো বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছানো- এ কাজগুলো আমরা কিছু কিছু করেছি।

রাইজিংবিডি: সমিতির পক্ষে আরও কোন কোন বিষয়ে ভূমিকা নেওয়া উচিত ছিল, যা নিতে পারেননি?
ফরিদ আহমেদ: আপনি যখন কোনো একটি প্রতিষ্ঠান চালাবেন, তখন আপনার সামনে যেগুলো আসবে সেগুলো নিয়ে প্রাথমিকভাবে কাজ করবেন। এবং সামনে যেগুলো আসেনি সেগুলো সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করবেন। আমাদের পরিচালকেরা যখন যে বিষয়টি সামনে নিয়ে আসার মতো মনে করেছেন, সেটি সামনে নিয়ে এসেছেন। সেগুলো নিয়ে আমরা কাজ করেছি। গত তিন বছরের মধ্যে গত এক বছর তো করোনা ছিল, তো গত দুই বছর আগে যে কাজগুলো হয়নি এরকম অনেক কাজ আমরা করেছি।

রাইজিংবিডি: যেমন?
ফরিদ আহমেদ: যেমন প্রকাশকদের স্কিল বাড়ানোর জন্য আমরা কোর্স বা ওয়ার্কশপ করেছি। নিজেদের ব্যবস্থাপনায় নিজেরা করেছি। আমরা আমাদের ফান্ড সংগ্রহ করেছি, ট্রেইনার জোগার করেছি। মুদ্রণ বিশেষজ্ঞ, লেখক, সাংবাদিক সবাইকে ইনভলব করেছিলাম এর সঙ্গে। এটা একটা বড় কাজ মনে করি। তারপর আমরা আরো বড় একটি কাজ করেছি- বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে, বঙ্গবন্ধু বা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক যতো গ্রন্থ আছে তার তালিকা করেছি। সেই তালিকা এখন কাজে লাগছে। বিভিন্ন জায়গায়, ব্যাংক, অফিসে বঙ্গবন্ধু কর্নার হচ্ছে। অথচ বইয়ের সংখ্যা জানা নেই। ফলে তারা এই তালিকা থেকে উপকৃত হচ্ছেন। এছাড়া শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য, ভালো ফলের জন্য তাদের আমরা অনুষ্ঠান করে সম্মাননা দিয়েছি।

রাইজিংবিডি: আমরা অনেক সময় নীলক্ষেত থেকে নকল বই পাই। এতে মূল প্রকাশনা কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই প্রেক্ষাপটে জানতে চাই যে- বাংলাদেশে পাবলিকেশন্স ব্যবস্থাটা কোন পর্যায়ে রয়েছে?
ফরিদ আহমেদ: এটা নিয়ে জানুয়ারি মাসেও কপিরাইট রেজিস্টারের সঙ্গে মিটিংয়ে অংশ নিয়েছি। সমিতির অফিসেও সেমিনার করেছি। সেখানে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে ইনভলব করেছি। সবচেয়ে বড় কথা কি জানেন, সৃজনশীল প্রকাশনার সঙ্গে যারা জড়িত তারা কিন্তু সবাই সৃজনশীল মানুষ। লেখক থেকে শুরু করে প্রকাশক সবাই। পাইরেট মানে দস্যুতা। এর সঙ্গে ক্রিমিনালরা জড়িয়ে রয়েছে। কোথাও হয়তো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ধরলো, পরে থানায় যাওয়া, আদালতে যাওয়া-  এগুলোতে আর উৎসাহ পাই না। সরকারের যদি এমন কোনো নিয়ম থাকতো, পাইরেসিগুলোর ক্ষেত্রে তারা ব্যবস্থা নিতো তাহলে ভালো হতো।

রাইজিংবিডি: অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ভারতের কলকাতার বই বাংলাদেশে পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু বাংলাদেশের বই কি সে তুলনায় কলকাতায় পাওয়া যায়? যদি না পাওয়া যায় তাহলে করণীয় কী?
ফরিদ আহমেদ: এজন্য আমরা দীর্ঘ দিন থেকে কাজ করছি। একটা সময় বাংলাদেশের বই বাংলাদেশে পাওয়া যেত না। বাংলাদেশে পাওয়া যেত কলকাতার বই। এই অবস্থার পরিবর্তন আমরা করেছি। কলকাতাতেও যেন বাংলাদেশের বই পাওয়া যায় সেজন্য আমরা রীতিমত চেষ্টা করেছি। এবং ওখানে আমরা ইমপোর্টারও তৈরি করেছি। তারপরও বই আরও পর্যাপ্ত করার জন্য আমরা যা করছি- ওদের যে আন্তর্জাতিক বইমেলা, সেখানে আমরা অংশগ্রহণ করছি। আরও অতিরিক্ত কাজ করার জন্য আমরা ১০ বছর আগে ২০১১ সালে আমাদের এই সমিতির আমি সাধারণ সম্পাদক ছিলাম, তখন থেকে আমরা বাংলাদেশ বইমেলা শুরু করি। যেখানে শুধু বাংলাদেশি প্রকাশকরা অংশগ্রহণ করবে। শুধু বাংলাদেশি বই বিক্রি হবে। সেই বইমেলাও ১০ বছর ধরে করে আসছি। এরপর বাংলাদেশি বই কলকাতায় কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে।

রাইজিংবিডি: আন্তর্জাতিক বইমেলা বাংলাদেশে আয়োজন করা যাচ্ছে না কেনো?
ফরিদ আহমেদ: আগে কেউ এই উদ্যোগ নেয়নি। ২০১৯ সালের একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছিলাম- আমাদের আন্তর্জাতিক বইমেলা দরকার। প্রধানমন্ত্রী শুনেছেন, হয়তো তিনি নির্দেশ দিয়েছেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে, মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছে। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক বইমেলা করার প্রস্তুতিও নিয়েছিল, কাজ অনেকটা এগিয়েছিল, কিন্তু ২০ মার্চ থেকে করোনাভাইরাসের জন্য সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়। না হলে অন্তত একটা আন্তর্জাতিক বইমেলা গত বছর আমরা পেতাম।

রাইজিংবিডি: আমরা তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বইমেলা পাচ্ছি!
ফরিদ আহমেদ: করোনা পরিস্থিতি পৃথিবীকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যায় সেটা বলা যায় না। জানি না ভবিষ্যতে কী হবে! আর আমি যে দীর্ঘদিন সভাপতি থাকবো তা তো না। সুতরাং জোর দিয়ে বলা যায় না। 

রাইজিংবিডি: আপনারা সমিতি সফলভাবে পরিচালনা করতে পেরেছেন কিনা- কী মনে করেন?
ফরিদ আহমেদ: আমরা আমাদের মেয়াদে যা করেছি, তা এর আগের যে কোনো মেয়াদের চেয়ে বেশি কাজ হয়েছে। সেটি আমাদের বার্ষিক প্রতিবেদন দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবেন। গত দশ বছরের তুলনা যদি করেন, তাহলে আমাদের দুই বছরে অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশি কাজ হয়েছে কিনা সেটা যারা রিসার্চ করবেন তারা বলতে পারবেন। আমি মনে করি, যে কোনো সময়ের চেয়ে আমরা বেশি কাজ করেছি। আর সফলতা-ব্যর্থতার কথা পাবলিক বলবে, আমার কিছু বলার নাই।
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়