ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘বর্তমানের কবি’ নজরুল

দুলাল আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২৭, ২৭ আগস্ট ২০২১   আপডেট: ১৯:৪৩, ৩১ আগস্ট ২০২১
‘বর্তমানের কবি’ নজরুল

‘বাংলা সাহিত্য-সংগীতের ইতিহাসে শুধু নয়, কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসেও অনন্য বিশিষ্টতার দাবিদার। বাংলা কবিতার ইতিহাসে নজরুলের বিশিষ্টতার দাবি প্রতিষ্ঠা করে প্রধানত তাঁর প্রথম পর্বের কবিতার মৌলিকতা এবং একটি দশকের রাজনৈতিক-সামাজিক আবেগ ধারণ, গদ্যে-পদ্যে, বিশেষত কবিতায়।

বাংলা সাহিত্যের  ইতিহাসে নজরুল একমাত্র কবি যিনি তাঁর প্রতিবাদী লেখার জন্য কারাবরণ করেছেন। বিদেশী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে নজরুলের দ্রোহ ছিল একান্তই তাঁর নিজস্ব। তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠ পৌঁছেছিল সারাদেশের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের চিত্তে ও চেতনায়। কাজী নজরুল ইসলাম মূলত কবি। বিদ্রোহের কবি, সাম্যের কবি, গণজাগরণের কবি, সংগ্রামী কবি, চেতনার কবি, শ্রমজীবি মানুষের কবি, সাম্রাজ্যবাদী শোষণের হাত থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করার প্রয়াসের কবি। ভারত স্বাধীনতার প্রথম প্রেরণা দানের কবি।

নজরুলের কাব্যভুবন, সংগীতভুবন অথবা তাঁর সামগ্রিক সৃষ্টির মধ্যে সৃষ্টিশীলতার সময় কালটি গুরুত্ববহ। পরাধীন দেশে স্বাধীনতার জন্য মানুষের মধ্যে যে গণজাগরণ প্রয়োজন, নজরুল সেখানে অগ্রপথিকের ভূমিকায় এসেছেন। দেশমুক্তির সাধনায় নজরুলের সৃষ্টিশীল শিল্পীসত্তা জ্ঞান ও কর্মতৎপরতায় উদ্বুদ্ধ করেছে জনগণকে। সাম্যবাদী কবিতা কিংবা কোনো প্রকারের তত্ত্বপন্থী কবিতা কখনো যে আদৌ কবিতার স্তরে উঠতে পারে; সেই বিরল ব্যতিক্রমের প্রধান দৃষ্টান্ত নজরুল।

তাঁর আগুনজ্বলা কবিতা কখনো ডাক দিয়েছে সাম্যবাদী চেতনাকে, কখনো বাঙালির অনির্দিষ্ট বিপ্লবকে। বেশীরভাগ সময় যে-বাণী ছড়াতে চেয়েছে-কবিতা, গান ও গদ্য-তার সঙ্গে স্বল্পোন্নত বিশ্বের সাযুজ্য আজ আরও পরিষ্কার দেখা যায়। বলেছেন, ভাঙ, ভাঙ, ভাঙ। অথবা গাইছেন চল্ চল্, চল্,। এই কবির আধুনিকতায় ধুলো পড়েনি। বক্তব্যেও নয়। পরমশাক্ত কবি নজরুল যিনি গড়ার জন্যই ভাঙতে চান। নজরুলের সবকিছুতেই ছিল বিদ্রোহী মন। শাসক নিয়ন্ত্রিত শিষ্টাচারের সংস্কৃতি পারেনি দেশজ সংস্কৃতির নজরুলকে পরিণত করতে দাসে। ভারতবর্ষের, মুটে-মেথরের কবি বলে নিজেকে শনাক্ত করতেন তিনি সগর্বে। নজরুল নিজের সমাজ,  ঐতিহ্য ও দেশকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন বলেই নিজেকে বিশ্বের কবি মনে করতে পেরেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের পর এই কালের উজ্জ্বলতম কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনকেন্দ্রিক ক্ষণস্থায়ী হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির পরিবেশে কাজী নজরুল ইসলাম সাম্যবাদী চিন্তা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলা কাব্যক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর রচনার মধ্যে বিভিন্ন ভাবপ্রবাহের সঙ্গে মানবতাবোধের মহামিলনের ফলে তা এক অত্যাশ্চর্য পরিণতি লাভ করেছে। উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে কবি, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তিনি কলম ধরেছেন। মানবতার শক্তির জাগরণের অসামান্য কাব্যরূপ নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা। যেখানে রণক্লান্ত বিদ্রোহী কেবল তখনই  শান্ত হবে “যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল  আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না।” অগ্নিবীণা (১৯২২), বিষের বাঁশী (১৯২৪) ও ভাঙার গান (১৯২৫) কাজী নজরুল ইসলামকে রবীন্দ্রপরবর্তী নতুন কাব্যচেতনায় নায়কত্বের আসনে বসিয়েছে।

কবি নজরুল লক্ষ্য করেছেন, তৎকালীন হিন্দু-মুসলমানের বিরোধের এক প্রধান কারণ হিন্দুর ‘ছুৎমার্গ’। একথা বিশ্লেষণ করে ‘ছুৎমার্গ’ প্রবন্ধে তিনি লিখেন, “হিন্দু হিন্দু থাক, মুসলমান মুসলমান থাক, শুধু একবার মহাগগনতলের সীমাহারা মুক্তির মাঝে দাঁড়াইয়া মানব তোমার কণ্ঠের সেই সৃষ্টির আদিম বাণী ফুটাইয়া বল দেখি, ‘আমার মানুষ ধর্ম’। দেখিব, দশদিকে সার্বভৌম সাড়ার স্পন্দন কাঁপিয়া উঠিতেছে। মানবতার এই মহাযুগে একবার গন্ডী কাটিয়া বাহির হইয়া আসিয়া বল যে, তুমি মানুষ, তুমি সত্য।”

কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যভাবনার এক প্রধান অংশ জুড়ে আছে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি কামনা। স্মরণযোগ্য যে, সমগ্র আধুনিক বাংলা কাব্যের ইতিহাসে কাজী নজরুল ইসলামই একমাত্র কবি, যিনি সমান দক্ষতার সঙ্গে হিন্দু-ও মুসলমান উভয় ঐতিহ্যকে আপন কাব্যে ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছেন। উভয় ঐতিহ্য থেকে অবলীলাক্রমে তিনি বিষয়, উপমা, রূপক, বাকভঙ্গি প্রভৃতি আহরণ করেছেন। তিনি একদিকে যেমন বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কালীকীর্তন রচয়িতা (রাঙ্গাজবা, ১৯৩৬), তেমনি অন্যদিকে তিনি বাংলা ইসলামী গানের প্রবর্তক (জুলফিকার, ১৯৩২) এবং কাব্যে আমপারা (১৩৩৩), মরুভাস্কর (১৩৬৪) প্রভৃতিরা প্রণেতা। নজরুলমানসে হিন্দু ও মুসলমান বৈপরীত্যের দ্যোতক না হয়ে পরিপূরক হতে পেরেছে তাঁর সাম্যবাদী চিন্তার ফলে। হিন্দু-মুসলমান মিলনকামী গান ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ যে গ্রন্থে মুদ্রিত হয় সেই সর্বহারাতেই (১৯২৬) সাম্যবাদ বিষয়ক তাঁর অনেক কবিতা  সঙ্কলিত হয়। প্রত্যক্ষভাবে নজরুল কবিমানসের মানবতাবোধ তথা সত্যসন্ধানের প্রকাশ ঘটেছে সাম্যবাদী (১৯২৫), সর্বহারা (১৯২৬), ফণিমনসা (১৯২৭),সন্ধ্যা (১৯২৯) ও প্রলয়শিখা (১৯৩০) কাব্যগ্রন্থসমূহে। এসব কাব্যে কবি সব ‘ব্যবধান’ উত্তীর্ণ হয়ে মানুষের জয়গান করেছেন।

মানুষ মহীয়ান বলেই ধর্মান্ধতা কবির অপ্রিয়। তাই ‘মানুষ’ কবিতায় একই সঙ্গে তিনি ধর্মান্ধ পূজারী ও ধর্মান্ধ মোল্লাদের কঠিন ভাষায় ভর্ৎসনা করেছেন। কবির মতে, ‘হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই’ এবং ঈশ্বরকে পেতে হলে ‘শাস্ত্র না ঘেটে ডুব দাও সখা সত্যসিন্ধু জলে’। শুধু ধর্মীয় ব্যবধান নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সকল বৈষম্য বিলোপের সম্ভাবনাপূর্ণ দিনের কল্পনা করেছেন কবি। এই কল্পনা, সত্যপ্রিয়তা ও মানবতাবোধ কবিকে নারীর মর্যাদা সচেতন করেছে। কুলি ও মজুরের অসম্মানে তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং চাষীর অধিকারের বাণী উচ্চারণ করেছেন। কবির চেতনা একই সঙ্গে বিশ্বাস ও আবেগের দ্বারা সমর্থিত। তাই তাঁর অনুভবের প্রকাশ একই সঙ্গে আন্তরিক ও তীব্র। কবির লক্ষ্য শাসক ইংরেজের বিতাড়ন এবং পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচন। তাই হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার (১৯২৬) সময়ও তিনি আশা করেছেন: ‘যে লাঠিতে আজ টুটে গম্বুজ, পড়ে মন্দির চূড়া/সেই লাঠি কালি প্রভাতে করিবে শত্র“-দুর্গ গুড়া।” (“হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ”,ফণি-মনসা)।

১৯২২ সালে কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত অর্ধসাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ প্রকাশিত হয়। পত্রিকার শিরোভূষণ আশীর্বাণীতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন: ‘আয় চলে আয় রে ধূমকেতু/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,/দুর্দিনের এই দুর্গশিরে/উড়িয়ে দে তোর বিজয়-কেতন!/ অলক্ষণের তিলকরেখা/রাতের ভালে হোক না লেখা,/জাগিয়ে দে রে চমক মেরে/আছে যারা অর্ধ-চেতন।”

বস্তুতপক্ষে কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী বাংলার তারুণ্যের প্রতিমূর্তি। বিশ শতকের প্রথম চার দশকের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান প্রসঙ্গ ইউরোপ সম্পর্কে মোহভঙ্গ ও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম। সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের পর কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা, গান ও বক্তব্যই তৎকালীন তরুণ বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করে। ১৯২৯ সালে কলকাতার এ্যালবার্ট হলে আয়োজিত ত্রিশ বছর বয়সে নজরুল সংবর্ধনা সভার সভাপতি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, প্রধান অতিথি সুভাষচন্দ্র বসু ও অন্যদের ভাষণে এ কথাই উচ্চারিত হয়।

১৯৪২ সালের জুলাই মাসে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হবার পূর্ব পর্যন্ত মাত্র দুই দশকের সাহিত্য ও সঙ্গীত সাধনায় নজরুল বাংলা কবিতা ও কাব্যগীতিতে সুষ্পষ্ট স্বকীয়তার সাক্ষর রেখে গেছেন। মধুসূদন,রবীন্দ্রনাথ ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পর নজরুলই বাংলা কবিতার ছন্দে মৌলিক সমৃদ্ধি সংযোজন করেছেন। নজরুলের আগে মোহিতলাল ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ভারতচন্দ্রের মতোই কেবল মুসলিম প্রসঙ্গে আরবি-ফার্সি শব্দ ব্যবহার করেছেন। নজরুলই প্রথম বিষয় নিরপেক্ষভাবে আরবি-ফার্সি-তুর্কি শব্দাবলী তাঁর কবিতায় ব্যবহার করেছেন এবং ঐ সব শব্দ বাংলা শব্দ-ভান্ডারের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

নজরুলের কবিতা ও গান তাঁর পরবর্তী কবিদের উপর দ্বিবিধ প্রভাব ফেলেছে। একদিকে তাঁর আদর্শে উদ্বুদ্ধ একদল কবি মানবতাবাদী ও সাম্যবাদী চিন্তাকে গ্রহণ করেছেন অন্যদিকে তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের বৈপ্লবিক ইসলামের আদর্শে উদ্বুদ্ধ তাঁর কবিতাবলী ও ইসলামী গান তৎকালীন বাঙালী মুসলিম তরুণ কবি-সম্প্রদায়কে অনুপ্রাণিত করেছে। নজরুল সাহিত্য ও সংগীত সাধনা করেছিলেন পরাধীন দেশে, যে পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্যে তাঁর লেখা গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত হয়। একের পর এক। কবিকে গ্রেফতার করা হয়। আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। জেল হয়। জেল জুলুমের প্রতিবাদে অনশন করতে হয়। আর তিনি কিংবদন্তীর নায়কে পরিণত হন।

কিন্তু পরাধীন যুগের ওই কবির মন মানসিকতা ও সৃষ্টি কর্মে পরাধীনতার কোনও ছোঁয়া নেই। নজরুলের সৃষ্টির ভুবনে তিনি স্বাধীন। নজরুলের স্বাধীন চিত্ততার যে জাগরণ তা তার সুস্থাবস্থায় কোনও দিন লয় হয়নি। যদিও বলেছেন কবি, “আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি-আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম।” নতুন সৃষ্টির সাধনা ছিল নজরুলের শিল্পীসত্তার মূল প্রেরণা ও প্রবণাতা আর সেই জন্যেই সমাজ, সংস্কৃতি, শিল্প সর্বক্ষেত্রে পুরাতন 
ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধ ভাঙার জন্যে তিনি বিদ্রোহী। তাঁর প্রবণতা ও আনন্দ ছিল নিজের জন্যে আলাদা পথ তৈরি করে নেওয়া। অর্থ্যাৎ নতুন নতুন সৃষ্টিতে নব ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সৃষ্টি করা।  

নজরুল করেছিলেনও তাই। সে কারণেই নজরুলের আগের বাংলা সাহিত্য বা সংস্কৃতি এক নয় বরং স্বতন্ত্র। আর সে স্বাতন্ত্র্যের স্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুল নিজেকে বলেছিলেন, ‘বর্তমানের কবি।’ কিন্তু কালের কষ্টিপাথরে যাচিত হয়ে আজও ষ্পষ্ট নজরুল কালের কবি।  

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়