ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

নামে পূজা কাজে আড়ম্বর: যতীন সরকার 

স্বরলিপি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪৭, ১৪ অক্টোবর ২০২১   আপডেট: ১৮:০০, ১৫ মার্চ ২০২২
নামে পূজা কাজে আড়ম্বর: যতীন সরকার 

যতীন সরকার। রাজনীতি, সংস্কৃতিচর্চা, লেখালেখি, শিক্ষকতায় তিনি আদর্শনিষ্ঠ এবং পাণ্ডিত্যসম্পন্ন। সমাজতন্ত্রের প্রতি আস্থাবান এই প্রাবন্ধিকের লেখায় রয়েছে গভীর মননশীলতা এবং মুক্তচিন্তার স্বাক্ষর। অসাধারণ বাগ্মিতা তার আরেকটি গুণ। দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে বহু পুরস্কারে ভূষিত যতীন সরকারের এই সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তরুণ কবি স্বরলিপি 

স্বরলিপি: শারদ-শুভেচ্ছা। স্যার, কেমন আছেন? দীর্ঘদিন আপনার নতুন কোনো লেখা আমরা পাচ্ছি না।

যতীন সরকার: তোমাকেও শুভেচ্ছা। ৮১ বছর বয়সের পর থেকে গত পাঁচ বছর আমি ‘আউট অব অর্ডার’ হয়ে গেছি। ১৪২৩ সনে শেষ লেখা লিখেছি। এরপর আর এক অক্ষরও লিখি নাই, লিখতে পারি না। ঘরে থাকি, ঘরের মধ্যে একটু হাঁটতে চেষ্টা করি। পত্রিকার আয়োজনগুলো কেমন হলো দেখা হয় না। আমার কাছে কোনো পত্রিকা আসে না; একটি জাতীয় দৈনিক রাখি। সেটা পড়ি। আমাকে ‘যন্ত্রমূর্খ’ বলতে পারো। কোনো অনলাইন পত্রিকা পড়ি না। ফোনে কেউ কল দিলে কথা বলতে পারি— এই যা। কেউ কেউ মাঝেমধ্যে কথা বলে, হয়তো কোথাও সাক্ষাৎকার ছাপা হয়, কিছু জানি না। কিন্তু আমি ভালো থাকি।

স্বরলিপি: ‘বনেদি বাড়ির পূজা’ কালক্রমে হয়ে উঠলো ‘সর্বজনীন পূজা’। আপনার অভিজ্ঞতা থেকে এই বিবর্তন কীভাবে বর্ণনা করবেন? 

যতীন সরকার: হিন্দু সমাজের মধ্যে নানারকম ভাগ, অস্পৃশ্যতা ছিল, যারা ধনী তারা দুর্গাপূজা করতো। অন্যরা সেই পূজা দেখতে যেত। বিষয়টি ছিল— ‘আনন্দময়ীর আগমনে, আনন্দে গিয়েছে দেশ ছেয়ে।  হেরো ওই ধনীর দুয়ারে দাঁড়াইয়া কাঙালিনী মেয়ে’র মতো।
মানুষ তো অন্যের দুয়ারে বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকতে চায় না। গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের আগে ‘বারোয়ারি পূজা’র প্রচলন ছিল না। এখন প্র্যাকটিক্যালি ব্যক্তিগত পূজা প্রায় নেই বললেই চলে। এর ভেতর দিয়ে সমাজের একটি রূপ পরিষ্কার; সমাজ থেকে অস্পৃশ্যতা দূর হয়ে গেছে। কাজেই ‘বারোয়ারি পূজা’ সর্বজনীন রূপ নিয়েছে।

স্বরলিপি: আপনার শৈশবে দেখা দুর্গাপূজা সম্পর্কে জানতে চাই। 

যতীন সরকার: শৈশব কেটেছে নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার চন্দপাড়া গ্রামে। গ্রামের নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা পূজার আয়োজন করতে পারতো না। শুধু চন্দ বাড়িতে দুর্গাপূজা হতো এবং শাস্ত্রসম্মতভাবে হতো। পূজা করতে হতো আচার্য ব্রাহ্মণ দ্বারা তৈরি মূর্তি দিয়ে। যে কোনো লোকের বানানো মূর্তি দিয়ে পূজা করা হতো না। বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনলেন দেবেন্দ্র দাশ। তিনিসহ গ্রামের অন্য কায়স্থরা ব্রাহ্মণের মতো পৈতা নিলেন এবং নিজেকে ব্রাহ্মণ ঘোষণা করলেন। পাকিস্তান আমলের আগে ১৯৪৬ সালের দিকে হবে। সেই দেবেন্দ্র দাশ শুধু পৈতা ধারণ করলেন না, তিনি নিজের হাতেই মূর্তি তৈরি করে পূজার প্রচলন করলেন। প্রতি পূজায় আগের বছরের মূর্তিটাই নিজেদের পুকুরে বিসর্জন দিতেন। তার এই কাজের ফলে ব্রাহ্মণরা তাকে সমাজচ্যুত করলেন। দেবেন্দ্র দাশ এ সবের ধার ধারলেন না। সমাজের অন্যান্য কায়স্থদের অনেকেই তার পথ অনুসরণ করল। আমাদের চন্দপাড়া গ্রামের পাশের নন্দীগ্রামে কয়েকটা কায়স্থ পরিবারও নিজেরাই দেবেন্দ দাশের মতো পূজা করা শুরু করলো। তারপর ধীরে ধীরে সর্বজনীন পূজার প্রচলন হলো আমাদের এলাকায়। হিন্দু বর্ণবৈষম্য কেটে সব বর্ণের অংশগ্রহণে শুরু হলো 
দুর্গাপূজা।

স্বরলিপি: এখন সমসাময়িক ঘটনা কিংবা ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে মণ্ডপ সাজানো হয়, এমনকি কোথাও কোথাও দেবীকে সেভাবেই তুলে ধরা হয়। অর্থাৎ একটা ‘থিম’ থাকে। এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বলা যায়। অন্যদিকে সমাজ বাস্তবতায় আসুরিক কার্যক্রমও বেড়েছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

যতীন সরকার: পূজা সর্বজনীন হলো, কিন্তু পূজায় শিষ্টাচারের গণ্ডি অনেকাংশে ভেঙে গেল। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে আনুষাঙ্গিক নানান বিষয়ের আধিপত্য শুরু হলো। মূল থেকে সরে গিয়ে ‘থিম’ রক্ষা করা যায় কীভাবে! সমাজের মানুষ এখন উৎসবমুখর কেন? প্রশ্নগুলো মানুষ হারিয়ে ফেলার ফলে এখন যে পূজা হয় তার সঙ্গে প্রকৃত দুর্গাপূজার কোনো সম্পর্ক নাই। দুর্গাপূজা ব্রাহ্মণ করে চলে যায়, কি মন্ত্র পড়ে না-পড়ে; কেউ শোনে বলেও মনে হয় না। আসল কথা হচ্ছে উৎসব। দুর্গাপূজাকে উপলক্ষ্য করে ‘মূর্তি বানানো’, ‘কার মূর্তি কত সুন্দর হলো’, ‘কারা অনুষ্ঠানে কত গান-বাজনা করতে পারলো’ এসব এখন বিবেচ্য।

কৃত্তিবাস ওঝা রামায়ণে লিখেছেন, রাম স্বয়ং দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন। রাম রাবণবধের নিমিত্তে দুর্গাপূজা করেছিলেন। সেই থেকে দুর্গাপূজার প্রবর্তন। এ হলো পৌরাণিক কথা। এ কথা কিন্তু বাল্মীকি রামায়ণে নাই! ষোড়শ শতাব্দীর দিকে রাজশাহীর তাহেরপুরের এক জমিদার কংস নারায়ণ তখনকার দিনে সাড়ে ৮ লাখ টাকা খরচ করে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। দুর্গাপূজার আড়ম্বর শুরু হলো সেই থেকে। এখন তো আড়ম্বরটাই প্রধান।

স্বরলিপি: মহালয়ায় পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তর্পণ করতে হয়। মহালয়া থেকেই শুরু হয় দেবীপক্ষের সূচনা। কিন্তু… 

যতীন সরকার: শোনো বলি, সব কিছুতে আনন্দের উপলক্ষ্য খুঁজলে ভাবগাম্ভীর্য থাকে না। ভাবগাম্ভীর্য আসে গভীর চিন্তা থেকে। আগে দেখতে হবে মানুষের গভীর চিন্তা করার প্রবণতা আছে কিনা? তর্পণ-রীতি পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। এখন তারা কি পূর্বপুরুষদের স্মৃতি ধারণ করে, বহন করে নাকি পূজার একটি অংশ হিসেবে এতে অংশ নেয়— প্রশ্ন হলো এটা। আমি বলবো, কাজের কাজ আসলে কিছুই হচ্ছে না। তুমি একটু আগে থিমেটিক পূজার কথা বলছিলে, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ভারতভূমির জাতীয়তাবাদী ধারণা প্রসারের জন্য দুর্গাপূজা হতো। এই ধারায় যদি হয় তাহলে সমাজের সর্বশেষ এবং সর্ববৃহৎ অসঙ্গতী দূর করার জন্য অথবা সর্বজনের মুক্তি যাতে, তাই অর্জন করার জন্য পূজা হওয়ার কথা। সেটা তো হচ্ছে না। মূল কথা হলো এসব থিম-টিম কিছু না। পূজার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে আমোদ-প্রমোদ। ভালো যে ব্যাপারটা ঘটেছে তা হলো, দুর্গাপূজা এখন গণমানুষের উৎসব। হিন্দু ধর্মের লোকজন ছাড়াও অন্য ধর্ম, গোত্রের মানুষ এই উৎসবে অংশ নেয়। বাঙালি হিন্দুরা এই উৎসবকে নিজেদের সঙ্গে করে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। তারা উৎসব ঘিরে একত্রিত হচ্ছে। আনন্দ উদযাপন করছে। আগে সমস্যা ছিল— খেলে জাত যায় না, বললে জাত যায়-এর মতো। এখন অবস্থা হয়েছে— নামে পূজা কাজে আড়ম্বর। 

স্বরলিপি: খেলে জাত যায় না, বললে জাত যায়— বুঝতে পারিনি!

যতীন সরকার: তোমরা তো জানো আমি বস্তুবাদী মানুষ। ছোটবেলা থেকেই আমার আচরণে তার প্রভাব ছিল। একটি ঘটনা বলি, ছোটবেলায় বায়না ধরলাম কালীবাড়ির পূজায় যাব, প্রসাদ খাব। ঠাকুমা বললেন ‘না, ওখানে প্রসাদ খাওয়া যাবে না।’ তার কারণ ছিল ওখানে নমঃশূদ্ররা প্রসাদ দেবে। আমিও ইঁচড়েপাকা! বললাম, খাবোই। কালীবাড়ির পূজায় গেলাম এবং প্রসাদ খেয়ে গল্পটা অন্যদের কাছে বলে বেড়াতে লাগলাম। ঠাকুমা মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘খেয়েই যখন ফেলেছিস, বলে বেড়াতে হবে কেন?’

হা হা হা, তার মানে খেলে জাত যেত না, বললে জাত যেত! এই অবস্থা থেকে একটি সমাজ এখন বের হয়ে এসেছে। এই পরিবর্তন বৈপ্লবিক। যে কারণে, যা অর্জনের উদ্দেশ্যে বের হয়ে এলো— বর্তমান প্রজন্ম শুধু সেই কারণটা মনে রাখার প্রয়োজন মনে করেনি। 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়