ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘অপরিচ্ছন্ন’ ঢাকায় ইনামুল হকের আক্ষেপের বিষয় ছিল আত্মকেন্দ্রীকতা 

সোহরাব শান্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:০১, ১৬ অক্টোবর ২০২১   আপডেট: ১৬:১১, ১৬ অক্টোবর ২০২১
‘অপরিচ্ছন্ন’ ঢাকায় ইনামুল হকের আক্ষেপের বিষয় ছিল আত্মকেন্দ্রীকতা 

তিনি নিজে দরজা খুলে দেবেন- বিষয়টা আমার ধারণায় ছিল না। কিন্তু তা-ই ঘটল। 
ড. ইনামুল হক শক্তিমান অভিনেতা, নির্দেশক ও নাট্যকার। স্বাভাবিক কারণেই দেখা করতে প্রথমবার তাঁর বাসায় যাওয়ার সময় উত্তেজনা ছিল। তিনি নিজে দরজা খুলে দেওয়ায় আমার জড়তা কাটতে সময় লাগেনি। কথা বলতে শুরু করতেই চলে এলো বিস্কুট-পানি। কিছুক্ষণ পর এলো চা। আমার ইতস্তত ভাব তখনো কাটেনি। বিস্কুট খাওয়ার চেয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়াই নিরাপদ ভাবছিলাম!

সাক্ষাৎকারগ্রহণ চলছে। স্মার্টফোনে রেকর্ড হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলোর নোট নিচ্ছি। কথার ফাঁকে ফাঁকে তিনি বিস্কুট খাওয়ার তাগাদা দিচ্ছেন আমাকে। আমি কথা চালিয়ে যাচ্ছি। পৌণে এক ঘণ্টা পর সাক্ষাৎকার শেষ হলো। তিনি ফের বিস্কুটের প্রসঙ্গ তুললেন।

‘‘আপনারা এখনকার দিনের তরুণ, অনুরোধকে পাত্তা দেন না। আমাদের সময় এমনটা হতো না।’’- বললেন তিনি। কণ্ঠে স্পষ্ট ‘শিশুতোষ অভিমান’। আমি লজ্জিত হলাম। সাক্ষাৎকারগ্রহণের সময় চা-বিস্কুট না নেওয়ার কারণ বললাম হাসিমুখে। তিনি অভিমান ঝেড়ে ফেলে ফের বিস্কুট অফার করলেন। আমি নিলাম। তিনি হাসলেন। আমার মনে হলো- তিনি এক ‘বুড়ো শিশু’।

ঘটনা ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরের। সেই থেকে আন্তরিক যোগাযোগ শুরু। পরে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ১১ অক্টোবর আবারও তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম সাক্ষাৎকার নিতে। সেবার তিনি তাঁকে নিয়ে প্রকাশিত- ‘ড. ইনামুল হকের নাট্যাঙ্গনে পাঁচ দশক উপলক্ষে নৈবিদ্যি আঁখর’ অটোগ্রাফসহ উপহার দিয়েছিলেন। এ ছাড়া নানা সময়ে সেলফোনে কথা হয়েছে আমাদের। প্রতিবারই কাজের কথার ফাঁকে তাঁর স্নেহের পরশে ঋণী করেছেন আমাকে।

ড. ইনামুল হক প্রয়াত হয়েছেন গত সোমবার। রয়ে গছে তাঁর স্মৃতি। তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারের বিষয় ছিল- ‘বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গন’। দ্বিতীয় সাক্ষাতকারের বিষয় ছিল- ‘রাজধানী ঢাকা শহরের রূপান্তর’। প্রসঙ্গত, ড. ইনামুল হকের সাক্ষাৎকার নিয়েছি আমি। এটি ছিল আমার নেওয়া শেষ সাক্ষাৎকার, যা মাসিক ‘কারিকা’য় অনুলিখন করে ছাপা হয়েছিল। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলাম ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে। এখানে ড. ইনামুল হকের সঙ্গে আমার শেষ আনুষ্ঠানিক আলাপের একাংশ অনুলিখন আকারে তুলে ধরলাম, যেখানে তিনি ঢাকা শহরের রূপান্তর নিয়ে কথা বলেছেন-

‘‘১৯৫৮ সালে যে ঢাকা আমি (ড. ইনামুল হক) দেখেছিলাম। যে নগর দেখেছিলাম- তারচেয়ে এখন এর অনেক বিস্তার ঘটেছে। নতুন নতুন দালানকোঠা উঠেছে। ঢাকায় যে সবুজ ছিল, বন-জঙ্গল ছিল- তা এখন নেই।

মেট্রিক পরীক্ষার পর ১৯৫৮ সালে ফেনী থেকে আমি ঢাকায় আসি। ১৯৬০ সালে নটরডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে ভর্তি হই। ১৯৬৩ সালে অনার্স শেষ করি। এরপর রসায়নে এমএসসি করতে ভর্তি হই। সেটা শেষ করেই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করি। নটরডেম কলেজে পড়ার সময় আমি মগবাজারে চাচার বাসায় কিছুদিন ছিলাম। মগবাজার এলাকা তখন বন-জঙ্গলে ভরা ছিল। এখন সেই মগবাজারকে চেনার উপায় নাই। যে সবুজ আভা নিয়ে ঢাকা শহর ছিল, সেটা এখন নেই। এখন বড় বড় দালানকোঠা উঠেছে, শপিংমল হয়েছে। খাওয়া-দাওয়ার অনেক রেস্টুরেন্ট হয়েছে, বড় বড় অফিস হয়েছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের যে নতুন একটা আবহ শুরু হয়েছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা শহরের বিস্তার ঘটেছে। যেহেতু এটা একটা রাজধানী। রাজধানী শহরে পৃথিবীর সব জায়গায়ই ঘনবসতি যেমন আছে, তেমনি বড় বড় অট্টালিকা আছে। আবার কুড়েঘর জাতীয় জিনিসও আছে। টিনশেড আছে। উচ্চ মধ্যবিত্তরা এক রকম। মধ্যবিত্তরা এক রকম। তারপরে নিম্নবিত্ত, তাদের অবস্থা এক রকম। সুতরাং নানা ধরণের মানুষ এখানে দেখতে পাওয়া যায়। ফলে একেক স্তরের সংস্কৃতি একেক রকম। 

ঢাকা শহরে উচ্চ বিত্তদের সংস্কৃতি একরকম। মধ্যবিত্তদের এক রকম। তারপর নিম্নবিত্ত। খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের এক রকম। সুতরাং এরমধ্যে একটা বিচিত্রতা আছে। এই বৈচিত্র যেমন নগরকে নানাভাবে বিচিত্রময় করছে, তেমনি নানা ধরনের অসুবিধাও সৃষ্টি করেছে। কারণ পাকিস্তান আমলে তেমন অবকাঠামো ছিলনা। যত্রতত্র যেমন-তেমন করে শহর বেড়ে উঠছিল। স্বাধীনতার পরপর হঠাৎ করেই নতুন একটা পরিবেশ তৈরি হলো। মুক্তিযুদ্ধের সময় তো মূল ঢাকা শহরটা বলা যায় ‘মিসমার’ হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ সমস্ত কিছু বিধ্বস্ত অবস্থায় ছিল। পাকিস্তানীরা এমনটা করে গিয়েছিল। সেখান থেকে আস্তে আস্তে নতুন করে শহর গড়ে ওঠা- সেটার ক্রমবিকাশ আমি দেখেছি। এখানে চাকরির ব্যাপারও ঢাকা শহর। খেলাধুলার ব্যাপারেও তাই। শিল্প-সংস্কৃতির ব্যাপারেও তাই।

আসলে আমরা সবই ঢাকাকেন্দ্রীক হয়ে গেছি। এই শহরে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের ব্যাপার ঘটছে। স্টেডিয়ামে খেলা হচ্ছে। শিল্পকলা একাডেমিতে নাটক হচ্ছে। গান হচ্ছে। নাচ হচ্ছে। নানা ধরনের  সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এখানে হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে; জেলা-উপজেলা থেকেও দল আসছে। 

আমাদের এই ঢাকা শহরে একেকজনের অংশগ্রহণ একেক দিকে। একেকজনের মুভমেন্ট একেক দিকে। কেউ খেলা পছন্দ করে। স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখছে। কেউ নাটক পছন্দ করে, নাটকপাড়ায় যাচ্ছে। কেউ আবার এসব সংস্কৃতির সঙ্গেই নাই তারা রেস্টুরেন্ট বসে বসে খাচ্ছে। সেটাই তাদের বিনোদন!

অর্থাৎ আনন্দ আহরণের নানা রকমের উপায় ঢাকা শহরে আছে। যেমন খেলাধুলা আছে। তেমনি শিল্প-সংস্কৃতি, নাচ-গান, খেলাধুলা আছে। তেমনি আবার বড়লোকদের সেই ব্যান্ড শো চলছে কোথাও। ঘরোয়াভাবে তারা নানা আনন্দ উপভোগ করছে। ক্লাব আছে। অর্থাৎ একটা স্বাধীন দেশের রাজধানীর যে সকল পরিবেশ থাকা উচিৎ ঢাকা শহরে এর সবই আছে।

এ কারণে অনেক বেশি মানুষ এই শহরে এসে হাজির হয়েছে। হয়তো কাজের জন্যই আসছে। এখানে কর্মযজ্ঞটা এত বেশি যে, কাজ করলে অন্তত খেয়েপড়ে বাঁচা যায়। এই চিন্তায় গ্রামে-গঞ্জে থেকে সবাই ঢাকাসহ বড় বড় শহরগুলোতে ছুটে আসছে। যার ফলে অনেক কিছুই এটার মধ্যে হচ্ছে। বায়ু দূষণ হচ্ছে। শব্দ দূষণ হচ্ছে। 
আমাদের দেশের শহরগুলোতে সবচেয়ে বেশি যেটা আমার খারাপ লাগে, সেটা হচ্ছে অপরিচ্ছন্নতা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যপারে আমরা খুবই উদাসীন। নিজের ঘরটাকে। আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখছি। কিন্তু ঘর থেকে বেরুলেই রাস্তাটা অপরিষ্কার।

বড় বড় অট্টালিকায় থাকা বিভিন্ন অফিসে গেলে আমরা দেখি; ব্যাংকগুলোর এমডি-চেয়ারম্যানের বসার জায়গার পরিবেশ এত সুন্দর যে, ভেতরে ঢুকলে মনে হবে আমরা বাংলাদেশে নেই। মনে হবে কোনো উন্নত দেশের অফিসে ঢুকেছি। কিন্তু অফিসের ঢোকার পথে রাস্তাটা হয়তো অপরিষ্কার। দেশের সংখ্যাগরিষ্ট জনগণ মুসলমান। বলা হয়ে থাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। কিন্তু পরিচ্ছন্নতার দিকে কারো খেয়াল নেই।

শহরের আরেকটা খারাপ দিক হলো- মানুষের মধ্যে আত্মকেন্দ্রীকতা। একই ক্যাম্পাস বা ভবনে হয়তো আমরা আছি, অনেকগুলো ফ্ল্যাট আছে। কিন্তু অন্য ফ্ল্যাটের কারও খোঁজ আমরা নেই না। দেখা যায় পাশের ফ্ল্যাটে বিয়ে হচ্ছে। সাজানো হচ্ছে। বরযাত্রী আসছে-যাচ্ছে। কিন্তু পাশের জনকে যে বলা বা দাওয়াত করা, সেটা হচ্ছে না। এতই আত্মকেন্দ্রীকতা পেয়ে বসেছে আমাদের। একই জায়গায় থাকছি। কিন্তু সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যাপরটি নেই, যেটা একসময় ছিল। এই ধরণের আত্মকেন্দ্রীকতার কারণে পাশের ঘরে কি হচ্ছে সেটাও আমরা খবর পাচ্ছি  না। এই যে অনাকাঙ্খিত বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ঘটছে, এটা হয়তো ঘটতো না যদি আমরা পারস্পরিকভাবে জানতাম-চিনতাম।

প্রোটেক্টেড একটা ব্যাপার এখন শুরু হয়ে গেছে যে, ক্যম্পাসগুলোর (অ্যাপার্টমেন্ট ভবন অর্থে) একজন রিসেপশনিস্ট বসে আছে। ঢোকার আগে অনেক কৈফিয়ত দিতে হয়। ইন্টারকমে বাড়িওয়ালাকে জানাতে হয়। এর পেছনে কারণ হচ্ছে নিরাপত্তাহীনতা। এটা খুব পেয়ে বসেছে আমাদেরকে। এটা খুব দুঃখজনক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গা যেখানে সবাই উচ্চশিক্ষা পাচ্ছে, সবাই সেখানে লেখাপড়ায় ভালো। হয়তো ভালো পরিবার থেকেও এসেছে। কিন্তু দেখা যায় যে, তাদের মধ্যে ভব্যতা-সভ্যতা বা মানবিকতার ভীষণ অভাব। এর অন্যতম প্রধান কারণ আমি মনে করি শহরের পরিবেশটা তাকে একটা উন্মত্ত মানুষে পরিণত করেছে। যেটা একেবারেই অনাকাঙ্খিত।

এই যে মানবিক গুণগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, এটার জন্য আমার মনে হয় আমাদের আবার ‘স্ট্রাগল’ করতে হবে। আমরা যদি আমাদের দেশকে ভালোবাসি। আমাদের স্বাধীনতাকে ভালোবাসি। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটটাকে ভালোবাসি, মুক্তিযুদ্ধের কথাটা চিন্তা করি- এসব চিন্তা যদি প্রত্যেকের মধ্যে জারিত করা যেত, আমার মনে হয় আমরা সুন্দর করে এগুতে পারতাম।’’

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ