ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

রপ্তানি বন্ধ, দামও কম: দিশেহারা কাঁকড়া চাষি

বাগেরহাট প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:৫৫, ১৮ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ২১:০৩, ১৮ জানুয়ারি ২০২১
রপ্তানি বন্ধ, দামও কম: দিশেহারা কাঁকড়া চাষি

করোনাভাইরাসের কারণে চীনে কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। দামও কমে গেছে। এতে লোকসানে পড়ে বাগেরহাটের প্রায় ৬ হাজার খামারি কাঁকড়া চাষ বন্ধ করে দিয়েছেন।

চাষিদের অনেকে দেনা গ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। কেনা-বেচার সঙ্গে জড়িত লক্ষাধিক মানুষ এখন দিশেহারা। ব‌্যাংক-এনজিওর ঋণ এবং মহাজনদের সুদের চাপে চরম বিপাকে পড়েছেন তারা।

তবে মৎস্য বিভাগ বলছে এক হাজার ৬৩ জন কাঁকড়া চাষিকে সরকারি সহায়তা দেওয়া হবে। এটাই এখন কিছুটা আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছে চাষিদের মনে। 

বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার ভাগা গ্রামের কাঁকড়া চাষি পিনাক দাস বলেন, ‘১১ বিঘা জমিতে আমার চারটি কাঁকড়ার খামার রয়েছে। আট লাখ টাকা পুঁজি হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। বর্তমানে চাষাবাদ বন্ধ করে দিয়েছি। কিন্তু ব্যাংক ও দাদোনদারদের চাপে বাড়িতে ঘুমানোর সুযোগ নেই।’

কাঁকড়া চাষে ৪৬ লাখ টাকা পুঁজি হারিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন দিপঙ্কর মজুমদার। কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ থাকায় কাঁকড়া মরে যাওয়ায় এই অবস্থা তার।

দিপঙ্কর বলেন, ‘‘চিংড়ি চাষে নানা প্রকার রোগ বালাইয়ের কারণে তেমন লাভ হচ্ছিল না। পরে ২০১৮ সালে কাঁকড়া চাষ শুরু করি। লাভও ভালো হচ্ছিল। ২০১৯ সালের শেষের দিকে বড় আকারে কয়েকটি কাঁকড়া খামার করি। তবে ২০২০ সালে প্রথম দিকে করোনার থাবায় কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। রপ্তানি বন্ধ ও দাম কমে যাওয়ায় খামারের কাঁকড়া সময়মত বিক্রি করতে পারিনি। কাঁকড়া মরে যাওয়ায় প্রচুর লোকসান হয়েছে।

‘২০২০ সালের শেষের দিকে ধারদেনা করে আবারও চাষ শুরু করি। কিন্তু উৎপাদিত কাঁকড়া সরাসরি চীনে না যাওয়ায় দাম অর্ধেকে নেমে এসেছে। এখন কাঁকড়া বিক্রি করে আমাদের উৎপাদন খরচও উঠছে না।” 

বাগেরহাট সদর, রামপাল ও মোংলাসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার কাঁকড়াচাষিদের একই অবস্থা। কাঁকড়া চাষ বন্ধ করেও স্বাভাবিক থাকতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। আর যারা লোকসানের মুখেও কাঁকড়া চাষের সাথে রয়েছেন, তারাও ব‌্যাপক লোকসানে পড়ছেন। 

কাঁকড়া উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে, কমেছে দাম। এই অবস্থায় চীনে কাঁকড়া রপ্তানি চালু করতে সরকারি পৃষ্ঠ পোষকতা ও বিনাসুদে ঋণ দিয়ে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখারা দাবি জানিয়েছেন চাষিরা।

বর্তমান বাজার দর বিষয়ে বাগেরহাটের কাঁকড়া ব্যবসায়ী সাধন কুমার সাহা বলেন, ‘রপ্তানিযোগ্য কাঁকড়া সাধারণত পাঁচটি গ্রেডে বিক্রয় হয়। যা প্রত্যেক গ্রেডে কেজি প্রতি কমে গেছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। ২০০ গ্রাম (ফিমেল) ওজনের কাঁকড়ার কেজি ছিল দুই হাজার ২০০ টাকা কেজি। বর্তমানে তা ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ১৮০ গ্রামের কাঁকড়া ছিল এক হাজার টাকা। বর্তমানে ৬০০ টাকা। ১৫০ গ্রামের কাঁকড়া ৮০০ টাকায় বিক্রি হতো। এখন তা মাত্র ৪০০ টাকা। একশ গ্রামের কাঁকড়া ছিল ৬০০ টাকা কেজি। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়।
এই দামে কাঁকড়া বিক্রি করে চাষিদের যেমন খরচ ওঠে না। তেমনি ব্যবসায়ীদেরও পড়তে হচ্ছে লোকসানে।’

বাংলাদেশ কাঁকড়া সরবরাহ সমিতির সাধারণ সম্পাদক অজয় দাস বলেন, ‘সারাদেশে দুই লক্ষাধিক মানুষ কাঁকড়া চাষ ও ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত। বাগেরহাটের চাষিদের উৎপাদিত বেশিরভাগ কাঁকড়া বেশি দামে চীনে রপ্তানি হতো। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারনে রপ্তানী বন্ধ হওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছে চাষি-ব্যবসায়ীরা।’

তিনি আরও বলেন, ‘ করোনাকালে বাগেরহাটের চাষিদের শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় ছয় হাজার কাঁকড়ার খামার। চীনে কাঁকড়া রপ্তানিসহ সরকারিভাবে সহযোগিতা না পেলে এসব চাষিরা নিঃস্ব হয়ে যাবে।’

বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. খালেদ কনক বলেন, ‘বাগেরহাটে উৎপাদিত কাঁকড়া চীন, জাপান, মালেয়শিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড ও কোরিয়ায় রপ্তানি হতো। এর মধ্যে চীনেই রপ্তানি হয় ৮০ শতাংশ। হঠাৎ করে চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে চাষি ও ব্যবসায়ীরা যেমন বিপাকে পড়েছে। তেমনি সরকারও রাজস্ব হারাচ্ছে। এ অবস্থায় আমরা চাষিদের ধৈর্য ধারণের পরামর্শ দিচ্ছি।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘সরকারিভাবে বাগেরহাটের এক হাজার ৬৩ জন খামারিকে প্রণোদনা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। বর্তমানে সরাসরি চীনে কাঁকড়া না গেলেও থাইল্যান্ড হয়ে চীনে কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে। এ কারণে দাম কমে গেছে। এতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন চাষিরা।’

মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে, জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সরকারি হিসেবে এক হাজার ৮৫৯টি কাঁকড়া খামার রয়েছে। এসব খামারের চাষির সংখ্যা এক হাজার ৬৭০ জন। তবে বেসরকারি হিসেবে জেলায় কাঁকড়া খামারের সংখ্যা আট হাজারের বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দুই হাজার ৬২৯ টন কাঁকড়া রপ্তানি করা হয়। কিন্তু করোনা প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই বদলে যেতে থাকে সে চিত্র।

টুটুল/সনি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়