ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

এ যুগের এক হতভাগ্য রানার

মহাসিন আলী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪০, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৫:৪৫, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১
এ যুগের এক হতভাগ্য রানার

বয়স ৮৪ বছর। এখনো ডাক নিয়ে ছুটছেন মেহেরপুর প্রধান ডাকঘরের রানার ইউনুচ আলী। চিঠির বস্তা নিয়ে সাইকেল ঠেলে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে দিয়ে আসতে হয় তাকে প্রতিদিন।

আলাপকালে ইউনুচ আলী বলেন, স্বাধীনতার ৪ বছর আগে থেকে ডাক বিভাগের রানারের কাজ করছি।  দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধও করেছি। ভেবেছিলাম স্বাধীন দেশে চিঠির ব্যাগ টেনে ভাল পারিশ্রমিক পাব।  কখনো ভাবিও নাই মুক্তিযুদ্ধ করে ভাতা পাওয়া যাবে। এখন মুক্তিযোদ্ধারা ভাতা পাচ্ছে। তবে আমার ভাগ্যে এই ভাতা জোটেনি। অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসা খরচ যোগাতে আর এ বয়সে দু’জনের দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জন্য আজো সাইকেলে করে ডাক বয়ে বেড়াচ্ছি। মাঝে এক সময় রেশন ছিল। চাল-ডাল, আটা-চিনি, তেল-লবণ খুবই কম দামে পেতাম। তাও জিয়া সরকারের আমলে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের দেওয়া চারটি হাজার টাকা পাই। তা দিয়ে চলতে হয় কোনভাবে। 

ইউনুচ আলী মেহেরপুর সদর উপজেলার বুড়িপোতা ইউনিয়নের গোভীপুর গ্রামের মাঝপাড়ার মৃত ফকির মোহাম্মদের ছেলে। ৩ ছেলে ও ৫ মেয়ের জনক। ৮ ছেলে-মেয়ের বিয়ের পর তারা যে যার মতো অন্যত্র চলে গেছে। জীর্ণ ঘরে অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে কোন রকম বেঁচে আছেন তিনি। 

তিনি বলেন, চাকরি জীবনের প্রথম দিকে মাত্র ২৫ টাকা বেতন আর রেশন তুলে চাকরি করেছি। আজো ওই চাকরি করছি। ৫৪ বছরের চাকরি জীবনে বেতন হয়েছে ৪ হাজার টাকা।

জানতে চাইলে তিনি জানান, মেহেরপুরের প্রথম সারির মুক্তিযোদ্ধা তিনি। ভারতের বেতাই থেকে অস্ত্র ট্রেনিং নিয়েছেন তিনি। কাইয়ূম চৌধুরীর অধীনে তিনি কুষ্টিয়াসহ বিভিন্নস্থানে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। দেশ স্বাধীনের পর আবারও চিঠির ব্যাগ ঘাড়ে তুলে নিয়ে রানানের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভূক্ত হননি। বর্তমানে তার স্ত্রী রহিমা খাতুন প্রেসার, অ্যাজমা ও হার্টের রোগী। তিনি নিজেও চোখে কম দেখছেন।  তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, মাত্র এ কয় টাকা বেতনে একমাসে দু’বেলা খাবো কি? আর নিজেদেরই চিকিৎসা করাবো কি দিয়ে?

মেহেরপুর প্রধান ডাকঘর সূত্রে জানা যায়, জেলার ৩ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে ৩১টি ব্রাঞ্চ পোস্ট অফিস আছে। যেখানে একজন করে ইডিএ (অতিরিক্ত বিভাগীয় সহকারী) পোস্ট মাস্টার, চিঠি বিলিকারী ও রানার রয়েছেন। মাসিক সম্মানি হিসেবে পোস্ট মাস্টার ৪৪৬০ টাকা, চিঠি বিলিকারী ৪৩৫৪ টাকা ও রানার ৪১৭৭ টাকা করে পেয়ে থাকেন। এছাড়া পোস্ট অফিস পরিচালনার জন্য মাসিক সর্বোচ্চ মাত্র ২৫ টাকা ও সর্ব নিম্ন মাত্র ৫ টাকা করে দেওয়া হয়।

মেহেরপুর সদর উপজেলার পিরোজপুর ব্রাঞ্চ পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার মাসুদ হোসেন বলেন, গ্রাম-গঞ্জে ব্রাঞ্চ পোস্ট অফিসের গুরুত্ব আজও কম নয়। প্রতিদিন বিভিন্ন সরকারি অফিসের চিঠি, ব্যাংক-বীমার চিঠি ও বিয়ের তালাকনামাসহ বিভিন্ন ধরণের চিঠি-পত্র এ পোস্ট অফিসের মাধ্যমে আদান-প্রদান হয়ে থাকে। জেলার কয়েকটি ব্রাঞ্চ পোস্ট অফিসের রানার না থাকায় পোস্ট মাস্টারকে সরকারি গাড়িতে ডাক তুলে দেওয়ার জন্য রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এছাড়া কোনো কোনো ব্রাঞ্চে বিলিকারী না থাকায় পোস্ট মাস্টার নিজেই  গ্রাহকের হাতে চিঠি পৌঁছে দিয়ে থাকেন। আর কাজের ক্ষেত্রে এ ব্রাঞ্চের তিনজন কর্মচারীর গুরুত্ব কম নয়। তাই আমাদের তিনটি পদে বেতন/সম্মানি বৃদ্ধিতে সরকারের সুদৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

মেহেরপুর প্রধান ডাকঘরের পোস্ট মাস্টার আব্দুল মোমিন বলেন, ব্রাঞ্চ পোস্ট অফিসগুলোতে আগের মত কাজ নেই। তারপরও প্রত্যেক ব্রাঞ্চ পোস্ট অফিসে প্রতি মাসে প্রায় ১৩ হাজার টাকা সম্মানি দেওয়া লাগে। তবে তিনি তাদের দাবির প্রতি সমর্থন করে বলেন, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের বাজারে তাদের ভাতা বৃদ্ধি করা জরুরী।

মেহেরপুর/টিপু

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়