দাম কমায় দুশ্চিন্তায় মানিকগঞ্জের পানচাষিরা
জাহিদুল হক চন্দন, মানিকগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম
মানিকগঞ্জের একটি পানের বরজ
মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলা পানচাষে বিখ্যাত। এক সময় এ অঞ্চলের উৎপাদিত পান দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানি হতো। সম্প্রতি বন্ধ রয়েছে রপ্তানি। চাষিদের ভাষ্য, ভালো ফলন হওয়া সত্ত্বেও উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি এবং ন্যায্য দাম না পাওয়ায় দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা।
হরিরামপুরের মানিকনগর, কৃত্তিপুর, গারুটিয়া ও ধুলিশ্বর গ্রামের মাঠজুড়ে একসময় ছিল অসংখ্য পানবরজ। এখন ৩০টির মতো বরজ আছে। সকালের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে চাষিরা বরজে যান, কাজ শুরু করেন। কেউ পান পাতা তোলেন, কেউ গাছের গোড়ায় পানি দেন, কেউ আগাছা পরিষ্কার করেন। তবে, তাদের মুখে নেই তৃপ্তির হাসি। সার, কীটনাশক, বাঁশ, পাটখড়ির দাম এবং শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় পান উৎপাদনে খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। পাশাপাশি বাজারে কমেছে পানের দাম। যে কারণে ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত চাষিরা।
মানিকনগর গ্রামের কৃষক লতিফ মিয়া বলেন, “একটা পান বরজের খরচ এখন আগের চেয়ে তিনগুণ বেশি। আগে শ্রমিকের মজুরি ছিল ৬০০–৭০০ টাকা, এখন দিতে হয় ৮০০ থেকে ১,০০০ টাকা। বাঁশ, পাটখড়ি, সার সবকিছুর দাম বেড়েছে। বাজারে দাম না থাকায় বরজে থাকা পানের অর্ধেকই তোলা হয় না।”
মো. আকছেদ নামে অপর চাষি বলেন, “৬৬ শতাংশ জমিতে পানচাষ করতে খরচ হয়েছে প্রায় ৬ লাখ টাকা। বাজারে এখন পানের দাম নেই। অবস্থা এমন যে খরচই উঠছে না। সরকার যদি ভর্তুকি বা প্রণোদনা দিত, তাহলে আমরা টিকে থাকতে পারতাম। বিনা মূল্যে সার-বীজ ও কীটনাশক সরকার অনেক ফসলের জন্য দেয়, পানচাষিরা সব সময়ই বঞ্চিত। কৃষি অফিস থেকেও কোনো প্রশিক্ষণ বা সহায়তা পাই না।”
পানচাষে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ চাষি আলম মিয়া বলেন, “হরিরামপুর একসময় ‘পানের রাজ্য’ নামে পরিচিত ছিল। এখানকার সাঁচি ও গয়াচি দুইটি জাতের পানের সুনাম ছিল দেশজুড়ে। বিশেষ করে সাঁচি পানের রপ্তানি থেকে চাষিরা লাভবান হতেন। রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সেই বাজার হারিয়ে গেছে। আগে ১০০ পাতা পান বিক্রি হতো ৮০ থেকে ১০০ টাকায়, এখন তা নেমে এসেছে ৪০–৫০ টাকায়। ফলে, অনেকে নতুন মৌসুমে আর পান চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। আমরা যদি সহায়তা না পাই, আগামী কয়েক বছরে হরিরামপুরে পানচাষ থাকবে না। বরজ চালানো এখন লোকসানের কাজ।”
নিজের পানের বরজে কাজ করছেন এক কৃষক
বংশপরম্পরায় পানচাষ করছেন লতিফ মিয়ার পরিবার। দাদা-বাবা সবাই এই বরজে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, “আমাদের কাছে এটা শুধু চাষ নয়, জীবনযাপন। এখন যদি পানের দাম না পাই, তাহলে এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।”
মানিকগঞ্জ কৃষি উন্নয়ন কমিটির সমন্বয়কারী নজরুল ইসলাম বলেন, “পান চাষিদের চোখে ভর করছে অনিশ্চয়তার ছায়া। সরকারি সহায়তা আর ন্যায্যমূল্যের নিশ্চয়তা না এলে, হয়তো একদিন হারিয়ে যাবে মানিকগঞ্জের ‘পানের রাজ্য’ হরিরামপুর’।”
হরিরামপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. তৌহিদুজ্জামান খান বলেন, “বর্তমানে প্রায় ৩ হেক্টর জমিতে ৩০টির মতো পানবরজ আছে। সাঁচি পানের রপ্তানি বন্ধ থাকায় এখন গয়াচি জাতের পান বেশি চাষ হচ্ছে। সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় বাজারে দাম কিছুটা কমেছে। আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছি।”
ঢাকা/মাসুদ