হাত পেতে নয়, ফেরি করে সংসার চালান অন্ধ মাবুদ
মোসলেম উদ্দিন, দিনাজপুর || রাইজিংবিডি.কম
প্রবল মনোবল যে একজন মানুষকে আত্মমর্যাদাশীল করে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ দিনাজপুরের আব্দুল মাবুদ। চোখে দেখতে পারেন না, তাতে কী; মনের চোখে পথ চলেন তিনি।
দিনাজপুরের হিলি পৌর শহরের ছোট ডাঙ্গা পাড়া গ্রামের এই বাসিন্দা পেশায় ফেরিওয়ালা। ভাঙারির বিনিময়ে বিক্রি করেন বাদাম, কটকটি আর মিঠাই। তাতে যেটুকু লাভ হয়, তা দিয়ে কষ্টে চলে সংসার।
৬৫ বছর বয়সী আব্দুল মাবুদ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। জন্মের পর থেকেই তিনি চোখে কম দেখতে পেতেন। এখন একেবারেই দেখতে পান না আব্দুল মাবুদ। তার সংসারে আছেন স্ত্রী। তারও বয়স হয়েছে। ছেলে সন্তান থাকলেও তিনি মা-বাবার ভরণ-পোষণ করেন না। তাই, বাঁচার তাগিদে এই অন্ধ বাবা বেছে নিয়েছেন ফেরিওয়ালার কাজ।
প্রতিদিন সকাল হলেই কাঁধে বাহক ঝুলিয়ে পণ্য নিয়ে বের হন অন্ধ আব্দুল মাবুদ। ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার বুট, বাদাম আর মিষ্টি জাতীয় খাবার নিয়ে পৌর শহরের ডাঙ্গা পাড়া, মাঠ পাড়া, চার মাথা, মহিলা কলেজ আর চুড়িপট্টি এলাকায় ঘুরেন। বিভিন্ন ভাঙারি দ্রব্যের বিনিময়ে এসব খাদ্যপণ্য বিক্রি করেন তিনি। প্রায় প্রতিদিন দুপুরে হিলি থানায় নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে মসজিদের বারান্দায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে দেখা এই বৃদ্ধকে। থানার অনেক পুলিশ সদস্য এই অসহায় মানুষটিকে সাহায্য করে থাকেন।
রফিকুল ইসলাম, জাহিদুল ও রাব্বানীসহ কয়েকজন এলাকাবাসী বলেন, প্রায় প্রতিদিন স্বামী-স্ত্রীকে বস্তা নিয়ে হেঁটে যেতে দেখি। তাদের দেখে খুব মায়া লাগে। সন্তান থাকতেও বৃদ্ধ মা-বাবা কেন এভাবে ঘুরে বেড়াবেন? তবে, আব্দুল মাবুদ কারো কাছে হাত পাতেন না। কর্ম করে খান। মাবুদ চোখে দেখতে পান না, মনের চোখ দিয়ে পথ দেখেন। কখনো পথ ভুল হলে কারো মাধ্যমে পথ চিনে নেন।
আব্দুল মাবুদের স্ত্রী বলেন, আমাদের জীবনটা আলাদা। কপালে কষ্ট আছে, তাই এই বয়সেও স্বামীকে নিয়ে কষ্ট করে চলতে হচ্ছে।
অন্ধ মাবুদ হোসেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ছেলেটারে মানুষ করতে পারিনি। অনেক কষ্ট করেছি, নিজেরা না খেয়ে ছেলেকে খাওয়াইছি। পড়ালেখা করিয়েছি, বিয়ে দিয়েছি। আজ সে আমাদের চেনে না, খোঁজও নেয় না। কথা পর্যন্ত বলে না। বাঁচতে তো হবে। তাই, বুড়ো বয়সেও কাজ করি। চোখেও দেখতে পাই না। তারপরও গ্রামে গ্রামে ঘুরে ভাঙারি কিনি। এতে যেটুকু লাভ হয়, তা দিয়ে কোনোরকমে চলি। কষ্ট হলেও শান্তি, অন্যের কাছে হাত পাতি না।
হাকিমপুর (হিলি) থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাজমুল হক জানিয়েছেন, প্রায়ই দেখি, আব্দুল মাবুদ থানা মসজিদে নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে বারান্দায় বিশ্রাম নেন। একদিন তার জীবনের গল্প শুনি। আসলেই দুনিয়ায় বিচিত্র মানুষ বসবাস করে। আমি তাকে সাহায্য করেছি। যেকোনো প্রয়োজনে আমরা যতটা পারি তার পাশে থাকব। আমি মনে করি, এমন অসহায় মানুষের পাশে এসে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া সকলের উচিত।
তিনি বলেন, সচ্ছল সন্তান থাকা সত্ত্বেও বাবা-মাকে এভাবে রাস্তায় দাঁড়াতে হয়। এটি শুধু একটি পরিবার নয়, পুরো সমাজের জন্য লজ্জাজনক। আজ আব্দুল মাবুদ দম্পতির লড়াই আমাদের মনে করিয়ে দেয়, অভাব সব সময় টাকার নয়, কখনো মানবিকতারও হয়।
ঢাকা/মোসলেম/রফিক