ঢাকা     বুধবার   ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ২ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

‘নিষিদ্ধ গাইড’ চালাতে ২ কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ 

জাহিদুল হক চন্দন, মানিকগঞ্জ  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৫৬, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫   আপডেট: ১৩:২৮, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫
‘নিষিদ্ধ গাইড’ চালাতে ২ কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ 

শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল মেধা বিকাশে সরকার গাইড বই নিষিদ্ধ করেছে। তবু, মানিকগঞ্জের অধিকাংশ স্কুলে শিক্ষার্থীদের মাঝে সহায়ক বইয়ের নামে ‘নিষিদ্ধ গাইড’ বই বিক্রির ব্যাপক আয়োজন চলছে। অভিযোগ উঠেছে, বিভিন্ন প্রকাশনীর কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা ঘুষ নিয়ে এসব বই কিনতে উৎসাহ দিচ্ছেন অসাধু শিক্ষকরা। 

চলতি বছরের নভেম্বর মাস থেকে বিভিন্ন প্রকাশনীর প্রতিনিধিরা শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ ও শিক্ষকদের কাছে ঘুষের টাকা নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন। অনুসন্ধান বলছে, বিভিন্ন প্রকাশনীর প্রতিনিধিরা ২ কোটি টাকা ঘুষ বিতরণ করেছেন। ফলে, নতুন বছরের শুরুতেই বাড়তি টাকায় উচ্চমূল্যে এসব নিষিদ্ধ গাইড বই কিনতে বাধ্য হবে শিক্ষার্থীরা। তবে, শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ ও স্কুল শিক্ষকরা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করছেন। 

অনুসন্ধান করে জানা গেছে, সিংগাইর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি গাইড বই চালাতে লেকচার প্রকাশনীর কাছ থেকে ৬৫ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছে। শিক্ষক সমিতির নেতাদের মাধ্যমে এ ঘুষের টাকা স্কুলে স্কুলে পৌঁছে যাবে।

এরইমধ্যে লেকচার প্রকাশনী সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটি ঈশ্বরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আসাদুজ্জামান খান আরিফকে ২ লাখ টাকা, ধানকোড়া গিরীশ ইনস্টিটিউশনের সহকারী শিক্ষক আবুল হোসেনকে ৩ লাখ টাকা, সদর উপজেলার কাটিগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু তাহেরকে এক প্রকাশনী ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছে বলে জানা গেছে। 

শিবালয় উপজেলার উথুলি আব্দুল গনি উচ্চ বিদ্যালয় ও বরংগাইল উচ্চ বিদ্যালয়ে লেকচার প্রকাশনীর গাইড বই পড়তে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিতে শিক্ষকদের উৎকোচ দেওয়া হয়েছে। এভাবে প্রায় দেড় শতাধিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এক ডজন প্রকাশনীর প্রতিনিধিরা ঘুষের টাকা পৌঁছে দিয়েছেন এবং এখনো দিচ্ছেন। 

লেকচার, পপি পাবলিকেশন, গ্যালাক্সি, নিউটন পাবলিকেশন, অনুপম, পুঁথিঘর পাবলিকেশনসহ কমপক্ষে দুই ডজন পাবলিকেশন মাঠে টাকা ছড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। নতুন বছর শুরুর আগে থেকেই শুরু হয়েছে মোটা অংকের টাকার ছড়াছড়ি। জেলার প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ে টাকা নিয়ে ছুটছেন নিষিদ্ধ গাইড সরবরাহকারী পাবলিকেশনগুলোর প্রতিনিধিরা। 

তবে, এই কর্মযজ্ঞে সকল মহলে ঢাকঢাক গুড়গুড় অবস্থা বিরাজ করছে। যারা টাকা ছড়াচ্ছেন তারা এবং গ্রহণকারী এই দুই পক্ষের মধ্যেই নাচতে নেমে ঘোমটা পরার দশা হয়েছে। সবাই বিষয়টি জানলেও অদৃশ্য কারণে চেপে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের নোট বই পড়ার ব্যাপারে উৎসাহী করতে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ উঠলেও তা বিনাদ্বিধায় অস্বীকার করে চলেছেন শিক্ষকরাও। 

সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটি ঈশ্বরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আসাদুজ্জামান খান আরিফ ঘুষ নেওয়ায় বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। সদর উপজেলার কাটিগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু তাহের ব্যস্ততার অজুহাতে মন্তব্য করতে চাননি। ধানকোড়া গিরীশ ইনস্টিটিউশনের সহকারী শিক্ষক আবুল হোসেনকে কয়েকবার মুঠোফোনে চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। 

এদিকে, সিংগাইর উপজেলায় শিক্ষক সমিতির সিন্ডিকেটের মাধ্যমে স্কুলে স্কুলে ঘুষের টাকা পৌঁছে দেওয়ার বন্দোবস্ত শুরু হয়েছে। এ বছর পুরো সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন গোবিন্দল ঘোনাপাড়া মডেল হাই স্কুলের শিক্ষক ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সহ-সভাপতি শহিদুল ইসলাম। বিষয়টি নিয়ে তার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি অভিযোগটি ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন।

সিংগাইর উপজেলায় লেকচার পাবলিকেশনের প্রতিনিধি মো. সাজেদুর রহমানও ঘুষ দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। ঘুষ নেওয়া বা দেওয়ার কথা কেউ সরাসরি স্বীকার করবেন না, এটাই স্বাভাবিক। বিষয়টি তদন্তের দাবিদার। 

তবে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিভিন্ন প্রকাশনীর একাধিক কর্মী এ প্রতিবেদককে বলেছেন, বিভিন্ন স্কুলে গাইড বই সহায়ক হিসেবে চালাতে শিক্ষক সমিতি ও শিক্ষকদের সাথে দেনদরবার করতে হয়। স্কুলের বনভোজন ও উন্নয়নের জন্য টাকা দিতে হয়। বিভিন্ন প্রকাশনীর সাথে প্রতিযোগিতা করে বাজারে টিকে থাকতে তাদের নানা কৌশল অবলম্বন করতে হয়। এটা এই সেক্টরে ওপেন সিক্রেট। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষক আক্ষেপ করে বলেন, “গাইড বই যদি নিষেধই করা হবে, তাহলে তা ছাপানো বন্ধ করলেই তো হয়! প্রকাশনীগুলোও বন্ধ করে দিতে পারে সরকার। সেটি না করে, মূল সমস্যার গভীরে না গিয়ে স্রেফ উপরি উপরি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হচ্ছে। অপরদিকে, তলে তলে শিক্ষার্থীদের বই কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। শিক্ষার এই বাণিজ্য পুরো জাতীর সাথে তামাশা ছাড়া আর কিছু না। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে মূলত শিক্ষা ব্যবস্থার এসব দুর্বলতার কারণে। সবাই জেনে শুনেই না জানার নাটক করছে।”

স্থানীয় অভিভাবকরা জানান, শিক্ষা ব্যবস্থা সৃজনশীল হলেও শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের নীরবতার কারণে জানুয়ারি থেকেই বইয়ের বাজার গাইডে সয়লাব হয়ে যায়। শিক্ষা বছর শুরুর প্রথম থেকেই বাজারে ছাড়া বিভিন্ন প্রকাশনীর চড়া মূল্যের কথিত এ গাইড শিক্ষার্থীদের কিনতে পরামর্শ দেন শিক্ষকরা। স্কুল থেকে শিক্ষার্থীদের হাতে সহায়ক বইয়ের লিস্ট ধরিয়ে দেওয়া হয়। যা মূল পাঠ্যের সাথে সামঞ্জস্যহীন। চড়া মূল্যে বাধ্য হয়ে সেগুলো কিনতে হয়। ডিসেম্বর মাসে প্রশাসনের নজরদারি বাড়ালে এ অনিয়মের কিছুটা লাগাম টানা যাবে।

মানিকগঞ্জ খান বাহাদুর আওলাদ হোসেন খান কলেজের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ নান্নু বলেন, “পাঠ্য বই প্রণয়নে ফাঁকি, ঘাটতি ও ঘাপলা রয়েছে। সঠিকভাবে সৃজনশীল পদ্ধতিতে সিলেবাস ও প্রশ্নপত্র তৈরি করা হলে গাইড বই বাজারে চলার কোন সুযোগই থাকবে না। প্রশ্নপত্র তৈরি করতে দক্ষ শিক্ষকের অভাব রয়েছে। যদি পাঠ্য বই সৃজনশীল পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পড়ার উপযোগী করা হয়, তাহলে গাইড বইয়ের কোনো প্রয়োজনই থাকবে না।”

তিনি আরো বলেন, “পাঠ্য বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায় ব্যাখ্যামূলক না হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের কোনো না কোনো গাইড বইয়ের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট কোম্পানির গাইড বই পড়তে শিক্ষকদের উৎসাহ দেওয়ার বিষয়টি খুবই অনৈতিক। এসকল শিক্ষকের আইনের মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করা উচিত।”

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বিশ্বাস বলেন, “ডিসেম্বর এলেই বিভিন্ন প্রকাশনীর কর্মীরা গাইড বই চালাতে টাকা দিয়ে শিক্ষকদের ম্যানেজ করতে নেমে পড়েন। বেশিরভাগ অসাধু শিক্ষক বনভোজন ও বিদ্যালয় উন্নয়নের নামে প্রকাশনীর কাছ থেকে উৎকোচ নেন। এর বিনিময়ে এসব অসাধু শিক্ষক গাইড বই পড়তে শিক্ষার্থীদের প্রায় বাধ্য করেন। অভিভাবকরা বাড়তি টাকা খরচ করে এসব গাইড বই কিনতেও বাধ্য হন। বাজারে গাইড বই আসার আগেই প্রশাসনের দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।” 

এ বিষয়ে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আমীর হোসেন বলেন, “স্কুল পরিদর্শনের সময় কোনো স্কুলে গাইড বই পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। গত বছর সিংগাইরের একটি স্কুলে গাইড বই পাওয়া গিয়েছিল, বিষয়টি নিয়ে শোকজ করা হয়। গাইড বই পড়ানো হবে না, মর্মে জবাব দেওয়ার থেকে স্কুলটি নজরদারির মধ্যে রয়েছে।” 

তিনি আরো বলেন, “গাইড বই সিন্ডিকেটের সাথে কুলিয়ে ওঠা কষ্টসাধ্য। তারপরও পরিদর্শনের সময় নিষেধ করা হয়। কোন স্কুলে গাইড বই পাওয়া গেলে, কোনো শিক্ষক এসবের সাথে জড়িত থাকলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

সার্বিক বিষয়ে মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, “গাইড বই বিক্রিকালে বা বিতরণকালে কোনো লাইব্রেরি বা স্কুলের কেউ ধরা পড়লে ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন অনুসারে তাকে সাজা প্রদান করা হবে। বিষয়টি নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করা হবে। জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও নির্দেশনা দেওয়া হবে।”

ঢাকা/এস

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়