ঢাকা     সোমবার   ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ৩০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয়: ইন্টারনেট সংযোগেই যত সমস্যা

সাইফুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১৭, ২২ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয়: ইন্টারনেট সংযোগেই যত সমস্যা

বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যাধুনিক করে তুলছে পুরো বিশ্বকে। আর বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হচ্ছে সবার। দেশের শিক্ষা, চিকিৎসা, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ সব খাতেই রয়েছে প্রযুক্তির ছোঁয়া।

করোনায় পৃথিবী থমকে গেলেও ভার্চুয়ালি চলছে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। এদিকে সম্প্রতি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিতে ভার্চুয়াল ইউনিভার্সিটি গড়ার ঘোষণা দেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।

তবে ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের দেশের জন্য কতটা উপযোগী, সেটির সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে কথা হয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মামুন আব্দুল কাইয়ুম। তিনি বলেন, ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয় একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয় বলতে শিক্ষার্থীরা বাসায় থাকবে আর শিক্ষকরা লেকচার দেবে, সেটা নয়৷ ভার্চুয়াল হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা ক্লাসে বসে তাদের প্রয়োজনে অন্য দেশের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে সংযুক্ত হবে। আর সেই পরিবেশটা আমাদের তৈরি করতে হবে৷ ইতোমধ্যেই আমরা ধীরে ধীরে এই ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকেই এগোচ্ছি৷

আমাদের ক্লাসরুম, লাইব্রেরি ডিজিটালাইজ হচ্ছে। তবে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ভার্চুয়াল করতে গেলে বড় ধরনের একটা বাজেট প্রয়োজন৷ সেটি পেতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তাছাড়া, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এই নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে হবে৷

রাজধানীর স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উদ্যান খুবই আশাব্যঞ্জক। তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এর বাস্তবায়ন ও সুফল পাওয়া কঠিন। এক্ষেত্রে দরকার শিক্ষা, ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একটা চৌকস সমন্বয়। আমাদের দেশের তথ্যপ্রযুক্তি কিংবা মোবাইল নেটওয়ার্ক এখনও আশাব্যঞ্জক নয়। শহরাঞ্চল আর গ্রামাঞ্চলের মধ্যে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের বিস্তর ফারাক রয়েছে।

তাছাড়া শিক্ষকদের মাঝে প্রযুক্তি নির্ভর ক্লাসের ভীতি ও দক্ষতার অভাব রয়েছে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগের বিস্তার ও মোবাইল অপারেটরদের ইন্টারনেট প্যাকেজ আরও সহজলভ্য করার উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়াও, বিভিন্ন অনুষদের জন্য কাস্টমাইজড এবং সুসংগঠিত লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, ভার্চুয়াল মেশিন (ভিএম) বাস্তবায়ন ও কার্যকর করতে পারলে ভার্চুয়াল ক্লাস নির্ভর শিক্ষার সম্ভাবনা দেখি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নোমান হোসেন আদিয়াত বলেন, ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয় বলতে আপাতত যেটা সম্ভব, সেটা হচ্ছে অনলাইন ভিত্তিক পাঠদান ও অন্যান্য কার্যক্রম। যা আদৌ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে উঠবে কি না, সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ, আমাদের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশের প্রান্তিক জনগণকে ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় আনাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে।

প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির অভাব, মানসম্মত ইন্টারনেট সংযোগ, পরিচালনায় দক্ষ লোক, সাইবার সিকিউরিটি এবং সর্বোপরি দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসন ব্যবস্থা তৈরি করাই প্রধান সমস্যা হতে পারে বলে মনে করি৷ সম্ভাবনার কথা বলতে- যেহেতু দেশ উন্নত হচ্ছে, ডিজিটালাইজেশনের দিকে এগোচ্ছে, সেহেতু দেশে ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা আরও উন্নত হবে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী নাদিম ইসলাম নিলয়। তিনি বলেন, বিশ্বায়নের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য ‘ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয়’ গড়ে তোলা একটা যুগোপযোগী পদক্ষেপ হতে পারে। তবে ভার্চুয়াল মাধ্যমে প্রশিক্ষণের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ইন্টারনেট সংযোগ। একটি মোটামুটি ভালো মানের ডিভাইস এবং উচ্চগতি সম্পন্ন ইন্টারনেট প্রয়োজন, যা কি না বাংলাদেশের বেশির ভাগ অঞ্চলে অনেকাংশেই অসম্ভব।

তাছাড়া আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে, প্রযুক্তির ক্ষেত্রে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ বা ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের ব্যাপারে কীভাবে এগোবে? বাংলাদেশে এই প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অপ্রশিক্ষিত জনশক্তির কর্মসংস্থানের সমস্যা হবে কি না, সেটাও মাথায় রাখতে হবে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বর্তমানে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে গবেষণার জায়গা। কিন্তু প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে গিয়ে অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষাকার্যক্রম বা ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয় কতটা কার্যকরী তাতে আমি সন্দিহান।

ভার্চুয়াল পড়াশোনায় শিক্ষার্থীকে কতটুকু মনোযোগী করে তুলতে পারবে, সেটা নিয়ে সংশয় দেখা দিতে পারে। এছাড়াও হাতে-কলমে শিক্ষার ব্যাঘাত, বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যাওয়াসহ নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হবে আমাদের। গবেষণার ক্ষেত্রে কতটুকু কার্যকরী ভূমিকা রাখবে, তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। ভার্চুয়াল শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তোলাটাই হবে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ আমাদের কাছে। দেশে ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয় চালু করার আগে সমস্যাগুলোর সমাধান জরুরি।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী সানজিদা ইসলাম জুঁই বলেন, বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও তৈরি হতে যাচ্ছে ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয়। এখন আশার কথা হচ্ছে, এই দূরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থার ফলে অনেক শিক্ষার্থীর যাতায়াতের ভোগান্তি দূর হবে। এছাড়াও দুর্যোগকালীন সময়ে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত হবে না শিক্ষার্থীরা।

কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ভার্চুয়াল ইউনিভার্সিটি হয়তো কিছুটা হতাশা ডেকে আনবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট ও নেটওয়ার্ক ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে এই শিক্ষাসেবা থেকে বঞ্চিত হবে। এছাড়াও সরাসরি শিক্ষাকার্যক্রম একজন শিক্ষার্থীকে বাস্তব ও ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা প্রদান করতে সক্ষম হলেও ভার্চুয়াল পড়াশোনায় সেই সুযোগটা পাবে না৷ এতে তারা আত্মবিশ্বাস হারাবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী এমরিতা সিদ্দিক বলেন, ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয় নিঃসন্দেহে বর্তমান পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য অত্যন্ত ভালো এবং সময়োপযোগী উদ্যোগ। তবে আমাদের দেশে ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।

আমাদের দেশে তৃণমূল পর্যন্ত এখনো ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছায়নি। আর এই সুবিধাটি ব্যয়বহুল। শিক্ষা যত কম মূল্যে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, ততটাই মানুষ আগ্রহ প্রকাশ করবে। তাই সকলের মাঝে ইন্টারনেট সুবিধা ছড়িয়ে দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। একই সাথে এটির অপব্যবহার না করে সদ্ব্যবহার করার শিক্ষা দিতে হবে। শুধু পুস্তকবিদ্যার উপর নির্ভরশীল না হয়ে সেগুলোর যেন বাস্তবিক জীবনে প্রয়োগ হয়, সেদিকেও মনোযোগ দিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী মাসুদ মোল্লা বলেন, ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব ঘাটতি আছে তারমধ্যে অন্যতম হলো দ্রুত গতির ইন্টারনেট সেবার সহজলভ্য ও সুলভমূল্যে না পাওয়া। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবার খরচ অনেক বেশি। মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের পক্ষে ইন্টারনেটের খরচ বহন করা কষ্টসাধ্য।

সম্ভাবনার জায়গাও আমরা অনেক খুঁজে পাই। আগামী পৃথিবীতে করোনার মতো এমন অনেক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে আমাদের। যার মোকাবিলায় ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা সত্যিই আমাদের স্বপ্ন দেখাবে।

 

রাবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়