ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

গাঁয়ের গন্ধমাখা পথে হেঁটেছি একদিন

নাজমুল হুদা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০৮, ২ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৮:১৫, ২ ডিসেম্বর ২০২০
গাঁয়ের গন্ধমাখা পথে হেঁটেছি একদিন

এখনো পুরোপুরি শীত নামেনি। গ্রামে বইছে শীতল দখিনা হাওয়া। চারপাশে বেজায় ঠান্ডা। সকালের প্রথম প্রহর অবদি থাকে কুয়াশার দাপট। এরপর মিটি মিটি দেখা দেয় পূবের সূর্য। রোদের আলো উঁকি মারে রূপালি কাঠির বেড়া ঘরে। ধীরে ধীরে উষ্ণ হয় পাটকাঠির ঘর। টিনের চালা থেকে উধাও হয় শিশির বিন্দু। ততক্ষণে ঘরে নেই কৃষকরা। জীবিকার তাগিদে মোরগডাকা ভোরেই বেবিয়েছে মাঠে; সোনার ফসল ফলাতে। সবে ঘুম থেকে উঠেই দেখি ঝলমলে পরিবেশ।

শীতের আগেই খেজুর গাছ কেঁটেছে গাছিরা। শীত এলেই তারা সকাল-সন্ধ্যা খেজুর গাছ নিয়ে পড়ে থাকেন। রাতে খেজুর বাগানে যান। সব গাছে হাঁড়ি পেতে আসেন। রাত-ভর গাছ থেকে কাঠি নিগড়ে রস হাঁড়িতে পড়ে। সকালে খুব ভোরে গিয়ে নানা নিয়ে আসেন। এক হাঁড়ি কাঁচা রস আমার জন্য বরাদ্দ। শীতে রোজ তা খেয়েই ঘুম ভাঙে। রস খেয়ে উঠোনে গেলাম। 

এদিকে নানু রসের হাঁড়িগুলো নিয়ে ছোটেন চুলার কাছে। ছাকনিতে ছেঁকে নিচ্ছেন। এরপর চুলার উপর বড় বড় টিনের পাত্রে রস ঢেলে জমিয়ে গুড় তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এখানেও রূপালি কাঠির ব্যবহার। পাটকাঠি আর খড়কুটোয় ঘণ্টা খানেকের জ্বালে রস ঘন হয়ে রূপ নিতে থাকে গুড়ে। গরম ঘন রস নামিয়ে ছোট ছোট খাঁজে ঢেলে গুড়ের চাকা তৈরি করছেন। ঠান্ডা হতেই খেজুরের রস থেকে শক্ত গুড়ে রূপ নিল। দেখতে যতটা না সুন্দর তার থেকে অধিক রসালো। এখান থেকে ছোট এক টুকরো নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

সম্প্রতি ঢাকা থেকে মাদারীপুর এসেছি। লম্বা কর্মব্যস্ততার পর ভ্রমণের জন্য বেছে নিলাম নিজ গ্রাম। লম্বা সময় হলো গ্রামের মানুষের সঙ্গে ভাব নেই। সেই তিন বছর আগের দেখা গ্রামের অনেক কিছুই বদলে গেছে। অনেক কিছুই হারিয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার কারণে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হতে চলেছে। বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখি, গাছপালা ও মৎস হারিয়ে যাচ্ছে। মাদারীপুরে মূল্যবান গাছের সংখ্যা খুবই কম। এখানে কোনো রাষ্ট্রীয় বনভূমি নেই। তবে এই জেলায় নারিকেল, সুপারি খেজুর ও তালগাছ প্রচুর জন্মে।

আড়িয়াল খাঁ নদী ঘেঁষে আমাদের গ্রাম। নাম জালালপুর। গ্রামের সামনে-পেছনে নদী। চরের মধ্যে পড়েছে গ্রামটি। তাই একটু অনুন্নত। তবে বছর কয়েক আগে গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। এতে কিছুটা উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে। তবে আধুনিকতার তেমন ছাপ লাগেনি। শিক্ষার হারেও পিছিয়ে। তবে জাত গ্রাম্য পরিবেশ রয়েছে বটে! বিঘার পর বিঘা খেত রয়েছে। সেখানে ফলে ধান, পাট, সরিষারসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল। এছাড়াও গাছ-গাছালিতে টইটুম্বুর পুরো জেলা।

খেজুরের গুড় খেতে খেতে আড়িয়াল খাঁ নদীর পাড়ে আসলাম। সঙ্গে চাচাতো ভাই জোবায়ের। নদীতে কয়েকজন জেলে নৌকায় করে মাছ ধরছেন। আমরা দু’জন সঙ্গী হলাম তাদের। ঘণ্টা কয়েক কাটিয়ে দিলাম জেলেদের নৌকায়। মাছ ধরার অভ্যাস না থাকলেও সহযোগিতা করেছি তাদের। নৌকায় জমে থাকা নদীর পানি সেচ দিয়েছি। নদীতে এখন আগের মতো মাছ নেই। শীতে নদীর কোথাও কোথাও চর জেগেছে। বিকেলে আবার ভাটা হবে। নদীর ঢেউয়ে কলকলানি শব্দ হৃদয় স্পর্শ করছে। 

মাছ ধরা রেখে ডাঙায় ওঠলাম। আড়িয়াল খাঁ নদীর ওপারের দৃশ্য দেখতে দেখতে নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে গেলাম ফসলের মাঠে। ততক্ষণে সূর্য সামান্য পশ্চিমে নেমেছে। ফসলের ক্ষেত থেকে কিছুটা দূরে মেহগনি গাছের ছায়ায় পাটি বিছিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে কৃষকরা। ছায়াতলে হিমেল হাওয়া বইছে। মনে এক অপরূপ শান্তি। বিশাল গাছের তলায় এমন বিছানা দেখে লোভ সামলাতে পারিনি আমি। অনুমতি নিয়ে পিঠ লাগালাম। কুশল বিনিময় করলাম। জানতে পারলাম, তারা সবাই পৈতৃক সূত্রে আমাকে চেনে। কিন্তু গ্রামে না থাকায় আমি কাউকেই চিনতে পারছি না। তাদের সঙ্গে কথা হচ্ছে, এমন সময় দু’জন কৃষাণি খাবার নিয়ে এলো। আমি বিছানা ছেড়ে তাদের থেকে বিদায় নিতেই আমাকে জোর করে ধরে রাখলো। তাদের সঙ্গে খাবার খেতে দিলো। আহা! আমি না করতে পারিনি। 

এভাবে কৃষকদের সঙ্গে মাঠে বসে খাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার কোনো দিন হয়নি। এই প্রথম। গ্রামের কিছু কিছু ক্ষেতে কলই শাক হয়েছে। মাদারীপুরে কলই শাকের ভাজির সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা হয় না। তাই সবাই ডালের সঙ্গে কলাই শাক দিয়ে পেটপুরে খাচ্ছেন। অমৃত খাবারের স্বাদ নিতে আমিও কৃষক হয়ে গেলাম। সত্যিই অমৃত! খাওয়া শেষে কিছুটা সময় ফের বিশ্রাম নিলাম। কৃষকরা সোনা ফলাতে আবার মাঠে চলে গেলো। আমিও আবার চললাম নদীর বাঁকা পথ দিয়ে। টানা আধা ঘণ্টা হাঁটার পর পৌঁছালাম চরনাচনা হাট। আজ বুধবার। সপ্তাহে শনি ও বুধের দিন হাট জমে।

হরেক রকম পণ্য বিক্রি হয় হাটে। নিত্যপণ্যের দোকানের পাশাপাশি পিঠা-ফুলি, মিষ্টি-সন্দেশ, মন্ডা-মিঠাই, খেলনা-পুতুল, মাটির তৈজষপত্রের দোকানও বসে হাটে। আর বাড়তি আনন্দ দিতে বসে বাউল গানের আসর কিংবা পুঁথি গানের আসরও বসে। ঘুরে ঘুরে হাটের সবকিছুই দেখলাম। জোবায়েরের সঙ্গে গরম গরম ভাপা পিঠে খেলাম। মাঠির চুলোয় মাঠির খাচেই বানানো হয় ভাপা পিঠা। অনন্য রকমের স্বাদ। 

হাট ঘুরতে ঘুরতে সূর্য পড়ে গেলো। কুয়াশা তার চাদর বিছাতে শুরু করলো। শীতল হাওয়ায় ঠান্ডা হতে লাগল শরীর। আর অপেক্ষা করলাম না। ঘরের উদ্দেশে রওনা দিলাম। আবারও নদীর আঁকাবাঁকা মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। চারদিক থম থম। অন্ধকার আর কুয়াশায় ভারি হচ্ছে প্রকৃতি। চাদের উজ্জ্বল আলো মাটিতে পর্যন্ত নামতে পারছে না। ঘণ্টাখানেক থমথমে পরিবেশে হেঁটে চলে আসলাম সেই বেড়া ঘরে। নানু শীতের পিঠা বানাচ্ছেন। চুলোর পাশে শরীরে তা নিয়ে গল্প করছি। এরপর সবাই মিলে শীতের পিঠা খেলাম। নানার পাশে শুয়ে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ। 

মাদারীপুর/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়