রাবির বুকে এক টুকরো বাংলা বিভাগ
আদিত্য রায় রিপন || রাইজিংবিডি.কম
শীত মানেই বনভোজনের ধুম। নিত্য দিনের সমস্ত কাজকর্ম, লেখাপড়া ভুলে গিয়ে বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে মেতে ওঠার আরেক নাম বনভোজন। শীত আসলেই আমাদের দেশে বনভোজনের যেন ধুম পড়ে যায়। শীতকালে বন্ধুদের সঙ্গে বনভোজনে যাওয়ার মজাই আলাদা। আর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুরা হলে তো কোনো কথাই নেই। প্রতিবছরের শিডিউলে কমপক্ষে দু-চারটি বনভোজন তো থাকেই। কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে এলো কোননো এক অদৃশ্য মহামারি আর এলোমেলো করে দিলো আমাদের সব শিডিউল। প্রতিবছর আমরা বিভাগের সবাই মিলে একটি ফ্যামিলি পিকনিক করতাম।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ শুধু একটি বিভাগই নয় একটি পরিবারও বটে। বিভাগের সবাই মিলে প্রতিবছর একটা ফ্যামিলি পিকনিক করতাম। পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ থেকে জ্যেষ্ঠ সদস্যদের মাঝে সম্পর্ক সুদৃঢ় করতেই আমাদের এমন আয়োজন। কিন্তু মহামারি করোনার কারণে ২০২০ এ আমরা এই পিকনিকের আয়োজন করতে পারিনি। তাই বলে ২০২১ সালেও করবো না? তাহলে তো পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে অনেকটা ভাঁটা পড়ে যাবে। তা কি আমরা হতে দিতে পারি?
যদিও মহামারিতে বিভাগের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই এখনো বাড়িতে অবস্থান করছেন। তারপরও বিভাগের টানে, বিভাগের সদস্যদের আত্মার বন্ধনের টানে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন, তাদের নিয়েই সীমিত পরিসরে আয়োজন করলাম সেই ফ্যামিলি পিকনিকের। আয়োজনের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থীরা।
পিকনিকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো স্থান নির্বাচন। সেই উদ্দেশে গত ২৪ জানুয়ারি সন্ধ্যায় সবাই মিলে আলোচনায় বসলাম। কেউ কেউ বললো বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমিতে করবে, আবার কেউ বললো ইবলিশ মাঠে করবে। আবার অনেকেই শঙ্কা করলো এই মহামারিতে ক্যাম্পাসের ভেতর পিকনিক করার অনুমতি মিলবে কি না? দীর্ঘ এক আলোচনা শেষে ঠিক হলো বিভাগের সামনের স্মৃতির সেই স্নান চত্বরেই করা হবে। ডেকোরেশন আর বাজার করার দায়িত্ব দেওয়া হলো শান্ত, মানিক, শফিকুল আর খোরশেদকে।
আমরা সবাই অধীর আগ্রহে বসে ছিলাম খাওয়ার আইটেম কি কি করা হবে সেটা জানার জন্য। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো সবজি খিচুড়ি আর গরুর মাংসের কালা ভুনা করা হবে। কিন্তু পরিবারে তো কয়েকজন সনাতন ধর্মাবলম্বী সদস্যও আছেন। তাদের জন্য করা হবে দেশি মুরগির ভুনা আর খিচুড়ি। সবশেষে রান্নার দায়িত্ব দেওয়া হলো ইসমাইলকে আর দেশি মুরগির ভুনা রান্না করবে আঁখি। মনে মনে অনেক খুশি হয়েছিলাম। কারণ আঁখি অনেক সুন্দর রান্না করে। আবার আঁখির হাতের সেই দেশি মুরগির ভুনা খাবো আলাদা একটা অনুভূতি। যাইহোক শেষে তারিখ ঠিক করা হলো ২৬ জানুয়ারি।
অনেক ইচ্ছা নিয়ে ২৫ জানুয়ারি রাতে ঘুমাতে গেলাম যে সকাল ৮টার মধ্যেই আমি পিকনিক স্পটে পৌঁছাব। পরদিন সকালে শান্ত ফোন দিয়ে বললো দাদা কই? আমি বললাম রেডি হইছি, যাচ্ছি। ফোন রেখে দেখি সোয়া ১০টা বাজে। আমি তখনো ঘুমে। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে পিকনিক স্পটে গেলাম। অনেকটা দূর থেকেই দেখতে পেলাম ইসমাইল রান্না করতেছে। আর তাকে সাহায্য করতেছে ফার্স্ট ইয়ারের কয়েকটা ছোটভাই। একে একে আমাদের বন্ধুদের মধ্যে খোরশেদ, রাশেদ, যমুনা, শহীদ, সাদিক, সোহাগসহ অনেকেই আসলো। কিন্তু যমুনা যখন আসলো তখন তো আমরা কেউ তাকে চিনতেই পারি নাই। যখন ক্যাম্পাস ছুটি হয় তখন ওর ওজন ছিল ৮৩ কেজি আর এখন ৫৭ কেজি! একজন মানুষের এতটা পরিবর্তন হলে কি আর তাকে চেনা যায়? এ নিয়ে অনেক হাসি-ঠাট্টা করলাম। শুনলাম যমুনার ওজন কমানোর রহস্য। তার থেকে টিপ্স নিলো রাশেদ। সবাই অনেক গল্পগুজব করলাম। তারপর সবাই মিলে ঘুরতে বের হলাম।
দীর্ঘদিন পর সবাই মিলে একসঙ্গে ঘুরতেছি অন্যরকম এক ভালো লাগা। ঘোরাঘুরি শেষে সবাই মিলে রাবিসাসের নব নির্বাচিত সভাপতি বিভাগের বড় ভাই শাহীন আলমকে অভিনন্দন জানাতে রাবিসাসে গেলাম। সবাই মিলে একসঙ্গে ভাইকে অভিনন্দন জানালাম। ভাই অনেক প্রীত হলেন। তার সঙ্গে অনেকক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর সবাই মিলে ফিরলাম স্নান চত্বরে।
বেলা তখন গড়াতে শুরু করছে। অপেক্ষা করতেছিলাম বিভাগের সিনিয়র ভাইদের জন্য। তারা সবাই আসলে শুরু করে দিলাম ভোজন পর্ব। সিনিয়র জুনিয়র সবাই মিলে অনেক মজা করে ভোজন করলাম। সবাই বললো রান্নাটা অনেক সুন্দর হয়েছে। বিশেষ করে কালা ভুনাটা নাকি জোস হয়েছে। সবাই তখন ইসমাইলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আর আমি ছোট করে আঁখির কানের কাছে বললাম ‘তোর রান্নার তুলনা হয় না দোস্ত’। সেই কথা শুনে যমুনা বললো ‘তাহলে আমাকেও একটু দে না দোস্ত!’
যদিও এবারের আয়োজনটা অনেকটা সীমিত পরিসরে, খেলাধুলা, অভিনয়, নাচ-গান, আবৃত্তি কিছুই করতে পারিনি তবুও ভালোবাসার কমতি ছিল না। ভোজন শেষে বিভাগের সবাই মিলেমিশে একাত্ম হয়ে গেলাম। মনে হলো এ যেন অনন্তকালের এক অদৃশ্য বন্ধন। যা কোনো দিন ছিন্ন হওয়ার নয়। দীর্ঘ দিন পর সবাইকে একসঙ্গে দেখতে পেয়ে বড় ভাইরা অনেকেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। অনেককেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বাংলা বিভাগ মিশে গেলো পারিবারিক এক আত্মার বন্ধনে।
লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
রাবি/মাহি