ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

করোনা পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস

কবিতা রাণী মৃধা, জবি  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩৯, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২১  
করোনা পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস

আজ ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। কভিড মহামারীর মধ্যে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘মানবকেন্দ্রিক পুনরুদ্ধারের জন্য সাক্ষরতা : কমে আসুক ডিজিটাল বৈষম্য।‘

ইউনেস্কো (UNESCO) আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছিলো ১৭ নভেম্বর, ১৯৬৫ সালে।   ১৯৬৬ সালের ২৬শে অক্টোবর UNESCO’র সাধারণ সম্মেলনের চতুর্দশ বৈঠকে আজকের দিনটিকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়েছিল।  ১৯৬৭ সালে প্রথম এই দিনটি সাক্ষরতা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।  ব্যক্তিগত, সম্প্রদায়ভিত্তিক এবং সামাজিক সাক্ষরতার গুরুত্ব তুলে ধরাই হলো এই দিবসের মূল লক্ষ্য ।  বিশ্বে নানা অগ্রগতি সত্ত্বেও, বিশ্বের ৭৭৩ মিলিয়ন প্রাপ্ত বয়স্ক আজও প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত।

কোভিড-১৯ এর কারণে সারা পৃথিবীতে প্রাথমিক থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থা বিপর্যস্ত।  আর এ কারণেই আজকের দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন না করা গেলেও ছোট-বড় বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সারা পৃথিবীতে দিবসটি পালিত হচ্ছে।    

সাক্ষরতা মৌলিক শিক্ষার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।  সাক্ষরতা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবীয় অধিকার হিসেবে বিশ্বে গৃহিত হয়ে আসছে।  এটি ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক ও মানবীয় উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণযোগ্য।  শিক্ষার সুযোগের বিষয়টিও পুরোপুরি নির্ভর করে সাক্ষরতার ওপর।  

দরিদ্র্যতা কমানো, শিশু মৃত্যু রোধ, সুষম উন্নয়ন এবং শান্তি-সমৃদ্ধি বিকশিতকরণের ক্ষেত্রেও সাক্ষরতা প্রয়োজনীয় হাতিয়ার হিসেবে গণ্য হয়।

সবার জন্য শিক্ষা-এ স্লোগান বাস্তবায়ন করতে সাক্ষরতাকে ভিত্তি হিসেবে মনে করার পেছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে।  একটি মানসম্মত মৌলিক শিক্ষা মানুষকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করে।  সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মা-বাবা তাঁদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে উৎসাহিত হন।  এবং  উন্নয়নের দিকে দেশকে ধাবিত করার ক্ষেত্রে সচেষ্ট ও সরকারকে চাপ প্রয়োগে সহযোগিতা করে থাকেন।

বিশ্বের ৭৭৫ মিলিয়ন মানুষের ন্যূনতম সাক্ষরতায় দক্ষতার অভাব রয়েছে।  প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রতি পাঁচ জনে একজন এখনও শিক্ষিত নয় এবং তাদের দুই-তৃতীয়াংশই নারী।  আজও ৬০.৭ মিলিয়ন শিশু বিদ্যালয়ের বাইরে এবং আরও অনেকে অনিয়মিতভাবে উপস্থিত হয় বা ঝড়ে পড়ে।  এইসব কারণের জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আজকের দিনটি সারা বিশ্বে বিশেষ ভাবে পালিত হয়।

দেশে দেশে সাক্ষরতার সংজ্ঞা প্রচলিত থাকলেও ১৯৬৭ সালে ইউনেস্কো প্রথম সাক্ষরতার সংজ্ঞা চিহ্নিত করে এবং পরবর্তী সময়ে প্রতি দশকেই এই সংজ্ঞার রূপ পাল্টেছে।  এক সময় কেউ নাম লিখতে পারলেই তাকে সাক্ষর বলা হতো, কিন্তু বর্তমানে সাক্ষর হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য অন্তত তিনটি শর্ত মানতে হয়।  আর এই তিনটি শর্ত হলো  (১) ব্যক্তি নিজ ভাষায় সহজ ও ছোট বাক্য পড়তে পারবে (২) সহজ ও ছোট বাক্য লিখতে পারবে এবং (৩) দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ হিসাবনিকাশ করতে পারবে।  আর এই প্রত্যেকটি কাজই হবে ব্যক্তির প্রাত্যহিক জীবনের সাথে সম্পর্কিত।  বিশ্বে বর্তমানে এই সংজ্ঞাকে ভিত্তি করে সাক্ষরতার হিসাব-নিকাশ করা হয়।  ১৯৯৩ সালে ইউনেস্কো এই সংজ্ঞাটি নির্ধারণ করে।  তবে বর্তমানে এটিও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।  অনেক আন্তর্জাতিক ফোরাম বা কনফারেন্স থেকে সাক্ষরতার সংজ্ঞা নতুনভাবে নির্ধারণের কথা বলা হচ্ছে যেখানে সাক্ষরতা সরাসরি ব্যক্তির জীবনযাত্রা পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত হবে ।

এ দিবসটি পালনের মাধ্যমে ইউনেস্কো বিশ্বের মানুষকে জানাতে চায়, সাক্ষরতা-একটি মানবীয় অধিকার এবং সর্বস্তরের শিক্ষার ভিত্তি।  প্রতি বছর একটি বিশেষ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সে বছর সাক্ষরতা দিবস পালন করা হয় ।

সাক্ষরতার নানা ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।  সাক্ষরতার মাধ্যমে শুধু অর্থনৈতিক মুক্তিই নয় বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানসিক মুক্তি আনয়নের মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই এর লক্ষ্য।  কারণ সাক্ষরতা শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখে এবং মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করে।  পাশাপাশি বিশ্ব সম্পর্কে ভালো ধারণা অর্জনেও সাক্ষরতা কাজ করে।

দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তার বাণীতে বলেছেন, দেশের বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে যথাযথ শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করে বাংলাদেশকে উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এক যোগে কাজ করতে হবে।

নিরক্ষরতা জীবন-জীবিকা নির্বাহে পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। বর্তমানে বাংলাদেশে বয়স্ক সাক্ষরতার হার ৭৫.৬ শতাংশ অর্থাৎ ২৪.৪ শতাংশ জনগোষ্ঠী এখনও নিরক্ষর। সরকার দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নের পাশাপাশি সাক্ষরতা ও দক্ষতা উন্নয়নে বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যুরোর মাধ্যমে মুজিব জন্মশতবার্ষিকীতে ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ২১ লাখ নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে স্বাক্ষরতা প্রদানের কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। একইসাথে, ৮ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত বয়সী বিদ্যালয় হতে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী এবং যারা কখনও স্কুলে পড়াশুনা করেনি এরকম ১০ লাখ শিশুর শিক্ষা প্রদান কার্যক্রম চলমান আছে, জানান রাষ্ট্রপতি। 

যিনি লিখতে ও পড়তে পারবেন, এক মাত্র তিনিই জানবেন দেশ ও দেশের বাইরে কোথায় কী ঘটছে।  এটি এমন একটি মাধ্যম, যা পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত নিরসন এবং প্রতিরোধেও কাজ করে। সাক্ষরতার সঙ্গে শান্তির সম্পর্ক বা যোগাযোগ এতটাই বেশি যে অস্থিতিশীল, অগণতন্ত্রকামী এবং সংঘাতপূর্ণ দেশগুলোতে সাক্ষরতার পরিবেশ বজায় রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে বাংলাদেশ সরকারে গৃহীত উদ্যোগের প্রভাব শহর, গ্রামসহ জীবনের নানা ক্ষেত্রে বিস্তৃত।  পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদনের ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের ব্যবহার হচ্ছে।  শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যালয়ে কম্পিউটার প্রদান এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।  দেশের ৪,৫০০টি ইউনিয়নে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্র।  তবে মাত্র ৮ শতাংশ মানুষ জনসমাগম পূর্ণ স্থানে ইন্টারনেট ব্যবহার করে।

বাংলাদেশে ৯০ শতাংশেরও বেশি গ্রামীণ পরিবারে মোবাইল ফোন আছে যার অর্ধেক স্মার্টফোন। এক-তৃতীয়াংশ পরিবারে এসএমএস পাঠানো এবং ৪১ শতাংশ পরিবারের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করার যোগ্যতা রয়েছে।  সাক্ষরতা, বিশেষ করে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কারিকুলামসহ শিখন অগ্রগতি মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ডিজিটাল লিটারেসি-সংক্রান্ত বিষয় অনেকটাই উপেক্ষিত।  আইসিটি সম্প্র্রসারণে একদিকে সাক্ষরতা ও দক্ষতার ঘাটতি, অন্যদিকে বিদ্যুৎসহ ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে।  নানা পর্যায়ে যেসব বৈষম্য বিদ্যমান, সেটি সহজেই কমে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ।  

গত তিন দশকে মৌলিক শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে।  আনুষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় তৈরি হয়েছে নতুন বিদ্যালয় এবং বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ের ফলে বেড়েছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা।  উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো স্থাপনের মাধ্যমে দ্রুত সম্প্র্রসারিত হয় বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম। দেশব্যাপী বাস্তবায়ন করা হয় একাধিক বয়স্ক শিক্ষা প্রকল্প। এতে অল্প হলেও উপকৃত হচ্ছে নিরক্ষর মানুষ। তবে শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা, প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে ঘাটতি এবং অর্জিত দক্ষতা ও যোগ্যতা হারিয়ে ফেলার প্রবণতা নিয়ে সংশ্নিষ্ট মহল বরাবরই উদ্বিগ্ন।  কত শতাংশ মানুষ ধরে রাখতে পারছে তাদের সাক্ষরতা, তার ওপর সাম্প্রতিক সময়ে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত সম্ভবত নেই। খুব কম লোকালয় আছে, যেখানে রয়েছে সবার ব্যবহারযোগ্য পাঠাগার বা অব্যাহত শিক্ষাকেন্দ্র, যা চর্চার জন্য প্রয়োজন। নানা কারণে অধিকাংশ গ্রামীণ পরিবারে এখনও শিখনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি।

লেখক: শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

/মাহি/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়