ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৩ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

ড্যাফোডিল-সিটি ইউনিভার্সিটি সংঘাত, ক্ষতিপূরণ পাবে সিটি

আরিফুল ইসলাম সাব্বির, সাভার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:২৪, ২৭ অক্টোবর ২০২৫   আপডেট: ২২:২৬, ২৭ অক্টোবর ২০২৫
ড্যাফোডিল-সিটি ইউনিভার্সিটি সংঘাত, ক্ষতিপূরণ পাবে সিটি

তুচ্ছ ঘটনায় রবিবার (২৬ অক্টোবর গভীর রাতে ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে।

তবে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পর উভয় প্রতিষ্ঠানের পরিস্থিতি এখন অনেকটা শান্ত, বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সিটি ইউনিভার্সিটি। অবশ্য রাতভর তাণ্ডবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে সিটি ইউনিভার্সিটি ও তার আশপাশের এলাকা। 

আরো পড়ুন:

এদিকে, সোমবার (২৭ অক্টোবর) দুপুরে ড্যাফোডিল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত সিটি ইউনিভার্সিটির পাশে থেকে তারা ক্ষতিপূরণে সহযোগিতা করবে।

সংঘর্ষের সূত্রপাত
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রবিবার রাত ৯টায় আশুলিয়ার খাগান এলাকার ‘ব্যাচেলর প্যারাডাইস’ হোস্টেলের সামনে সিটি ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী মোটরসাইকেল থেকে থুথু ফেললে তা ড্যাফোডিলের এক শিক্ষার্থীর শরীরে লাগে। এতে উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। পরে রাত ৯টার দিকে সিটি ইউনিভার্সিটির প্রায় ৪০-৫০ জন শিক্ষার্থী দেশীয় অস্ত্র ও ইট-পাটকেল নিয়ে ড্যাফোডিল শিক্ষার্থীদের ওই বাসায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেন।

এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহস্রাধিক শিক্ষার্থী ঘটনাস্থলে জড়ো হয়ে সিটি ইউনিভার্সিটির দিকে গেলে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম প্রাথমিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হন।

একপর্যায়ে রাত ১২টার পর ড্যাফোডিলের শিক্ষার্থীরা সিটি ইউনিভার্সিটির ভেতরে ঢুকে শিক্ষার্থীদের অবরোধ করে ভাঙচুর শুরু করেন। এ সময় তারা প্রশাসনিক ভবন, কম্পিউটারসহ গুরুত্বপূর্ণ মালামাল লুট করেন। পুড়িয়ে ফেলা হয় তিনটি বাস ও একটি প্রাইভেটকার। ভাঙচুর করা হয় আরো পাঁচটি যানবাহনে। এতে উভয় পক্ষের অন্তত অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন।

ধ্বংসস্তূপে সিটি ইউনিভার্সিটি
সোমবার সকালে সিটি ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে দেখা যায়, আগুনে পোড়া ভবন ও যানবাহনের ধ্বংসাবশেষ। বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কাঁচ, কাঠসহ ভাঙা আসবাবপত্র। একাডেমিক ভবনের জানালার থাই গ্লাস ভাঙা, ভেতরে ছড়িয়ে আছে ফাইল, ভাঙা কাঁচ, চেয়ার, টেবিল, কম্পিউটার, এসি, ফটোকপি মেশিন, প্রিন্টারসহ নানা জিনিস।

রাতে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে বলেও জানান শিক্ষার্থীরা।

সিটি ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী বলেন, “ড্যাফোডিলের এক ছাত্রের গায়ে থুতু লাগা থেকে ঘটনার শুরু। পরবর্তীতে সে স্যরিও বলেছে। কিন্তু তারা বিষয়টিকে সেভাবে নেয়নি, তাকে সেখানে মারধর করে। এরপর তাকে আটকে রাখে। যখন বিষয়টা আমাদের কাছে আসছে, তখন আমরা এগোই। এভাবেই প্রথম অবস্থায় হয়।”

তিনি বলেন, “আমরা ঢিল ছুড়েছি, এ পর্যন্তই ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তারা ভিতরে ঢুকে অ্যাকাউন্টস থেকে টাকা লুট করেছে, সেখানে কোনো টাকা নাই। পাঁচটা গাড়ি ভাঙছে, প্রত্যেকটা রুমে ভাঙচুর চালিয়েছে, কিছুই নেই। এগুলা কি ধরনের আচরণ, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এগুলো কিভাবে পারে।”

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, “ঘুমন্ত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা হয়েছে। তারা অস্ত্র নিয়ে আসে। মেয়েদের হলের কলাপসিবল গেট ভাঙচুরের চেষ্টা করে, ইট ছুঁড়ে মারে। সেগুলো মেয়েদের গায়ে লাগছে। আমাদের পুরো ক্যাম্পাস ভাঙচুর করেছে।”

সিটি ইউনিভার্সিটির টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আরিফুজ্জামান বলেন, “রাত ১২টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত প্রশাসনের অনেক সহযোগিতা চেয়েছি আমরা। ওরা এসে পুরো ক্যাম্পাসে আগুন দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। শতশত ছাত্রকে মারছে, আহত করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা পাইনি। তারা খাগান পর্যন্ত এসেছে। ড্যাফোডিলের ছেলেরা এখান পর্যন্ত এসে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছিল। কেউ রক্ষা করতে আসেনি।”

তিনি বলেন, “টানা হামলা হয়েছে, কিন্তু কেউ আসেনি। হাজার হাজার ছাত্র এখানে, আমরা খুব অসহায় হয়ে পড়েছি। দুইটা ছাত্রী হল আছে, তারাও আতঙ্কে আছে। আমরা সবাই নিরাপত্তাহীনতায় আছি।”

সিটি ইউনিভার্সিটির প্রক্টর অধ্যাপক আবু জায়েদ বলেন, “ঘটনার সূত্রপাত কিভাবে হয়েছে, সেটি এখনো আমরা নিশ্চিত নই। ছাত্রদের মারামারি থেকে ক্যাম্পাস পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা হতে পারে? এটি পরিকল্পিত। আমাদের শিক্ষার্থী আহতের সংখ্যা আনুমানিক অর্ধশতাধিক হতে পারে।”

আটক শিক্ষার্থীদের হস্তান্তর
ঘটনার পর রাতেই সিটি ইউনিভার্সিটির ভেতরে কিছু ড্যাফোডিল শিক্ষার্থী আটকা পড়ে। সোমবার দুপুরে সিটি ইউনিভার্সিটির প্রক্টর অধ্যাপক আবু জায়েদ জানান, “ইতোমধ্যে তাদের হস্তান্তর করে দেওয়া হয়েছে। তাদের প্রশাসনের কিছু লোকজন এসেছিলেন, তাদের কাছে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

তিনি বলেন, “আমরা তো আর তাদের আটকে রাখিনি, তারা এখানে ঘুরে ফিরেই বেড়াচ্ছিল। কিন্তু যেহেতু তারা অনেকটা আটকা পড়ে গিয়েছিল এবং রাত হওয়ায় আমরা মূলত তাদের সেইফ করার চেষ্টা করেছি। কারণ কেউ যেন তাদের আঘাত করতে না পারে। এজন্য তাদের একটা নিরাপত্তার মধ্যে আমরা রেখেছিলাম। এরপর উনারা এসে তাদের নিয়ে গেছেন।”

ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্স ডিরেক্টর সৈয়দ মিজানুর রহমান বলেন, “ছাত্রদের ছাড়ছে, কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলো তাদের পিটিয়া আধমরা করে ফেলেছে। এছাড়াও ছেড়ে দেওয়ার আগে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সিটির উপাচার্য শিক্ষার্থীদের দিয়ে আমাদের উপাচার্য শিক্ষার্থীদের সেখানে ভাঙচুর করতে পাঠিয়েছে- এমন জবানবন্দিও রাখা হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “মূলত ইউজিসি তাদের মুক্ত করেছে। ইউজিসির প্রতিনিধি দলের কাছে শিক্ষার্থীদের হস্তান্তর করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টোরিয়াল টিম, শিক্ষকরাও ছিল। এখন ওই শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে নিয়ে আসা হয়েছে, তাদের এখন আমরা হাসপাতালে পাঠাচ্ছি। শিক্ষার্থীদের অবস্থা অত্যন্ত গুরুতর, তাদের ব্যাপক মারধর করা হয়েছে।”

দায় শনাক্তে ফুটেজ চেয়েছে ড্যাফোডিল
সোমবার দুপুরে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সংবাদ সম্মেলনে এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্স ডিরেক্টর সৈয়দ মিজানুর রহমান বলেন, “ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে হয়েছে, তা খুবই সামান্য বিষয়। থু থু ফেলাকে কেন্দ্র করে। জানতে পেরেছি, ড্যাফোডিলের একজন শিক্ষার্থীর গায়ে থুথু লেগেছে।”

তিনি বলেন, “বিষয়টি নিয়ে সিটি ইউনিভার্সিটির সেই শিক্ষার্থীর সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয়েছে এবং সেখানেই সেটা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু পরবর্তীতে ব্যাচেলর প্যারাডাইজ নামে ড্যাফোডিল শিক্ষার্থীদের হোস্টেলে একটি সংঘবদ্ধ আক্রমণ করে সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। এটা সবাই জানে, এটাই মূলত সংঘর্ষের সূত্রপাতের জায়গা।”

তিনি আরো বলেন, “এখান থেকেই মূলত সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের প্রতি ড্যাফোডিল শিক্ষার্থীদের একটা উষ্মা জন্মেছে, আমরা একটা আক্রমণের শিকার হলাম। সংঘবদ্ধ আক্রমণের ফলে ব্যক্তি পর্যায়ের বিষয়টি সামষ্টিক পর্যায়ে চলে গেছে এবং এর চূড়ান্ত প্রকাশ হয়েছে। যেহেতু আমাদের এখানে হল আছে, অনেক ছাত্রছাত্রী এবং সংখ্যায় বেশি, তারা সিটি ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে যা করার করেছে। সিটি ইউনিভার্সিটি রাস্তার ওপরে হওয়ায় সেখানে মবের আকার ধারণ করেছে।”

সৈয়দ মিজানুর রহমান বলেন, “এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ স্থানীয় লোকজন যারা জড়িত ছিল, তাদের বের করা কঠিন কাজ। আমরা এখনো অসহায়। এ ক্ষেত্রে সময় লাগবে এবং সিটি ইউনিভার্সিটির কো-অপারেশন লাগবে। তারা যদি আমাদের ফুটেজ দেয়, কোন শিক্ষার্থীরা কি করেছে আমরা শনাক্ত করতে পারব।”

সৈয়দ মিজানুর রহমান আরো বলেন, “সমস্যা হচ্ছে এখনো কিছু শিক্ষার্থী জিম্মি আছে। সেই দায়িত্ব সিটি ইউনিভার্সিটিকেই নিতে হবে। ছাত্র আটকে কোনো সমাধানের আলোচনা হওয়া সম্ভব না। আমাদের উপাচার্য তাদের উপাচার্যের সঙ্গে সঙ্গে কথা বলেছেন, আমি নিজে তাদের উপ-উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা আমাদের অভিভাবক ইউজিসিকে জানিয়েছি এবং এসে বিচার করার অনুরোধ করেছি। কিন্তু যেই বিচারই করা হোক না কেন, প্রথম এবং প্রধান কাজ হচ্ছে- জিম্মি শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।”

পরিস্থিতি এখন শান্ত
সোমবার দুপুরে সাভার থানার ডিউটি অফিসার উপপরিদর্শক (এসআই) হাবিবুর রহমান বলেন, “পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।”

ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস.) মো. আরাফাতুল ইসলাম বলেন, “শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারামারি হয়েছে। পুলিশ ঘটনাস্থলে রয়েছে। ঝগড়াবিবাদ, ভাঙচুর যা হয়েছে রাতেই হয়ে গেছে। আর এ ঘটনা কেনো ঘটল, সেটি আসলে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তবে পরিবেশ কিছুটা থমথমে।”

সিটি ইউনিভার্সিটি বন্ধ ঘোষণা
রাতভর সংঘর্ষের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ অক্টোবর থেকে আগামী ৪ নভেম্বর পর্যন্ত সিটি ইউনিভার্সিটির সব একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। একইসঙ্গে আজ (সোমবার) সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

উপাচার্যের পক্ষে রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মীর আকতার হোসেন সাক্ষরিত জরুরি নোটিশে এ কথা জানানো হয়।

ঢাকা/মেহেদী

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়