ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

গায়ক জুবিনের প্রতি কেন মানুষের এত ভালোবাসা?

আমিনুল ইসলাম শান্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১৬, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫   আপডেট: ১০:৫১, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
গায়ক জুবিনের প্রতি কেন মানুষের এত ভালোবাসা?

মাত্র ৫২ বছর বয়সে ভারতীয় গায়ক জুবিন গার্গের আকস্মিত মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন তার লাখ লাখ ভক্ত-অনুরাগীরা। সিঙ্গাপুর থেকে তার মরদেহ আসামে পৌঁছানোর পর কার্যত থমকে যায় রাজ্যটি। লাখ লাখ শোকাহত ভক্ত-অনুরাগী গুয়াহাটিসহ রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে গিয়ে ভিড় করে; তৈরি হয় ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত; যা একজন সুপারস্টারের তারকা খ্যাতিকেও হার মানায়।

শহরের রাস্তাগুলো কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল, ভালোবাসার জোয়ারে ভেসে আসে মানুষের স্রোত। গান, অশ্রু, প্রার্থনা এবং নিঃশব্দ অভিবাদনে প্রতিফলিত হয় জুবিন গার্গের প্রতি মানুষের গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। লিমকা বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস জানায়, জুবিন গার্গের শোকযাত্রায় প্রায় ২০ লাখ মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন; যা বিশ্বের চতুর্থ জমায়েত। এর আগে সংগীতশিল্পী মাইকেল জ্যাকসন, পোপ ফ্রান্সিস এবং রানি এলিজাবেথ দ্বিতীয় মারা যাওয়ার পর এমন দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। 

আরো পড়ুন:

জুবিনের শোকযাত্রার দৃশ্য দেখার পর একটা প্রশ্ন সবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, তা হলো—শুধু গানের জন্যই একজন মানুষ এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন? না কি জুবিনের গানের অন্তরালে অন্য কিছু লুকিয়ে ছিল? চলুন, এই প্রশ্নের উত্তর উদ্ধারের চেষ্টা করা যাক—

জুবিন গার্গ শুধু একজন গায়ক ছিলেন না; তিনি ছিলেন একজন সৎ ও নির্ভীক ব্যক্তিত্ব। সহজ ভাষায় নিজের মনের কথা বলতেন, যা সাধারণ মানুষ খুব সহজেই বুঝতে পারতেন। ভণ্ডামির বিরুদ্ধে কথা বলতেন জুবিন। গরিবদের পাশে দাঁড়াতেন, সামাজিক ইস্যু নিয়ে সরব হতেন, প্রকৃতি ও প্রাণীদের প্রতি ছিল তার গভীর মমতা ও ভালোবাসা। এই সব গুণই জুবিনকে আসাম ছাড়িয়ে সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতে আইকনে পরিণত করেছিল।

মঞ্চে জুবিনের উপস্থিতি ছিল প্রাণবন্ত, কখনো কখনো অপ্রত্যাশিত। ভূপেন হাজরিকার মতো শান্ত ও মেলোডিক গানে অভ্যস্ত প্রবীণ শ্রোতারা প্রথমে জুবিনকে গ্রহণ করতে একটু দ্বিধায় ছিলেন। কিন্তু তার গানই শেষ পর্যন্ত একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করেছিল অসমীয় সংস্কৃতিতে। প্রেম, আশা, দুঃখ-বেদনা, আনন্দ—সব মিলিয়ে তার গানগুলো ছিল আবেগে ভরপুর, যা সমালোচকদের মনও জয় করে নিয়েছিল।

নানা ধরনের হুমকি ও প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন জুবিন গার্গ। ইউনাইটেড লিবারেশ ফ্রন্ট অব আসামের (ইউএলএফএ) হিন্দি গান নিষিদ্ধ করার নিয়ম উপেক্ষা করে বহু অনুষ্ঠানে হিন্দি গান গেয়েছেন জুবিন। কিছু ধর্মীয় রীতিনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এমনকি, তার নৃত্যশৈলী অনুকরণ করার বিষয়ে রাজনীতিবিদদের সঙ্গে রসিকতাও করেছিলেন জুবিন। ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইন (সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট—সিএএস)-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন। অর্থাৎ জুবিনের প্রভাব কেবল সংগীতেই সীমাবদ্ধ ছিল না; তা ছড়িয়েছিল সমাজের নানা স্তরে। 

জুবিনের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে নানা সময়ে নানা গুঞ্জন ছড়িয়েছিল। পরে এক সাক্ষাৎকারে জুবিন বলেছিলেন—“আমি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নই। আমি একজন গায়ক; যে আমাকে পারিশ্রমিক দেবেন, আমি তার জন্য গান গাইব।”

জুবিনের জীবনে নরম দিকও ছিল। প্রায়ই তার প্রয়াত মা, ছোট বোন জনকির (সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান মাত্র ২৬ বছর বয়সে) কথা ভালোবাসা ভরে বলতেন। জুবিন পশুদের খুব ভালোবাসতেন। পশুদের উদ্ধার করে নামও দিতেন তিনি। তার সাহসিকতা আর কোমল হৃদয় তাকে বিশেষ একটি স্থানে নিয়ে গিয়েছিল, মানুষের মনে তার স্থায়ী আসন তৈরি করেছিল।

১৯৭২ সালের ১৮ নভেম্বর মেঘালয়ের তুরা শহরে অসমীয়া একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জুবিন গার্গ। তার বাবার নাম মোহনী মোহন ববঠাকুর, মায়ের নাম ইলি ববঠাকুর। প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক জুবিন মেহতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মোহন-এলি দম্পতি পুত্রের নাম রাখেন জুবিন ববঠাকুর। কিন্তু পিতা-মাতার পদবি ‘ববঠাকুর’ বহন না করে, তিনি তার ব্রাহ্মণ গাত্রের (গোত্র) উপাধি ‘গার্গ’ গ্রহণ করেন। এই সিদ্ধান্তের ফলে তার একটি স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি হয়—যা বিশ্বজোড়া অনুপ্রেরণার সঙ্গে অসমীয় ঐতিহ্যের ভারসাম্য রক্ষা করে। যদিও ‘মানব ধর্মে’ বিশ্বাসী ছিলেন জুবিন।

জুবিন গার্গ একাধারে ছিলেন গায়ক, সংগীত পরিচালক, সুরকার, গীতিকার, সংগীত প্রযোজক, অভিনেতা ও চলচ্চিত্র পরিচালক। ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত যুব মহোৎসব পাশ্চাত্য একক পরিবেশনায় স্বর্ণপদক লাভ করার পর জুবিনের জীবন বদলে যায়। ১৯৯২ সালে অসমিয়া অ্যালবাম ‘অনামিকা’ মুক্তির মাধ্যমে জুবিন পেশাদার সংগীতজগতে প্রবেশ করেন। ২০০৬ সালে ‘গ্যাংস্টার’ সিনেমায় ‘ইয়া আলি’ গান গেয়ে তাক লাগিয়ে দেন জুবিন। তারপর বেশ কিছু সুপারহিট গান উপহার দেন তিনি। ভারতীয় বাংলা সিনেমার বেশ কিছু সুপারহিট গানের  শিল্পী জুবিন। ৩৩ বছরের ক্যারিয়ারে ৪০টি ভাষায় ৩৮ হাজারের বেশি গান গেয়েছেন এই শিল্পী।   

মাত্র ৩ বছর বয়সে গান শুরু করেছিলেন জুবিন। অসমীয়া লোকসংগীত, শাস্ত্রীয় সংগীত, পাশ্চাত্য এবং বলিউড সংগীত—সব ক্ষেত্রেই দক্ষতা দেখিয়েছেন জুবিন। বলিউড তাকে খ্যাতি ও অর্থ দিলেও, তিনি ফিরে এসেছিলেন আসামে—নিজের মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ ও অনুপ্রেরণামূলক সংগীত তৈরির ইচ্ছায়। পরে বলিউডে খুব একটা কাজ করতে দেখা যায়নি তাকে। আসামের আঞ্চলিক সংগীত নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলেন এই শিল্পী। গত ১৯ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরে মারা যান জুবিন; চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যায় এই গায়কের কণ্ঠ।

ঢাকা/শান্ত

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়