ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

একইসঙ্গে সফল মা ও উদ্যোক্তা জেসমিন

সাজেদুর আবেদীন শান্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৫, ৮ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১৭:০১, ৮ মার্চ ২০২১
একইসঙ্গে সফল মা ও উদ্যোক্তা জেসমিন

জেসমিন আহমেদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকার হাজারিবাগ রায়েরবাজার। ছোট থেকেই স্বপ্নবাজ ও দস্যিপনায় মত্ত থাকা মেয়ে ছিল জেসমিন। কিন্তু হঠাৎ ১৯৯৭ সালে মায়ের মৃত্যু এলোমেলো করে দিয়েছিল জেসমিনের জীবন। তখনই তার বাবার ব্যবসার অবস্থাও খারাপ হয়ে গেলো। দারিদ্র্যতায় জীবনকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ফেলা বাবা ও ছোট ছোট ভাই বোনদের দায়িত্ব তুলে নেন জেসমিন নিজের কাঁধে। 

একদিকে নিজের পড়ালেখা অন্য দিকে সংসার সামলানো আবার পরিবারের জন্য আয় করা। খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়ে জেসমিন। পাশাপাশি পড়ালেখাও চালিয়ে যান তিনি। ঢাকা সিটি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স করেন। ১৯৯৯ সালে পারিবারিক ভাবেই বিয়ে হয় জেসমিনের কিন্তু বিয়ের পরে জানতে পারে শুধু স্বামীর পছন্দের কারণেই শ্বশুর বাড়ির লোকেরা বিয়ে করিয়েছে। ভাগ্যকে মেনে নিয়ে ঘর সংসার সামলান জেসমিন। পারিবারিক কারণে ব্যবসা ছেড়ে দেন তিনি। সব কাজ ছেড়ে দিয়ে তিনি তার ছেলের পেছনে সময় দিতে লাগলেন।

জেসমিন বলেন, ‘‘আমার বড় ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ২০১৭ সালে জন্ম নিলো আমার ছোট ছেলে। ২০১৮ সালে ২৩ জুলাই এক ঝড় আমাকে নতুন করে উদ্যোক্তা বানিয়ে দিলো। সিদ্ধান্ত নিলাম কিছু একটা করবো এভাবে আর না। ২৫ জুলাই শুরু হলো আমার ‘BOKUl’ (অনলাইন ফেসবুক পেজ) এর পথ চলা। 

শুরুতে ফেসবুকে অনলাইনে পেজ খুলে কাজ করলেও আমি অফলাইনেই কাজ করছিলাম। আমি শাড়ি, থ্রিপিস, পাঞ্জাবি ও হোম ডেকোর আইটেম নিয়ে  কাজ করছি। মায়ের কাছ থেকে শেখা কাজ দিয়েই উদ্যোক্তা জীবন শুরু করি। প্রথমে ঢাকার কয়েকটা মার্কেটে পাইকারি বিক্রি করতাম। তখন অনলাইন সম্পর্কে তেমন একটা ধারণা ছিল না। কিন্তু ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ছিলাম।’’ 

তিনি আরও বলেন, ‘‘রাজিব আহমেদ স্যারকে তখন কিছুটা চিনি, একদিন স্যারের একটা পোস্ট দেখি ‘উই’ (উইমেন্স এন্ড ই-কমার্স ফোরাম) গ্রুপে। কিছু না ভেবেই গ্রুপে যুক্ত হই। আর নিয়মিত রাজিব স্যারের পোস্ট পড়তে থাকলাম। তখনো তেমন কিছু বুঝতে পারছিলাম না, বড় ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, সে সব বুঝিয়ে দিলো তারপর থেকে নিয়মিত হয়ে পড়ি উই গ্রুপে। ধীরে ধীরে পরিচিতি বাড়তে থাকে। তত দিনে পৃথিবীতে করোনার রাজত্ব শুরু হয়ে যায়। 

আমি আর আমার উদ্যোগ এক সাথে চলছি। বার বার স্বামী-শাশুড়ির পক্ষ থেকে বাঁধা আসতে থাকে। তারা বলেন, সংসার আর ব্যবসা একসঙ্গে হবে না। যেকোনো একটা বেছে নিতে হবে। শ্বশুর বাড়ির সবাই আমার সামনে বাহবা দিলেও পেছনে পেছনে আমার স্বামীর কাছে নেতিবাচক কথা বলতো। কিন্তু শক্তভাবে পাশে থেকেছে আমার বড় ছেলে। বড় ছেলের টিফিনের টাকা থেকে জমানো ৫০০০ টাকা দিয়েই শুরু আমার উদ্যোক্তা জীবন।  ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকেই বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে আমার স্বামী। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে ব্রেন স্ট্রোক করে আমার স্বামী। আজ প্রায় ৬ মাস ধরে অসুস্থ। দুই ছেলেকে নিয়ে আর আমার উদ্যোগ ‘বকুল’কে নিয়ে এখন আমার জীবন। 

বিজনেসের প্রয়োজনে এক অফিসে যাই, রিসিপশনে আমার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে দাঁড়াতেই এক মাঝবয়সী আপু আমাকে ডাকে বলে, আপনি বকুল না? আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম আপনি আমাকে কীভাবে চেনেন? আপু উত্তর দিলো, জি, আপনি ‘উই’ গ্রুপের সদস্য। আমি আপনার সব পোস্ট পড়ি। আপনার স্বামী অসুস্থ আপনার বাবা ও মারা গেছেন আপনার পোস্ট পড়েই জেনেছি। এটা আমার জন্য বড় পাওয়া, এখন আর আমাকে কেউ বাবা বা স্বামীর পরিচয়ে চেনে না। আজ আমার একটা পরিচয় আছে আমি ‘BOKUL’ এর স্বত্বাধিকারী।’’ 

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘স্বামী পরিত্যক্তা বা বিধবা নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে আর বয়স্ক ও শিশুদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে চাই। আমার এখন একটা কারখানা আছে। যেখানে ৬ জন কারিগর কাজ করে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করছে আরও ১০/১২ জন। এখন একটাই স্বপ্ন ছেলে দুটোকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলা। আর আমার বকুলের তরফ থেকে দেশিও পণ্যকে বিশ্ব বাজারে তুলে ধরা। 

নতুনদের জন্য বলবো, উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষা, ধৈর্য, সাহস আর আত্মবিশ্বাস হচ্ছে একজন উদ্যোক্তার মূল পুঁজি। তবে পুঁজির অভাবেও অনেক স্বপ্নবাজ সৃজনশীল মানুষ উদ্যোক্তা হতে পারছে না। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো বিনা জামানতে শুধু ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে লোনের ব্যবস্থা করলে আরো নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হতো।’’

লেখক: ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী।

ঢাকা/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়