তাতার ছড়া, তাতার গল্প
তাতা আর হাসি, ভাইবোন। হাসি বড়, তাতা ছোট। ছোট ব’লে যে তাতা শুধু ছোট, দুষ্টুমিই করে, তা নয়। খুব ডানপিটে। একদিন তাতা একটা কাঠির মাথায় পোকা বা পোকা জাতীয় কিছু একটা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এটা কাকে লাগানো যায়, ফন্দি আঁটছিল। তাতাদের নিচতলায় মেয়েদের বোর্ডিং। তাতা কাঠিটা নিয়ে সোজা মেয়েদের ঘরে! মেয়েরা যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। কিছুতেই তাতার হাত থেকে কাঠি নেয়া যাচ্ছিল না। উপায় না দেখে কিশোর দোতলা থেকে তাতাকে ডাক দিলেন- গল্প শুনবি তাতা? মজার গল্প লিখেছি। আয়, শুনে যা।
ওহ্, কিশোর কে তা তো বলিনি! কিশোর হলো তাতার বাবা। মনে প্রশ্ন জাগছে না- একটা কিশোর কীভাবে বাবা হয়? এ কিশোর আসলে শিশুকিশোর না। এ কিশোর হলেন উপেন্দ্রকিশোর, উপেন্দ্রকিশোর রায়। ছেলেদের রামায়ণ, মহাভারত লিখেছেন। ভারি চমৎকার বই! ছোটদের কথা ভেবে কঠিন বই দুটিকে তিনি খুব সোজা ভাষায় লিখেছেন। তার এরকম আরো অনেক বই আছে। ইলিয়াড, ওডিসি, রবিনহুড! অনেক বই তিনি তোমাদের জন্য সহজ ভাষায় লিখে গেছেন। সেগুলোর কথা আরেকদিন বলব।
তাতার দুষ্টুমির কথা বলছিলাম! বাবার মুখে গল্প শোনার কথা শুনেই কাঠিটা ফেলে সে টপটপিয়ে দোতলায় উঠে যায়। বাবা গল্প শুরু করলেন-
‘খানিকটা পাখি, খানিকটা জানোয়ার, বিদঘুটে চেহারা, খিটখিটে মেজাজ, ভারি জ্ঞানী, বেজায় ধনী, অসুর ঘ্যাঁঘা মহাশয়, এক মাসের পথ দূরে, অজানা নদীর ধারে, অচেনা শহরে, সোনার পুরিতে বাস করেন, মানুষটিকে দেখতে পেলেই রসগোল্লাটির মতো টপ করে তাকে গেলেন। সেই ঘ্যাঁঘা মহাশয়ের পালক আনতে চলেছে মানিক।’
বাবার গল্প শুনতে শুনতে তাতাও এক সময় গল্প বলা শিখে যায়। প্রথম প্রথম বাবার গল্পগুলো নিজের মতো করে বলত। যেখানে ভুলে যেত সেখানে ইচ্ছে মতো বানিয়ে বলত। তাতা জানে বাবাও গল্পগুলো বানিয়ে বানিয়ে বলে। একদিন তাতা ছোটদের গল্প বলছিল-
‘এক ছিল ঘ্যাংচু। খানিকটা পাখি, খানিকটা জন্তু, তার ইয়া বড় শুঁড়, এত্তো বড় ল্যাজ, আর পিঠের ওপর টিয়া পাখির মতো সবুজ সবুজ ডানা। কেউ যদি কাছে যায়-তো খ্যাঁও-ম্যাওঁ-এ্যাঁও...’
গল্প শেষ হয়নি তখনো। হাসি পেছন থেকে তাতাকে চিমটি কাটে- গুলগল্প করে এদের মিছে ভয় দেখাচ্ছিস? দাঁড়া আমি বাবাকে এখুনি বলছি!
দিদিটা প্রায়ই এমন দিদিগিরি করে। তাতার রাগ হয়। কিন্তু রেগে গিয়ে কি হেরে যাবে তাতা!
তাতা বললো তাহলে এবার একটা সত্যি গল্প শোন-
‘এক ছিল মেয়ে। ভীষণ তার সাহস। ঘোড়ার গাড়ীতে উঠতে গেলে ভিরমি লাগে। রাত্তিরে একলা উঠতে ভয় পায়। বাদুর দেখলে চোখ দুটো টিপ্পে ধরে- উহুঁ-হু করে চেঁচায়। একদিন সে ঠিক করল বিদেশ যাবে। সেই দেশে, যে দেশ কাগজ তৈরি হয় প্রথম। সেই চীন দেশে যাবে মেয়েটি। বেশ তা নয় গেল। কিন্তু তার বাবা যেদিন বললে যে চীনেরা আরশুলা খায়।’
বাকি গল্প কি আর হাসি বলতে দেয়! এতক্ষণে তার বোঝা হয়ে গেছে গল্পটা সম্পূর্ণ তাকে নিয়ে। সে তাতার পিঠে কয়েকটা কিল বসিয়েই ভোঁ দৌড়। তাতা হো হো করে হাসে। অন্যরাও হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে লুটে পড়ে মাটিতে।
তাতার এমন দুষ্টুমিতে হাসি একদিন হাউজ টিউটরকে নালিশ করল। টিউটর তাতাকে কঠিন ধরা দিলেন। তাতার খাতা হাতে নিয়ে বললেন- তাতা, তোমার হাতের লেখা দিনকে দিন বাজে হচ্ছে। আগামী সপ্তাহে তোমার হোমটাস্ক হলো দশ পৃষ্ঠা ইংরেজি, পঁচিশ পৃষ্ঠা বাংলা লিখে আনা।
শুনে তাতার কপালে ভাঁজ পড়ল। এক সপ্তাহে পঁয়ত্রিশ পৃষ্ঠা কি সোজা কথা! তাতা উপায় খোঁজে। বুদ্ধিও বের করল একটা। বাংলা এক পৃষ্ঠা আর ইংরেজি এক পৃষ্ঠা লিখে বাকিটা ছেপে নেবে। নিজের ঘরেইতো ছাপাখানা। কিন্তু ব্রজকাকু পাশের ঘরে পত্রিকার জন্য লেটারিং করে দিন রাত। ছাপাতে গেলে তার হাতে নিশ্চিত ধরা। শেষে ব্রজকাকুকে খুলে বলল বিষয়টা। ব্রজকাকু শুনে হেসে খুন-হাতের লেখা কেউ ছাপায় রে বোকা! বাবার মতো গল্প কবিতা লেখ, আমিই তোকে বই ছেপে দেব।
আর কি! তাতা খাতা নিয়ে বসে গেল। কিন্তু কি কবিতা লিখবে! শেষে ঠিক করল নদী নিয়ে লিখবে। কারণ, কদিন আগে রবি ঠাকুরও নদী নিয়ে কবিতা লিখেছেন। বাবা সেটার ছবি এঁকেছেন। নদী নিয়ে অনেক কিছু শুনেছে বাবার কাছে। কিভাবে নদী জন্মায়, সাগরে যায়, এসব। দুদিনে তাতা ষোল লাইন কবিতা লিখল। প্রথম ছয় লাইন ছিল এমন-
‘হে পর্বত, যত নদী করি নিরীক্ষণ,
তোমাতেই করে তারা জন্মগ্রহণ।
ছোট বড় ঢেউ সব তাদের উপরে,
কলকল শব্দ করি সদা ক্রীড়া করে।
সেই নদী বেঁকে চুরে যায় দেশে দেশে।
সাগরেতে পড়ে গিয়া সকলের শেষে।’
কবিতা হয়ে যাওয়ায় তাতা বেজায় খুশি। বাবাকে পড়তে দিল সে। বাবা বললেন, ভালোই তো লিখেছিস। তবে শুরুর দিকে ছড়া লেখাই ভালো। কিন্তু ছড়া কিভাবে লিখবে তাতা! শেষে ইংরেজি বইয়ের একটি ছড়ার অনুবাদ করল-
‘টিক্ টিক্ ঘড়ি টিক্ টিক্ টিক্
একটা ইঁদুর এল সে সময়ে ঠিক।
ঘড়ি দেখে এক লাফে তাহাতে চড়িল
টং করে অমনি ঘড়ি বাজিয়া উঠিল।
অমনি ইঁদুর ভায়া লেজ গুটাইয়া
ঘড়ির উপর থেকে পড়ে লাফাইয়া!
ছুটিয়া পালায়ে গেল, আর না আসিল,
টিক্ টিক্ টিক্ ঘড়ি চলিতে লাগিল।’
বাবা ছড়াটা পড়ে বললেন, এবার ভালো হয়েছে। তবে ইংরেজি থেকে না লিখে নিজে নিজে লিখলে আরো ভালো হতো। নদী কবিতাটা ছোটদের পত্রিকা মুকুলে ছাপা হচ্ছে। আরো ভালো করে লিখতে হবে।
আর কি! শুরু হয়ে গেল বাবার মত লেখক হওয়ার দিন। হতে হতে সম্পাদক হয়ে গেল তাতা। ‘বারোভাজা’ নামে হাতে লেখা একটা পত্রিকা বের করে। কলেজে উঠে ক্লাবও করল একটা। নাম ‘ননসেন্স ক্লাব’।
তাতা এখন অনেক বড় হয়েছে। পাদার্থ ও রসায়নে ডাবল অনার্স করে বিএসসি পাশ করেছে। কলকাতার পড়া তার প্রায় শেষ। বাবার ইচ্ছা, তাতা ছাপা আর ফটো নিয়ে বিলেতে পড়তে যাক। গেলও।
রবি ঠাকুর ছিল তাতার বাবার বন্ধু। ঠাকুরের কবিতা নিয়ে বিলেতের পত্রিকায় একটা বিশাল লেখা লিখল তাতা। বিলেতের লোকজন জানল কবিগুরুকে। এদিকে কবিগুরুও ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদ করে নোবেল পেয়ে গেছেন। সব মিলিয়ে সারা দুনিয়ায় একটা হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটে গেল আর কি!
বিলেতের পড়া শেষ করে তাতা যখন দেশে এলো পরিবার তাকে বিয়ে করানোর তোড়জাড় শুরু করে দিল। মেয়ে তারা আগেই ঠিক করে রেখেছে। তাতে কি! বিয়ের আগে তো তাতার একবার মত নেয়া উচিত। কেমন মেয়ে চাই তার?
তাতা সবাইকে হাসিয়ে বলল- বাবার আঁকা রামায়ণের দৈত্যি রাক্ষসের মত না হলেই হলো। আর আমার হাস্যরস বুঝতে হবে কিন্তু। শুনেছি মেয়েটা নাকি গানও জানে! কেমন গায় তা তো একবার শোনা যেতে পারে!
তাতা বাবু এখন কনে দেখার আসরে। লজ্জায় তিনি লাল। কনে তার পছন্দ হয়েছে। ভারি মিষ্টি। নামও মিষ্টি, সুপ্রভা। সবাই ডাকে টুলু। কিন্তু গান কেন গাইছে না মেয়েটা? তাতা কুনুই ঠেকিয়ে হাসিকে বলল- কিরে গান যে গাইল না!
টুলু রবি ঠাকুরের গান ধরল-
মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তা তা থৈ থৈ
তা তা থৈ থৈ
তা তা থৈ থৈ...
সবাই তো হেসেই খুন। গানের মধ্যেও শেষমেষ তাতা ঢুকে পড়ল! এ বউ তাতার ঘরে চাই-ই। মাহা ধুমধামে বিয়ে হলো তাতার। রবিঠাকুরও এসেছেন বিয়েতে।
বউ আর সংসার নিয়ে তাতার দিন ভালোই যাচ্ছে। কিন্তু মনে শান্তি নাই। ননসেন্স ক্লাব বন্ধ, বারোভাজাও বের হচ্ছে না, বাবারও শরীর ভালো না, ছাপা নিয়ে প্রেসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে চালের গোলা খালি। সংসারের হালটাও এবার ধরা চাই তার। তাতা প্রেসের ব্যবসায় আরো ভালো করে মন দিলো। বাবার সম্পাদিত পত্রিকা ‘সন্দেশ’ দেখাশুনা করতে লাগল। ক্লাবও করল একটা। সোমবারে আড্ডা হয় বলে ক্লাবের নাম দিয়েছে ‘মানডে ক্লাব’।
ছড়া-কবিতায় হতো ক্লাবের নেমন্তন্ত। একটা ছড়া শোনাচ্ছি-
‘সম্পাদক বেয়াকুব
কোথা যে দিয়াছে ডুব
এদিকেতে হায় হায়
ক্লাবটি তো যায় যায়।
তাই বলি সোমবারে
মদগৃহে গড়পারে
দিলে সবে পদধূলি
ক্লাবটিরে ঠেলে তুলি।
রকমারি পুঁথি কত
নিজ নিজ রুচিমত
আনিবেন সাথে সবে
কিছু কিছু পাঠ হবে
করজোড়ে বারবার
নিবেদিছে সুকুমার।’
এই ক্লাবে অনেক বিখ্যাতদের আড্ডা হতো। এদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, অতুলপ্রসাদ সেন, কালিদাস নাগ।
এর মধ্যে একটা দুঃখের ঘটনা ঘটে গেল। তাতার বাবা গত হয়েছেন। তাতা খুব একা হয়ে যায়। তারপরও তার লেখার গতি কমেনি।
ধীরে ধীরে তাতা বড় লেখক হয়ে উঠছে। হাস্যরস রচনায় তার জুড়ি নেই। তার দুয়েকটা হাস্যরস না শোনালেই নয়-
‘‘হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না)
হয়ে গেল ‘হাঁসজারু’ কেমনে তা জানি না।
বক কহে কচ্ছপে- ‘বাহবা কি ফুর্তি!’
অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি ।
টিয়ামুখো গিরগিটি মনে ভারি শঙ্কা-
পোকা ছেড়ে শেষে কিগো খাবে কাঁচা লঙ্কা ?
ছাগলের পেটে ছিল না জানি কি ফন্দি,
চাপিল বিছার ঘাড়ে, ধড়ে মুড়ো সন্ধি !
জিরাফের সাধ নাই মাঠে ঘাটে ঘুরিতে,
ফড়িঙের ঢং ধরি’ সেও চায় উড়িতে।
গরু বলে ‘আমারেও ধরিল কি ও রোগে?
মোর পিছে লাগে কেন হতভাগা মোরগে?’’
আরেকটা বলি-
‘‘বাবুরাম সাপুড়ে,
কোথা যাস্ বাপুরে?
আয় বাবা দেখে যা,
দুটো সাপ রেখে যা !
যে সাপের চোখ নেই,
শিং নেই নোখ্ নেই,
ছোটে না কি হাঁটে না,
কাউকে যে কাটে না...’
‘আবোল তাবোল’, ‘খাই খাই’, ‘হ য ব র ল’ কত বই না লিখেছে তাতা। মজার মজার নাটকও লিখেছে সে। ‘ঝালাপালা’ নামে তার একটা নাটকে স্যারকে ছাত্র জিজ্ঞেস করছে ‘আই গো আপ’, ‘উই গো ডাউন’ মানে কী?
স্যার বললেন- ‘‘আই’, আই কিনা চক্ষুঃ, ‘গো’- গয়ে ওকারে গো- গউ গাবউ মানে গরুঃ, ‘আপ’ কিনা আপঃ সলিলঙ বারি, অর্থাৎ জল। আই গো আপ মানে দাঁড়ালো তাহলে, গরুর চোখে জল। অর্থাৎ কিনা গরু কান্দিতেছে। কেন কান্দিতেছে? উই গো ডাউন, মানে কিনা ‘উই’ যাকে বলে উইপোকা-‘গো ডাউন’ অর্থাৎ গুদামখানা। গুদামখানায় উই ধরে আর কিছু রাখল না, তাই না দেখে ‘আই গো আপ’- গরু কেবলই কান্দিতেছে’
এতো মজার মজার জিনিস লিখেছে তাতা! কিন্তু জীবনের মজা বেশি নিতে পারেনি সে। কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে একমাত্র পুত্র আর স্ত্রীকে রেখে ছত্রিশ বছরেই গত হয়ে যায়। তার পুত্রকে তোমাদেরও চেনার কথা। সেও অনেক বিখ্যাত। সত্যজিৎ রায় তার নাম। হ্যাঁ, চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়, তারই ছেলে!
তাতার মৃত্যুর কদিন আগেও রবি ঠাকুর তাকে গান শুনিয়েছেন। কবির ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসেও তাতা এবং হাসির কথা আছে। সত্যজিৎ গোস্বামীও তাতাকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখেছেন। এরকম আরো অনেকেই লিখেছেন, গবেষণা করেছেন তাতাকে নিয়ে। এতক্ষণ যে গল্পটা বললাম তার সবগুলো কথাই ওই বইগুলোতে আছে। বড় হলে জানবে সেগুলো। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছ এই তাতাটা কে? এই তাতা আসলেই একটা ধাঁধা। যে ধাঁধার উত্তর একটাই। সুকুমার, সুকুমার রায়।
ঢাকা/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন