‘শরৎবাবু খোলা চিঠি দিলাম তোমার কাছে’
শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম
শাহ মতিন টিপু : শরৎবাবু খোলা চিঠি দিলাম তোমার কাছে/ তোমার গফুর মহেশ এখন কোথায় কেমন আছে/ তুমি জান না/ হারিয়ে গেছে কোথায় কখন তোমার আমিনা/ শরৎবাবু এ চিঠি পাবে কিনা জানি না আমি/এ চিঠি পাবে কিনা জানি না। উপমহাদেশের বিখ্যাত শিল্পী ভূপেন হাজারিকার এই একটি গানই বলে দেয় কতটা জনপ্রিয় ছিলেন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাকে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী, মানব দরদী কথাশিল্পী। তবে একথায় কোনো সন্দেহ নেই যে বাঙালি কথাসাহিত্যিকের জনপ্রিয়তা ছিল গগনচুম্বি।
জনপ্রিয় এই কথাশিল্পীর লেখা বাংলা ছাড়াও বহু ভারতীয় ও বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার একটি নারী ছদ্মনামেও মাঝে মাঝে লিখতেন। সেই ছদ্মনামটি ছিল ‘অনিলা দেবী’।
শরৎ চন্দ্রের ডাক নাম ছিল ‘ন্যাড়া’। আর্থিক সঙ্কটে তার পড়ালেখা এফএ শ্রেণিতেই (বর্তমান আইএ) থেমে গিয়েছিল। ১৮৯৫ সালে নভেম্বরে মাকে হারানোর পরে জেঁকে বসেছিল এই অর্থাভাব। এরপর ১৯০২ সালে বাবাকেও হারান। শেষে ভাগ্যের অন্বেষণে ১৯০৩ সালে মিয়ানমার যান। এ্যাকাউন্টটেন্ট জেনারেল অফিসে মাসিক ৭৫ টাকা বেতনে কেরানী পদে চাকরি গ্রহণ করেন।
১৯০৬ সালে শান্তি দেবীকে বিয়ে করেন। ১৯০৭ সালে পুত্র সন্তানের বাবা হন। বড় ভাগ্য নিয়ে এসেছিলেন তার পুত্র। এ বছরই বিখ্যাত ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত তার প্রথম উপন্যাস ‘বড় দিদি’ হইচই ফেলে দেয় এবং তিনি রাতারাতি খ্যাতির শিখরে আরোহণ করেন। কিন্তু ১৯০৮ সালেই ভয়ঙ্কর প্লেগ তার স্ত্রী-পুত্রকে কেড়ে নেয়। ১৯১০ সালে দ্বিতীয়বার দ্বার পরিগ্রহ করেন শরৎ। পাত্রী মেদিনীপুর নিবাসী কৃষ্ণদাস অধিকারীর ১৪ বছরের বাল্য বিধবা কন্যা মোক্ষদা। শরৎচন্দ্র তার নাম বদলে রাখেন হিরন্ময়ী দেবী। বিয়ের পর হিরন্ময়ী দেবীকে কলকাতায় রেখেই ১৯১৫ সালে আবার মিয়ানমার যাত্রা।
১৯১৬ সালে মিয়ানমারের চাকরি চাকরি জীবনের অবসান ঘটিয়ে সস্ত্রীক উঠে আসেন হাওড়ার বাসায়। ১৯১৭ সালে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে। ঐ বছরই তিনি চিত্তরঞ্জন দাশ সম্পাদিত ‘নারায়ণ’ পত্রিকায় লেখা শুরু করেন। শরৎচন্দ্রের সাহিত্যে হাতে খড়ি তখন থেকেই।
এরপর রাজনীতিতেও জড়িয়ে যান শরৎ। ১৯১৯ সালে ইংরেজ সরকারের রৌলাট আইনের প্রতিবাদে কলকাতায় যে মিছিল হয়েছিল তাতে শরৎচন্দ্র একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন। ১৯২১ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের আহ্বানে কংগ্রেসে যোগ দেন এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯২৩ সালে নজরুল যখন হুগলী জেলে আমরণ অনশনরত সে সময় শরৎচন্দ্র তাকে বুঝিয়ে অনশন ভঙ্গ করার জন্য ৭ মে জেলে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ তাকে জেলে দেখা করতে দেয়নি।
১৯২৬ সালে শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ উপন্যাসের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। তিনি রবীন্দ্রনাথকে এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য পত্র মারফত অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
১৯২৯ সালে ঢাকার পশ্চিম বিক্রমপুর যুবক ও ছাত্র সম্মিলনীতে শরৎচন্দ্র সভাপতিত্ব করেন। ওই বছরই উত্তরবঙ্গের রংপুর বঙ্গীয় যুব সম্মিলনীর অধিবেশনে সভাপতির ভাষণ দেন। ১৯৩১ সালে শরৎচন্দ্র কুমিল্লায় যুব সম্মিলনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি ফরিদপুর সাহিত্য সম্মেলনের মূল সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এই বছরের ডিসেম্বর শেষে কলকাতা টাউন হলে প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৩৬ সালের ঢাকায় উপস্থিত থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত সম্মান সূচক ডি. লিট উপাধি গ্রহণ করেন এবং ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজে সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করেন।
১৯৩৭ সালে শরৎচন্দ্রের পেটে তীব্র যন্ত্রণা ও পাকস্থলীর পীড়া শুরু হয়। তার যকৃতে ক্যান্সার ও পাকস্থলীতে পচন ধরা পড়ে। ১৯৩৮ সালের ১২ জানুয়ারি কলকাতার পাক নার্সিং হোমে ডা. কুমুদ শঙ্কর রায়কে অপারেশনের জন্য সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর প্রদান করেন। এটিই তার জীবনের শেষ স্বাক্ষর। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুযারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। ১৮৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করা এক ঔপন্যাসিকের উপন্যাসের মত জীবনের অবসান ঘটে এভাবেই।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়রচিত উপন্যাসের সংখ্যা ২৪, ছোটগল্প ১১ টি, নাটক ৪ টি এবং প্রবন্ধ ১২ টি। এগুলোর নাম মনে রাখতে একটি মজার কৌশল রয়েছে।
উপন্যাস : ‘বড় দিদি ও মেজদিদির সাথে দেবদাস ও বিপ্রদাসের চরিত্রহীনতার জন্য পল্লীসমাজ ও পন্ডিতমশাই তাদের গৃহদাহ করল। কিন্তু বিন্দুর ছেলে চন্দ্রনাথ, শ্রীকান্ত ও শুভদা বামুনের মেয়ে দত্তাকে বৈকুন্ঠের উইল করে এবং অরক্ষণীয়া বিরাজবৌকে পরিণীতা হিসেবে গ্রহণ করে তাদের পথের দাবী তুলে নিয়ে দেনাপাওনা মিটিয়ে নববিধানে নিষ্কৃতি দিয়ে শেষ প্রশ্নের শেষের পরিচয় দিল।’
অর্থাৎ বড়দিদি (১ম উপন্যাস), মেজদিদি, দেবদাস, বিপ্রদাস, চরিত্রহীন, পল্লীসমাজ, পন্ডিতমশাই, গৃহদাহ, বিন্দুর ছেলে, চন্দ্রনাথ, শ্রীকান্ত, শুভদা, বামুনের মেয়ে, দত্তা, বৈকুন্ঠের উইল, অরক্ষণীয়া, বিরাজবৌ, পরিণীতা, পথের দাবী, দেনাপাওনা, নববিধান, নিষ্কৃতি, শেষ প্রশ্ন, শেষের পরিচয়(শেষ উপন্যাস)।
ছোট গল্প : ‘মন্দিরে একাদশীর বৈরাগ্য ও কাশিনাথের মামলার ফলে বিলাসী, সতী ও ছবি অভাগীর স্বর্গ খুলল এবং মহেশ, পরেশ ও রামের সুমতি হল।’
অর্থাৎ মন্দির (১ম ছোটগল্প), একাদশীর বৈরাগ্য, কাশিনাথ, মামলার ফল, বিলাসী, সতী, ছবি, অভাগীর স্বর্গ, মহেশ, পরেশ, রামের সুমতি
নাটক : ষোড়শী ‘রমা’ হিসেবে বিজয়া হলেন বিরাজবৌ ।
অর্থাৎ ষোড়শী, রমা, বিজয়া, বিরাজবৌ
প্রবন্ধ: স্বদেশ ও সাহিত্যে, সাহিত্য ও নীতিতে, সাহিত্যে আর্ট ও দুর্নীতির ফলে, স্বরাজ সাধনায় নারী ও নারীর মূল্য বিনষ্ট হওয়ায় এবং গুরু-শিষ্য সংবাদের স্মৃতিকথায় শিক্ষার বিরোধ ফলে ভবিষ্যৎ বঙ্গ-সাহিত্য অভিনন্দিত হচ্ছে না বলে ভারতীয় উচ্চ সঙ্গীতের মত তরুণেরা বিদ্রোহ করছে।
অর্থাৎ স্বদেশ ও সাহিত্য, সাহিত্য ও নীতি, সাহিত্যে আর্ট ও দুর্নীতি, স্বরাজ সাধনায় নারী, নারীর মূল্য, গুরু-শিষ্য সংবাদ, স্মৃতিকথা, শিক্ষার বিরোধ, ভবিষ্যৎ বঙ্গ-সাহিত্য, অভিনন্দন, ভারতীয় উচ্চ সঙ্গীত, তরুণের বিদ্রোহ।
আজ ১৪০ তম জন্মজয়ন্তিতে শরৎবাবুর কাছে আমাদেরও খোলা চিঠি- তোমার লেখার পাঠক এখনো অগণিতই আছে..।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫/টিপু
রাইজিংবিডি.কম