ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ভাষা আন্দোলনে সর্বস্বত্যাগী এক নারী মমতাজ বেগম

জয়দীপ দে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১   আপডেট: ০৯:৩২, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১
ভাষা আন্দোলনে সর্বস্বত্যাগী এক নারী মমতাজ বেগম

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে সারা দেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। ঢাকার সন্নিকটে হওয়ায় নারায়ণগঞ্জেও (তখন মহকুমা) আন্দোলনের ঝড় উঠেছিল। ঢাকায় ছাত্র হত্যার খবর নারায়ণগঞ্জে পৌঁছালে তাৎক্ষণিকভাবে রহমত উল্লাহ মুসলিম ইনস্টিটিউট ময়দানে জনসভা ডাকা হয়। সেখানে বিপুল জনতা অংশ নেয়। ইনস্টিটিউটের পাশেই মর্গ্যান স্কুল। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মমতাজ বেগম তিনশ শিক্ষার্থী নিয়ে সেই সভায় অংশ নেন। এই বিশাল উপস্থিতি সবার দৃষ্টি কেড়ে নেয়।

পরে ২৩ ফেব্রুয়ারি সিটি মুসলিম লীগের উদ্যোগে নারায়ণগঞ্জে একটি শান্তি স্কোয়াড শহর প্রদক্ষীণ করে এবং ঢাকায় ছাত্র ও জনসাধারণের উপর পুলিশের গুলি বর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। বিকেলে চাষাড়ায় তোলারাম কলেজ প্রাঙ্গণে একটি বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও মমতাজ বেগম অংশ নেন।

নারায়ণগঞ্জে ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠেন মর্গ্যান হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মমতাজ বেগম। এই আন্দোলন চালাতে গিয়ে পরে তাঁর সংসার পর্যন্ত ভেঙে গিয়েছিল। কারাবরণ করতে হয়েছিল মিথ্যা অপবাদে।

২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে নারায়ণগঞ্জে আন্দোলনের তীব্রতা তুঙ্গে ওঠে। আন্দোলনের রাশ টেনে ধরতে ২৯ ফেব্রুয়ারি মর্গ্যান স্কুল থেকে যুবলীগ নেতা শামসুজ্জোহার বাড়ি ‘হীরামহল’ যাওয়ার পথে মমতাজ বেগমকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। না, আন্দোলনের অভিযোগে নয়। তেমন অভিযোগ তুললে বেশিদিন জেলে আটকে রাখা যাবে না। যে কারণে স্কুলের ২৫ হাজার টাকা তহবিল তছরুপের দায়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর জন্য আদালতে ১০ হাজার টাকা জমা রেখে জামিন চাওয়া হলে আবেদন না-মঞ্জুর হয়। এ খবর শহরে ছড়িয়ে পড়লে জনতা থানা ঘেরাও করে। নারায়ণগঞ্জে রাখা নিরাপদ নয় দেখে মমতাজ বেগমকে ঢাকা নিয়ে আসার জন্য ঢাকা থেকে অতিরিক্ত পুলিশ এবং ইপিআর পাঠানো হয়।

খবর পেয়ে নারায়ণগঞ্জবাসী পাগলা থেকে চাষাড়া পর্যন্ত ৬ মাইল সড়কে ১৬০টি গাছের গুঁড়ি ফেলে রাস্তা অবরোধ করে। সেই অবরোধ ভাঙতে পুলিশ ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ করে পুলিশ ভ্যানে তুলে মমতাজ বেগমকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। কিন্তু জনতা চাষাড়া রেল ক্রসিং-এ আবারও পুলিশের গতিরোধ করে। পরে গভীর রাতে ট্রাকে করে মমতাজ বেগমকে ঢাকা নিয়ে আসা হয়। পরের দিন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র সংবাদে জানা যায় এতে অন্তত ১০ জন পুলিশ গুলিবিদ্ধ হয়।

মমতাজ বেগম, ডানে মর্গ্যান হাই স্কুল 

মমতাজ বেগমকে ঢাকা নিয়ে আসা হলেও নারায়ণগঞ্জে আন্দোলনের বহ্নিশিখা এতটুকুও কমেনি। পর দিন ১ মার্চ জনতা পুলিশ সংঘর্ষে ১ জন আনসার আহত এবং ১ জন পুলিশ নিহত হয়। পরে অবশ্য তদন্তে বেরিয়ে আসে ইপিআরের ছোঁড়া গুলিতেই তারা নিহত হয়েছেন। ১ মার্চ বেগম মমতাজকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ করা হয়। সঙ্গে তাঁর দুগ্ধপোষ্য শিশু শাহানা বেগম খুকু। পরে সরকারের তরফ থেকে মুচলেকা দিয়ে মুক্তির সুযোগ দেওয়া হয় তাঁকে। কিন্তু এই অমর্যাদাকর মুক্তিগ্রহণে অস্বীকার করেন মমতাজ। এদিকে বড়ো সরকারি চাকুরে তাঁর স্বামীও মুচলেকা দিতে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। মমতাজ বেগম তাতে রাজি না হওয়ায় চাকরি বাঁচানোর স্বার্থে স্বামী স্ত্রীকে ত্যাগ করেন।

এদিকে মমতাজ বেগমের ভারতীয় পরিচয় মুখ্য করে তোলে পাকিস্তান সরকার। দৈনিক ‘আজাদ’ ২ মার্চ ‘মমতাজ বেগমের বিচিত্র জীবন’ শিরোনামে এক সংবাদ প্রকাশ করে। সেখানে তাঁকে প্রকারান্তরে ভারতের গুপ্তচর হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বলা হয় সেদিনের মিছিলে অনেকেই নাকি ‘জয় হিন্দ’ বলে শ্লোগান দিয়েছে।
১৯৫৩ সালের মে মাসে মমতাজ বেগম জেল থেকে মুক্তি পান। মুক্তির পর পড়েন আরো কঠিন বিপদে! প্রথম জীবনে তাঁর নাম ছিল কল্যাণী রায় চৌধুরী। ডাক নাম মিনু। ১৯২৩ সালের ২০ মে কলকাতার হাওড়া জেলার শিবপুরে সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতা ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিখ্যাত বিচারপতি রায় বাহাদুর মহিমচন্দ্র রায়। পিতামহ ছিলেন বিখ্যাত জমিদার। মাতা মাখন মতি দেবী ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। মাখন মতি দেবীর ভাই হলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী।

ভালোবেসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র গোপালগঞ্জের কাশিয়ারীর আবদুল মান্নাফকে তিনি বিয়ে করেন। বিয়ের জন্যই তাকে ধর্মান্তরিত হতে হয়েছিল। কল্যাণী হয়ে যান মমতাজ। ১৯৪২ সালে তিনি কলকাতার ‘দি স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’য় উচ্চ বেতনে চাকরি নিয়েছিলেন। বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে আসেন গোয়ালন্দে। পরে ময়মনসিংহে বিদ্যাময়ী স্কুলে সহকারী শিক্ষকের চাকরি নেন। এদিকে তার স্বামী মান্নাফ সরকারের সিভিল সাপ্লাই দপ্তরের উচ্চ পদের চাকুরে ছিলেন। 

ফলে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তাঁর আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনো ঠিকানা ছিল না। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষটি রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্দেহজনক ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। তাঁর পূর্ব পরিচয় এ সন্দেহের কারণ ছিল। ছোট কন্যাশিশুকে নিয়ে একাই জীবনযুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। কলকাতায় তাঁর পরিবারের কাছেও তিনি ফিরে যাননি। পরে আনন্দময়ী গার্লস স্কুল এবং আহমদ বাওয়ানী জুটমিল বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন।

মমতাজ বেগমের শিক্ষাজীবন ছিল খুব উজ্জ্বল। তিনি ১৯৩৮ সালে কলকাতা থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। তিনি ১৯৪২ সালে কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে বিএ এবং ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন থেকে বিএড পাস করেন। ১৯৬৩ সালে এমএড ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৬৭ সালের ৩০ জুন রোগে-শোকে ভুগে নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যান। কিন্তু ভাষার জন্য সর্বস্বত্যাগী এই নারীর উপর খুব একটা গবেষণা ও লেখালেখি হয়নি। ২০১১ সালে এম আর মাহবুব ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেগম মমতাজের উপর ৫০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির লেখা নিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থ সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। তাছাড়া ২০১০ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন মর্গ্যান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তাটি ‘ভাষাসৈনিক মমতাজ বেগম সড়ক’ নামকরণ করে। ২০১২ সালে ভাষা আন্দোলনের অনন্য ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করে।

২৯ ফেব্রুয়ারি মমতাজ বেগমের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে সেসময় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ নিচে তুলে ধরা হলো:

দৈনিক আজাদ 
‘সকালবেলা স্থানীয় পুলিশ নারায়ণগঞ্জ মর্গান বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়িত্রী মিসেস মমতাজ বেগমকে গ্রেফতার করে মহকুমা হাকিমের আদালতে হাজির করে। সংবাদ পেয়ে একদল ছাত্র ও নাগরিক আদালতের সামনে হাজির হয়, বিনা শর্তে তার মুক্তি দাবি করে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ইত্যাদি ধ্বনি করতে থাকে। মহকুমা হাকিম ইমতিয়াজী তখন বাইরে এসে বলেন, মমতাজ বেগমকে স্কুলের তহবিল তসরূপের দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে, রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে তার গ্রেফতারের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু জনতা তা বিশ্বাস করে না। বলতে থাকে, মমতাজ বেগম নারায়ণগঞ্জ রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের অন্যতম প্রধানকর্মী বলেই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। সুতরাং তাকে বিনা শর্তে মুক্তি না দিলে তারা আদালত প্রাঙ্গণ ছেড়ে যাবে না। পুলিশ তখন মৃদু লাঠিচার্জ করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে। বিকেলে পুলিশ মোটরযোগে মমতাজ বেগমকে নিয়ে ঢাকা রওনা হলে চাষাঢ়া স্টেশনের কাছে জনতা বাধা দেয়। তাতে পুলিশ ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ করে। ফলে উভয়পক্ষে ৪৫ জন আহত হয়।’ [২ মার্চ ১৯৫২]

দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা (কলকাতা)
‘ঢাকা, ২৯ ফেব্রুয়ারি। অদ্য অপরাহ্নে এখান হতে ১০ মাইল দূরবর্তী নারায়ণগঞ্জে জনতার আক্রমণে প্রায় ২০ জন পুলিশের লোক আহত হয়েছে। প্রকাশ, একদল পুলিশ তহবিল তসরূপের একটি মামলায় অভিযুক্ত স্কুলের জনৈক হেড মিস্ট্রেসকে স্থানীয় আদালত থেকে জেলে নিয়ে যাওয়ার সময় জনতা কর্তৃক আক্রান্ত হয়। কর্তৃপক্ষীয় মহল হতে জানা যায়, জনতা ওই হেড মিস্ট্রেসকে ভাষা-আন্দোলন সম্পর্কে ধরা হয়েছে মনে করে সম্ভবত পুলিশ দলকে আক্রমণ করেছেন ও তাঁকে উদ্ধার করতে চেষ্টা করেছে। প্রকাশ, জনতা ইট ছোড়ার সময় পুলিশ নিকটবর্তী একটি পুলিশ ফাঁড়িতে যেয়ে আশ্রয় লয়। জনতা দুই ঘণ্টাকাল ইট-পাটকেল ছোড়ে এবং ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রোডে গাছের গুঁড়ি ফেলে বাধা সৃষ্টি করে। অতিরিক্ত পুলিশ অবিলম্বে ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হয় এবং লাঠিচার্জ করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সম্পর্কে কয়েক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’ [২ মার্চ ১৯৫২]


দৈনিক যুগান্তর (কলকাতা)
'নারায়ণগঞ্জে গোলযোগের জের এ পর্যন্ত ১১৫ জন গ্রেপ্তার’
ঢাকা, ১লা মার্চ- গতকল্য একজন প্রধানা শিক্ষয়িত্রীকে জেল হাজতে লইয়া যাইবার কালে তাঁহার উদ্ধারের চেষ্টায় এক জনতা যে গোলযোগ সৃষ্টি করে, সেই সম্পর্কে অদ্য নারায়ণগঞ্জের ৩১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাহাদের লইয়া এ পর্যন্ত মোট ১১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হইল।
গতকল্য সন্ধ্যায় যাঁহাদিগকে গেপ্তার করা হয় তাঁহাদের মধ্যে পূর্ববঙ্গ পরিষদের সদস্য মি: ওসমান আলী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কয়েক ব্যক্তি আছেন।
ঢাকার অবস্থা শান্ত আছে। [ পি.টি. আই]

সূত্র
১. পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি তৃতীয় খণ্ড, বদরুদ্দীন উমর
২. জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫, অলি আহাদ
৩. ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগী এক অনন্য নারী, এম আর মাহবুব, দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯     
৪. ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, বশীর আল হেলাল
৫. দৈনিক যুগান্তরের পুরনো সংখ্যা
৬. দৈনিক আনন্দবাজারের পুরনো সংখ্যা

ঢাকা/তারা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়