ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

রঙিন বেনারসি-শিল্পীদের বিবর্ণ জীবন

কবি স্বরলিপি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২৩, ১৯ নভেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৮:০০, ১৯ নভেম্বর ২০২১

বায়তুস সালাত জামে মসজিদ মার্কেটের পাশে দাঁড়িয়ে এক পথচারীকে জিজ্ঞাসা করলাম- আশেপাশে বেনারসি কারখানা আছে? প্রথমে কথায় ভ্রুক্ষেপ করলেন না, ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে থাকলেন। একটু অবাক হয়ে তার চলে যাওয়া দেখছিলাম। লোকটি ফিরে তাকিয়ে ইশারা দিলেন পিছু পিছু যেতে। একটি সরুগলি দিয়ে তাকে অনুসরণ করে এগোলাম। গলির দুইপাশে ঘর, ঘরগুলো থেকে উর্দু ভাষায় আলাপচারিতা শোনা যাচ্ছিল। সামান্য সামনে যেতেই খট্খট্ শব্দ কানে এলো। কারখানার সামনে আমাকে দাঁড় করিয়ে লোকটি হেসে বিদায় নিলেন। কম কথায় এই যোগাযোগ- উপভোগ্য মনে হলো।

কারখানা থেকে একজন বুননশিল্পী আমার দিকে তাকাতেই সালাম দিলাম।
আসবো?
আসুন।

খয়েরি রঙের জমিনে রেশম সুতার সোনালি জরি দিয়ে বুটি নকশা তুলছিলেন তিনি। তাঁতের নিম্নাংশে বাঁশে পা দিয়ে হালকা দুলে শাড়ি বুনছিলেন তিনি। তাতে অবশ্য আমাদের কথোপকথনে সমস্যা হচ্ছিল না। মাথার অল্প উঁচুতে বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বলছে। লম্বা করে পেতে রাখা সুতায় ছড়িয়ে পড়ছিল সেই আলো আর বুননশিল্পীর মোহনীয় দৃষ্টি। শিল্পীর চোখ, সৃষ্টির প্রান্তে না পৌঁছে দীর্ঘ হাসি হাসে না- তারই চিহ্ন যেন!

কারখানায় মোট ৮টি তাঁত। কাজ চলছিল পাঁচটিতে। শুধু একজন ছিলেন চরকায় সুতা কাটায় ব্যস্ত। বেনারসির বুনন, নকশা আর তাদের জীবনের স্নিগ্ধ আর গাঢ় হাসি কান্নার প্রকাশ পাচ্ছিলাম স্বল্পভাষায়।

বেনারসির কথায় আসা যাক, কোমল রং কিংবা জমকালো গাঢ় রঙে তৈরি হয় বেনারসি। এই  চরকায় সুতা কাটেন খুশি। মোট ৮ জন বুননশিল্পীর সুতার যোগান দেন তিনি একা। খুশি জানান, সুতা কাটার কাজ শিখেছেন মায়ের কাছে। মায়ের শিখিয়ে দেওয়া কাজটি হয়ে উঠেছে তার নিত্যদিনের কাজ। একটি শাড়ির জন্য সুতা কেটে একশো টাকা উপার্জন করেন তিনি।

বুননশিল্পীর পারিশ্রমিক নির্ধারিত হয় নকশাভেদে। শাড়িতে বুটি নকশা তুলতে তুলতে কথা বলছিলেন মো. এজাজ। এই শাড়িটি বুনতে সময় লাগে ১০ দিন। পারিশ্রমিক পান ৪ হাজার টাকা। দিনের বারো ঘণ্টা সময় দিতে হয় এ কাজে। সুতি সুতার বেনারসির দাম বেশি হয়। এই সুতার যোগান আসে ভারত থেকে। শাড়িটির বাজারমূল্য প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। 

মো. এজাজ এই শাড়ি বুননের কাজ শুরু করেছেন ১২বছর বয়স থেকে। ৩৫ বছর ধরে এ পেশায় আছেন তিনি। দুই ছেলেমেয়ের জনক এজাজ জানালেন তার ছেলেমেয়েরা কেউ এ পেশায় আসবে না। প্রশ্নও রাখলেন- কেন আসবে? সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তার। তবে কাজের প্রতি ভালোবাসা তাকে অন্য কাজে আর মনোযোগী করে তোলেনি।  

আরেক বুননশিল্পী মো. রুবি কুমকুম নকশার বেনারসি বুনছিলেন। মিরপুরের বিহারী ক্যাম্পেই তার বসবাস। জানা গেলো, বয়স যখন ১২, কৈশোরের সোনালি সময়ে হাতে তুলে নিয়েছেন এই শাড়ি বুননের সুতা। কখনো খয়েরি জমিনে সোনালি ফুল ফুটিয়ে তুলেছেন, আবার কখনো গোলাপি জমিনে মনের মাধুরি মিশিয়ে তুলেছেন সোনালি কুমকুম। এ কাজে টাকা কম, আবার বছরের বর্ষাকালে কাজের বায়না কমে যায়, সেজন্য মাঝখানে কিছুদিন অ্যাম্ব্রয়ডারির কাজ করেছেন। একটি শাড়ি বুনন শেষে মনে যে স্বস্তি মেলে তা নাকি ওই যন্ত্রচালিত কাজে খুঁজে পান না রুবি। সেজন্যই ফিরেছেন আবার পুরোনো পেশায়। 

রুবি জানান একটি বেনারসি শাড়ি বুনতে সুতার দরকার পড়ে পৌণে এক কেজি বা  ৭৫০গ্রাম। বেনারসি মানেই ভারি শাড়ি। হালকা নকশা ও হালকা ওজনের শাড়িগুলো মূলত কাতান। 

বুনন শিল্পী মো. শহিদুল জানান, বেনারসি শাড়ি পাড় ছাড়া, হালকা পাড়, চওড়া পাড়ের হয়। বুটি নকশা , জংলা লতাপাতা, বড় বড় কলকা অথবা শুধু বড় একটি ঝাড় ফুটিয়ে তোলা হয় জমিনে। এসব নকশায় ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবহৃত হয় সোনালি জরি সুতা। সুতারও রয়েছে রকমভেদ- পিওর সিল্ক, রোলেক্স জরি সুতা, পিওর সুতি ইত্যাদি।

তাঁতের বিভিন্ন অংশের নাম জানালেন বুননশিল্পী মো. শহিদুল। তুড়িয়া, হাত, হাতা, সিঁড়ি, মালা, ডাণ্ডা। তুড়িয়া থাকে বুননশিল্পীর একেবারে পেটের কাছাকাছি, এই অংশের একদিকে বুনন সমাপ্ত হওয়া শাড়ির অংশ, অন্যদিকে অসমাপ্ত অংশ। তাঁতের হাত আর হাতা টেনে সুতাগুলো ভাগ ভাগ করা হয়, নির্ধারিত  নকশার জন্য জরিসুতা দরকি দিয়ে টেনে আবার তাঁতের হাত ও হাতা টানার কাজ চলতে থাকে। 

পনেরো রোজা থেকে মহররম পর্যন্ত কাজের ব্যস্ততা বেশি থাকে বলেও জানান তিনি। তারপরের মাসগুলোতে তূলনামূলক কম ব্যস্ততা থাকে। কারখানা থেকে অর্ডার দিয়ে শাড়ি বানাতে পারেন যে কেউ, এতে বাজারদরের থেকে কম টাকায় মিলবে পছন্দের শাড়ি। 

বুননশিল্পীরা জানালেন, প্রথমে দরকি চালানো শিখতে হয়। দক্ষশিল্পী প্রথমে তাঁতে সুতাগুলো পেতে রাখেন, যাদের হাতেখড়ি চলে তারা দরকি চালিয়ে সোনালি সুতা দিয়ে ফুলের কাজ করেন। মূল কাজ হলো সুতা পাতানো। নকশা তোলা থাকে কাগজের ডাইসে। ডাইসে যে কয়টি ছিদ্র থাকে সেই ছিন্দ্রসংখ্যার সঙ্গে মিলিয়ে তাঁতের অগ্রভাগে পাতায়া ও জালা নিতে হয়। যা শাড়ির জমিনের সুতাগুলোকে একটা থেকে আরেকটার দূরত্ব নির্ধারণ করে। 

ঢাকা/তারা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়