ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে অবরুদ্ধ দিনের স্মৃতির কাছে ফেরা 

এস এম জাহিদ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৬, ১৬ ডিসেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৩:৪৪, ১৬ ডিসেম্বর ২০২১
বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে অবরুদ্ধ দিনের স্মৃতির কাছে ফেরা 

জাতীয় জীবনে তখন ঘোর দুর্যোগের কাল। এমন শ্বাসরুদ্ধ সময় আমরা দেখিনি আগে। স্থবির জীবনে চারপাশে চাপা আতঙ্ক। কেউ জানে না আগামী সকাল ভাগ্যে কী লিখে রেখেছে। একাত্তরে ২৬ মার্চের পর থেকেই প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ঢাকা থেকে তাড়া খাওয়া মানুষ, হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে ছুটে আসছে গ্রামের দিকে। প্রত্যেকের প্রত্যাশা নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু তত দিনে এই ছাপান্ন হাজার বর্গ কিলোমিটার পরিণত হয়েছে রণক্ষেত্রে। চারদিকে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ছে সেই যুদ্ধের খবর।   

নীলফামারী সদরে একাত্তরের সেই রক্তঝরা এপ্রিলে যুদ্ধের উত্তাপ লাগতে শুরু করেছে। চিরচেনা মুখগুলো ম্রিয়মাণ। প্রত্যেকের কপালেই সুস্পষ্ট দুশ্চিন্তার ভাঁজ। শহর কোনো ক্রমেই তখন আর নিরাপদ জায়গা নয়। পাকসেনাদের অত্যাচার, নির্যাতন তখন আর অজানা কোনো খবর নয়। ২৫ মার্চ রাতে তাদের নিধনযজ্ঞ তত দিনে জেনে গেছে তৎকালীন পূর্ব বাংলার প্রতিটি মানুষ। এ যেন এক শিউরে ওঠা সময়!

আরো পড়ুন:

আমার বাবা প্রয়াত মো. আফতাব উদ্দিন অগ্নিঝরা এই সময়ে নীলফামারী ছমিরুদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক হিসেবে তিনি স্থানীয়ভাবে যথেষ্ট পরিচিত। সহকর্মীদের কাছে তিনি যেমন প্রজ্ঞাবান এবং দায়িত্বশীল শিক্ষক ছিলেন, তেমনি শিক্ষার্থীদের কাছেও তিনি ছিলেন স্নেহশীল, পিতৃতুল্য। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকেই তিনি সন্তানসম মনে করতেন। যে কারণে অনেকেই এ সময় তার জীবন নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন। অনেকেই তখন বাবাকে পরামর্শ দিয়েছেন পরিবার নিয়ে অন্যত্র চলে যেতে। কিন্তু সেই সময়ে, সেই ক্রান্তিকালে নীলফামারী থেকে আমাদের জন্মস্থান টাঙ্গাইলে ফিরে আসা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া চাইলেই সাজানো সংসার ছেড়ে হঠাৎ কোথাও আশ্রয় নেওয়া সহজ নয়।

এপ্রিল থেকে পরিস্থিতি ক্রমে খারাপ হচ্ছিল। তাছাড়া নীলফামারীর পার্শ্ববর্তী সৈয়দপুর ছিল বিহারী অধ্যুষিত এলাকা। তারা সে সময় পাকিস্তানের পক্ষে থাকায় ভয় বাড়ছিল। যে কারণে বাবা বাধ্য হয়েই এপ্রিলের মাঝামাঝি সপরিবারে নীলফামারী শহর ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় পরম নির্ভরতায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন বাবারই হাতে গড়া ছাত্র মোজাহারুল ইসলাম পেনু। তার গ্রামের বাড়ি ছিল শহর থেকে বেশ ভেতরে পঞ্চপুকুর ইউনিয়নের উত্তরা শশী গ্রামে। সম্পর্কে ছাত্র-শিক্ষক হলেও তিনি আমার বাবাকে ‘আব্বা’ ডাকতেন। ফলে আমরা দ্বিধা না করে তার গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নেই।

আজ বিজয়ের এই সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে ভাবতে বিস্ময় জাগে- দশম শ্রেণির এক কিশোরও সেদিন দেশের প্রতি তাঁর কর্তব্য বুঝতে পেরেছিল। শুধু তাই নয়, দায় এড়িয়ে না গিয়ে ছোট্ট কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিতেও সে পিছ-পা হয়নি। এখানেই তাঁর মহত্ব। মোজাহারুল ইসলাম পেনু অস্ত্র হাতে রণাঙ্গণে যুদ্ধ না করেও আমার বিনীত দৃষ্টিতে সে যোদ্ধা। যুদ্ধের পুরো সময় আমরা তাঁর বাড়িতে থেকেছি। সেখানে যে আতিথেয়তা পেয়েছি কখনও তা ভুলবার নয়। এমনকি তাঁর প্রতিবেশীদের কাছ থেকেও সমাদর, সহমর্মিতা আমরা পেয়েছি।

একটি ছোট্ট ঘটনা উদাহরণ হিসেবে দিতে চাই। একবার সেখানে থাকা অবস্থায় আমার মায়ের একটি কানের দুল বাড়ির কুয়ার মধ্যে পড়ে যায়। দুলটি সে সময় যথেষ্ট দামি হলেও আমরা আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। সেই যুদ্ধের সময়ে দুলটি উদ্ধার করার উপায়ও ছিল না। কিন্তু এই ঘটনা মোজাহারুল ইসলাম পেনু মনে রেখেছিলেন। যুদ্ধ শেষ হলে তিনি দুলটি কুয়া থেকে তোলার ব্যবস্থা করেন এবং মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেন। অথচ ততদিনে আমরা তাঁর বাড়ি ছেড়ে নিজেদের বাড়ি চলে এসেছিলাম।

এই যে দায়িত্ববোধ- এ কারণেই মোজাহারুল ইসলাম পেনু ছিলেন অন্যদের চেয়ে আলাদা। আমি অনেকবারই তাকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতে দেখেছি। এ কাজে তিনি ছিলেন নির্ভয়, নিঃশঙ্কচিত্ত। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমার শৈশব বাঁচিয়ে রাখা সেই মানুষটিকে আমি হারিয়ে ফেলি। সঙ্গত কারণেই আমরা সেখান থেকে চলে আসার পর মোজাহারুল ইসলাম পেনুর সঙ্গে আমার আর যোগাযোগ হয়নি। স্বাধীন দেশে আমি যত বড় হয়ে উঠতে থাকি, তিনি ততোই দূরের মানুষে পরিণত হন। কিন্তু আমার স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে পেশাজীবনে শত ব্যস্ততার মধ্যেও এই নামটি মুছে যায়নি। চোখের আড়াল হলেই যে মনের আড়াল হওয়া নয়- তিনি আমার জীবনে তেমনই একজন। তাঁর নাম  হৃদয়ে মণিকোঠায় সবসময়ই ছিল।

যে কারণে বিজয়ের সবুর্ণজয়ন্তীতে পণ করেছিলাম- যে করেই হোক নীলফামারী গিয়ে দেখা করবো মোজাহারুল ইসলাম পেনুর সঙ্গে। কিন্তু কাজটি সহজ ছিল না মোটেও। কারণ শুধু নাম এবং গ্রামের নাম দিয়ে একটি মানুষ খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। তাছাড়া গত পঞ্চাশ বছরে পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় অনেক জল গড়িয়েছে। তারপরও হাল ছেড়ে না দিয়ে এক সকালে নীলফামারী সদর থেকে রওনা হলাম উত্তরা শশী গ্রামের উদ্দেশ্যে।

উত্তরা শশী বদলে যাবে ধারণা ছিল। কিন্তু কতটা? মনের কোণে সবুজ-শ্যামল যে গ্রামের ছবি ছিল তার সঙ্গে এই গ্রামের পার্থক্য বিস্তর। তার চেয়েও বড় কথা, অনেকের সঙ্গে কথা বলেও মোজাহারুল ইসলাম পেনুর খোঁজ পাওয়া গেল না। এদিকে মাথার ওপর সূর্যের তাপ বাড়ছে। এতো দূর এসে নিষ্ফলা মাঠের কৃষকের মতো ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হবে ভেবে মনের কষ্টটাও কম হচ্ছিল না। এমন সময় গ্রামের এক চায়ের দোকানে খোঁজ করে জানা গেল এই নামে গ্রামে একজন আছেন। তার দেখিয়ে দেওয়া পথে এগিয়ে চললাম। মনের মধ্যে তখন তোলপাড়- কেমন আছেন তিনি? এতো দিন পর তিনি কি চিনবেন? অনেক প্রশ্ন নিয়ে যখন সেই বাড়ির দুয়ারে দাঁড়ালাম তখন জানতে পারলাম- বাড়িটিতে এখন আর তিনি বসবাস করেন না। বাড়িটি তিনি অন্য লোকের সঙ্গে বিনিময় করেছেন। 

হতাশার মধ্যেও অন্ধকার সুড়ঙ্গের অন্যপাশে আশার আলো দেখতে পেলাম। বাড়ি যখন পাওয়া গেছে লোকটিকেও নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। প্রশ্ন করতেই জানা গেল তিনি এখন ঢাকা থাকেন। শোনার পর পুনরায় মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল। যখন ফিরে আসার কথা ভাবছি তখনই আরেকজন জানালেন ঢাকা থেকে তিনি নাকি সম্প্রতি ফিরেছেন। এখন থাকেন মেয়ের বাড়িতে। এ কথা শুনে পা বাড়ালাম সেই মেয়ের বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে। উত্তরা শশী বেশ বড় গ্রাম। এ-পাড়া, ও-পাড়া ঘুরে উপস্থিত হলাম কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে।

এবার আর হতাশ হতে হলো না। আমার শৈশবের দেখা সেদিনের সেই মোজাহারুল ইসলাম পেনু আজ বৃদ্ধপ্রায়। দুর্ঘটনায় পা ভেঙে ঘরে বসে আছেন। পরিচয় দিতেই চিনলেন। পরম মমতায় বাড়িয়ে দিলেন হাত। আমি অনুভব করলাম প্রিয়জনের স্পর্শ। বাবার কথা স্মরণ করে ভিজে উঠলো চোখের কোল। কথা হলো অনেকক্ষণ। তিনি খুটিয়ে খুটিয়ে জানার চেষ্টা করলেন আমাদের কথা। অসুস্থ শরীরে কথা বলতে তাঁর কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু স্মৃতি হাতড়ে অতীতের কথা স্মরণ করতে তাঁর উৎসাহের কমতি ছিল না। ৫০ বছরের জমানো কথা এতো সহজে তো ফুরাবার নয়। কিন্তু ফেরার সময়ও হয়ে এলো। ‘আবার আসবো’ বলে এক সময় উঠতেই হলো। অবরুদ্ধ সেসব দিনের স্মৃতির সঙ্গে আজকের দিনটির যোগসূত্র মেলাতে মেলাতে আমি নেমে এলাম পথে। মনের মধ্যে ততক্ষণে অদ্ভুত ভালোলাগার এক অনুরণন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।   

/তারা/ 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়