ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০২ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৯ ১৪৩১

তিনি সাংবাদিক অথচ আধ্যাত্মিক বাউল

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪৭, ১৬ এপ্রিল ২০২২   আপডেট: ১১:৫৬, ১৬ এপ্রিল ২০২২
তিনি সাংবাদিক অথচ আধ্যাত্মিক বাউল

সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের কথা কাগজে ছাপার অক্ষরে ফুটিয়ে তুলেছিলেন গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙাল হরিনাথ মজুমদার। অথচ আধ্যাত্মিক বাউল সাধনায় নিজেকে তিনি ‘কাঙাল’ নামেই পরিচিত করতেন।

গ্রামীণ সাংবাদিকতার এই পথিকৃৎ এর ১২৭তম প্রয়াণ দিবস আজ। তিনি ১৮৯৬ সালের ১৬ এপ্রিল মারা যান। তার জন্ম কুমারখালির কুণ্ডুপাড়ায় ১৮৩৩ সালের ২২ জুলাই।

যদি ডাকার মতো পারিতাম ডাকতে, তবে কি মা এমন করে তুমি লুকিয়ে থাকতে পারতে- গানটি একসময় বাংলার মানুষের ঘরে ঘরে শোনা যেত। এখন গানটির রচয়িতা ছিলে ফিকির চাঁদ। এটিও হরিনাথ মজুমদারের আরেকটি ছদ্মনাম।

এই বাউল সাধকের স্মৃতিধন্য কুষ্টিয়ার কুমারখালী। হরিনাথ মজুমদার ওরফে ফিকির চাঁদ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজ, সমকালিন। জানা যায়, হরিনাথ মজুমদারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। কথিত আছে, সম্পর্ক এতটাই অবনতি হয়েছিল যে কবিগুরু হরিনাথ মজুমদারকে তাঁর কুঠিবাড়িতে ধরে নেওয়ার জন্য লাঠিয়াল বাহিনী পাঠিয়েছিলেন। লালন শাহ সে সময় লাঠিয়াল বাহিনী প্রতিহত করে শিষ্য হরিনাথ মজুমদারকে নিরাপদ করেছিলেন। শুধু একবার নিরাপদ করে শান্ত হননি। সাঁইজি দিনের পর দিন লোকজন নিয়ে পাহাড়া দিতেন হরিনাথ মজুমদারের বাড়ি ও কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর বিখ্যাত সেই ‘প্রেস’টি।

কুমারখালির যে প্রেস থেকে প্রকাশ হতো কাঙাল হরিনাথ মজুমদার সম্পাদিত ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’। বলা হয়, ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র কারণে সে সময় সৃষ্টি হয়েছে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, রায় বাহাদুর জলধর সেন, দীনেন্দ্র কুমার রায়, মীর মশাররফ হোসেনের মতো লেখক।

এই পত্রিকাটি অনুপ্রাণিত করেছে বিপ্লবীদের। আবার আঘাত করা হয়েছে ব্রিটিশ শাসনের মূলেও। সেই সময়ের কুষ্টিয়া থেকেই বিপ্লবী বাঘা যতীনের উত্থান, জমিদার দর্পণ -এর নাট্যকার মীর মোশাররফ হোসেনের ক্রমশ বিপ্লবী লেখক হয়ে উঠা। অত্যাচার-জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার পাশাপাশি হরিনাথ সেসময় ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’কে ঘিরে লেখক গোষ্ঠী তৈরি করেন। মীর মশাররফ হোসেন ছিলেন হরিনাথের স্নেহধন্য। তার রচিত বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী সার্থক উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’ হরিনাথের এম.এন প্রেস থেকেই প্রথম প্রকাশিত হয়। লালন সাঁইজীর ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ –সহ মোট ২১টি গান সর্বপ্রথম মুখের শব্দ থেকে কাগজে ছাপার অক্ষরে ঠাঁই পায় কাঙালের এম.এন প্রেসের মুদ্রণেই।

কুষ্টিয়া জেলাশহর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে গড়াই নদীর তীরে কুমারখালীর কুণ্ডুপাড়ায় গড়ে তোলা হয়েছে কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর। বাহারি ফুলের বাগানে ঘেরা জাদুঘর ভবনটি লাল ইট আর মোজাইক টাইলসের কারুকাজে নির্মিত।  ভেতরে পরিপাটি করে সাজানো কয়েকশ বছর আগের ছাপানো পত্রিকা, লেখা কবিতা ও ছবিসহ নানা স্মৃতিচিহ্ন।  

নতুন প্রজন্মের কাছে কাঙাল হরিনাথের স্মৃতিকে তুলে ধরতে ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর এই জাদুঘর নির্মাণ করে সরকার। প্রবেশের পরই জাদুঘরের আঙিনায় দেখা মিলবে গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙাল হরিনাথের স্মৃতি-ভাস্কর্য। ভবনের নিচের তলায় রয়েছে ১০০ আসন বিশিষ্ট শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সম্মেলনকক্ষ। জাদুঘরের দ্বিতীয় তলার দেয়ালে স্থাপন করা অ্যালবামে শোভা পাচ্ছে কাঙাল হরিনাথ ও তার স্ত্রী, লালন শাহ এবং মীর মশাররফ হোসেনের ছবি। একই সঙ্গে হরিনাথ সম্পাদিত পত্রিকা ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’, মুদ্রণযন্ত্রে ব্যবহৃত কাঠের ব্লক ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতিসহ ১৬৮টি নিদর্শন এবং ৬৭টি ছবি। এ ছাড়া জাদুঘরের অপর পাশে রয়েছে একটি গ্রন্থাগার। সাড়ে ৪০০ বই রয়েছে গ্রন্থাগারটিতে। 

ইচ্ছে করলে বেড়িয়ে আসতে পারেন কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘরে।

ঢাকা/টিপু

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়