ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

জ্বালানি তেল বাঁচাবে ঘোড়ার গাড়ি, ঘোড়া বাঁচাবে কে?

মুজাহিদ বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৮, ২২ আগস্ট ২০২২   আপডেট: ১২:৫৪, ২২ আগস্ট ২০২২
জ্বালানি তেল বাঁচাবে ঘোড়ার গাড়ি, ঘোড়া বাঁচাবে কে?

ইতিহাস ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত পুরান ঢাকা। বিখ্যাত খাবার ও নানান স্থাপনার জন্য ৪০০ বছর থেকে পুরান ঢাকার নামডাক। এই এলাকার অন্যতম বাহন ছিল ঘোড়ার গাড়ি, যা এখন বিলুপ্তপ্রায়। ঘোড়ার গাড়ি সম্প্রতি আলোচনায় উঠে এসেছে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জ্বালানি তেল খরচের বিকল্প বাহন হিসেবে সাইকেলের পাশাপাশি বলা হচ্ছে ঘোড়ার গাড়ির কথা।

‘রিকশার শহর’ হিসেবে ঢাকার পরিচিতি থাকলেও, এখন একে মোটরসাইকেলের শহর বলা যায়। জ্বালানি তেল বাইকারদের কপালেও দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। অনেকের হয়তো এ সময় মনে পড়ছে ঘোড়ার গাড়ির কথা। কারণ পুরান ঢাকার পরিচয় ছিল ঘোড়ার গাড়ির শহর হিসেবেই। সে সময় ওই এলাকায় প্রায় ৪০০ ঘোড়ার গাড়ি চললেও বর্তমানে চলে মাত্র ৩২টি গাড়ি। ঘোড়ার সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৫০টিতে। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় কেউ এখন আর সেভাবে যাতায়াত করেন না ঘোড়ার গাড়িতে। 

পদ্মা সেতু চালুর পর এর প্রভাব পড়েছে ঘোড়ার গাড়ির ব্যবসার ক্ষেত্রে। একসময় হাজার হাজার মানুষ সদরঘাট দিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করলেও পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় যাত্রী হারিয়েছে লঞ্চগুলো। সদরঘাট যাওয়ার জন্য এখন আর আগের মতো যাত্রী পাচ্ছে না ঘোড়ার গাড়িগুলো। রাজধানীর ঘোড়ার গাড়ি মালিক সমিতির সভাপতি আজগর মিয়া এ প্রসঙ্গে বলেন, ব্যবসা অনেকটাই বন্ধের পথে। আগের মতো আর লাভ নেই। অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। পদ্মা সেতু চালুর পর যাত্রী পাওয়া যায় না। আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ।

তারপরও গুলিস্তান থেকে সদরঘাট রুটে কয়েকটি ঘোড়ার গাড়ি চলে। ভাড়া ৩০ টাকা। উল্লেখ্য এই পথে বাসভাড়া ১০ টাকা। এ কারণে শখের বসে ছাড়া খুব কম মানুষই যাতায়াত করেন ঘোড়ার গাড়িতে। তাই অনেক মালিক গুটিয়ে নিয়েছেন ব্যবসা। করোনার পর লস দিয়ে অনেকেই হয়েছেন সর্বশান্ত।

প্রতিদিন ঘোড়াগুলোর জন্য ঘাস, ক্ষুদ, কুড়া, গম আনা হয় সোয়ারিঘাট থেকে। রাজধানীতে ঘাস সংগ্রহ করা খুব কঠিন। চড়া মূল্যে কিনতে হয়। এক বস্তা ঘাসের দাম আগে ১০০ টাকা ছিল, বর্তমানে ২০০ টাকা। ৩০ টাকা কেজির ভুষির বর্তমানে বাজারমূল্য ৬০ টাকা। ফলে আগে একটি ঘোড়ার পেছনে দিনপ্রতি ২৫০ টাকা খরচ হলেও এখন হয় প্রায় ৪০০ টাকা। ঘোড়ার চিকিৎসা ব্যয়ও বেড়েছে। 

ঘোড়া এবং গাড়িগুলো বর্তমানে রাখা হয় বঙ্গবাজার মার্কেটের পাশে। সেখানে গিয়ে দেখা যায় ঘোড়াগুলোর বেহাল দশা। যত্ন, পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে ঘোড়াগুলো কোনোরকমে বেঁচে আছে। এমনকি আগে যেমন ঘোড়া এবং গাড়ি সাজিয়ে রাস্তায় নামানো হতো এখন তাও দেখা যায় না। অনেকটা পেটের দায়েই এই পেশায় জড়িত আছেন অনেকে। তবে এখনো দু’একটি গাড়ি ব্যাতিক্রম দেখা যায়। এসব গাড়িতে রয়েছে এলইডি লাইট, সিসি ক্যামেরা, আরামদায়ক চেয়ার। মূলত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য এসব গাড়ির ডাক পড়ে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, সর্বপ্রথম ১৮৫৬ সালের অক্টোবর মাসে মি. সিরকোর নামে এক আমেরিকান ঘোড়ার গাড়ি আমদানি করেন। ১০ বছরের মধ্যে গাড়ির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬০টি। সিরকো ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনেন। এই ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় আর্মেনিয়ান ও স্থানীয়রা জড়িয়ে পড়ে এই পেশায়। ইতিহাস বলছে, ১৮৯০ সালেও ৬০০ ঘোড়ার গাড়ি চলতো ঢাকায়। এদের তিনটি ধরন ছিল। সাধারণ ঘোড়ার গাড়ি ভাড়ায় খাটতো, এক্কাগাড়ি নামের গাড়িতে চড়তেন চিকিৎসক, জমিদার ও ধনী ব্যক্তিরা। জুড়িগাড়ি নামে আরো এক ধরনের গাড়ি দেখা যেত সেগুলো পরিবারের সবার একসঙ্গে চলাচলের জন্য। 

ঘোড়ার গাড়ি চালক সুমন টমটম অনেকদিন থেকেই গাড়ি চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, এখন আর আগের মতো ব্যবসা নাই। এই পেশায় বাপ-দাদায় ছিল এখন আমি আছি। ছাইড়া দেওয়া লাগবো নইলে পেট চলে না।

ঘোড়ার গাড়ির মালিক কামালও বললেন একই কথা। ‘আমাদের আগের মতো ব্যবসা আর নেই। এখন অনেক লস। এখন মন উঠে যাচ্ছে। গাড়ি রাখতে সমস্যা, চলতে সমস্যা।’ বলেন তিনি। 

কামাল এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে চান। তিনি এ জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মেয়রের সুদৃষ্টি কামনা করেন। 

মো. ইব্রাহিম খলিলও কামালের কথায় সুর মেলান। বলেন, ‘আমার দাদায় এই ব্যবসা করতো, এরপর আমার বাবা করছে, এখন আমি করি। কিন্তু আগের মতো ঐতিহ্য আর নাই। আমরা চাচ্ছি ধরে রাখতে। দেশ আধুনিক হচ্ছে, আমরাও গাড়িগুলো আধুনিক করছি। কিন্তু ইনকাম নাই৷ সরকার আমাদের দেখলে আমরা এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারব।’

/তারা/ 

সর্বশেষ