ঢাকা     শনিবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ১২ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

 বছরজুড়ে আন্দোলনে অস্থির সচিবালয়  

আসাদ আল মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৪, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫  
 বছরজুড়ে আন্দোলনে অস্থির সচিবালয়  

সময় বহমান, কিন্তু কিছু নির্দিষ্ট সময় তার চিহ্ন রেখে যায় ইতিহাসের পাতায়। ২০২৫ সাল বাংলাদেশের প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ের জন্য তেমনই এক অবিস্মরণীয় বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। 

এই বছরটি ছিল সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ধারাবাহিক আন্দোলন, সংঘাত ও অভূতপূর্ব কর্মতৎপরতার বছর। আন্দোলনের পটভূমি ও বিস্তার বছরের শুরু থেকেই বেতন বৈষম্য দূরীকরণ, পদোন্নতিতে স্বচ্ছতা এবং ক্যাডার-ননক্যাডার দ্বান্দ্বিক নিরসনের দাবিতে সচিবালয়ের ভেতরে ও বাইরে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। বিভিন্ন স্তরের কর্মচারীরা তাদের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ নিয়ে রাজপথে নেমে আসেন। দফায় দফায় কর্মবিরতি এবং স্মারকলিপি প্রদানের মাধ্যমে তারা নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। অভিঘাত ও ফলাফল এই আন্দোলনের অভিঘাত ছিল সুদূরপ্রসারী। সচিবালয়ের দৈনন্দিন দাপ্তরিক কাজে যেমন স্থবিরতা নেমে এসেছিল, তেমনি সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোতেও এক ধরনের সংস্কারের চাপ তৈরি হয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রে আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে কিছু দাবি পূরণ হলেও, আন্দোলনের রেশ প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পরিবর্তনের সুর তুলে দেয়। সচিবালয় ভাতার দাবিতে কর্মচারীদের হাতে প্রায় ছয় ঘণ্টা অবরুদ্ধ ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এ ঘটনায় ১৪ জনকে আটক করা হয় পড়ে তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।  

আরো পড়ুন:


অধ্যাদেশের জন্ম ও সরকারি কর্মচারীদের ক্ষোভ

২০২৫ সালের ২২ মে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদন পায় সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ এর খসড়া। এতে চার ধরনের শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে সরকারিভাবে চাকরিচ্যুত করার জন্য বিশেষ বিধান অন্তর্ভুক্ত ছিল। খসড়ায় কোনো বিভাগীয় মামলা ছাড়াই শুধু কারণ দর্শানোর নোটিশের মাধ্যমে কর্মচারীকে পদচ্যুত করার কথা বলা হয়। খসড়ার অনুমোদনের মাত্র তিন দিন পর, ২৫ মে রাতেই রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশটি জারি করেন। 

এরপর ২৪ মে থেকে সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবনের বাদামতলায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়ো হতে শুরু করেন। অবৈধ কালো আইন, মানি না মানবো না স্লোগানে মুখর হয় প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র। অল্প দিনের মধ্যেই সচিবালয়ের সব সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে নামে। ২৬ মে সচিবালয়ের প্রধান ফটক বন্ধ করা হয়। দর্শনার্থী ও সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে মোতায়েন করা হয় সোয়াট, পুলিশ, বিজিবি ও আনসার সদস্যদের।

সরকারের টানাপোড়েন ও পর্যালোচনা 

গত ৩ জুন অভ্যন্তরীণ চাপে আইন উপদেষ্টার নেতৃত্বে পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা হয়। কিছু উপদেষ্টা প্রকাশ্যে স্বীকার করেন অধ্যাদেশে অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। তবে কর্মচারীরা অধ্যাদেশ বাতিল ছাড়া কোনো সমাধান মানতে অস্বীকৃতি জানায়।

৩ জুন সচিবালয় কর্মচারী ঐক্য কোরামের নেতাদের কাছ থেকে স্মারকলিপি নেওয়ার পর আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক  আসিফ নজরুল বলেন, “সরকারি চাকরি অধ্যাদেশে কর্মচারীদের আপত্তির বিষয়গুলো পর্যালোচনা করার জন্য উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হবে।  দাবি ও আপত্তিগুলো শোনার জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হবে। সেখানে উপদেষ্টাসহ অন্যরা থাকবেন। কমিটি শিগগিরই গঠন করা হবে। উপদেষ্টা পরিষদের মিটিংয়ে কমিটির সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করা হবে।”

এর পর  ২৩ জুলাই রাতে ‘সরকারি চাকরি (দ্বিতীয় সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করে সরকার।  রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশটি জারি করে । শাস্তি নিশ্চিতে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের বিধান রাখা হয়। যুক্ত হয়েছে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসরের দণ্ড। তবে আগের অধ্যাদেশের মতো এখানেও রাষ্ট্রপতির আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ রাখা হয়নি।

জুলাই মাসে সরকার দ্বিতীয় সংশোধন জারি করে। এতে তদন্ত কমিটি, শুনানির সুযোগ এবং আপিলের বিধান যুক্ত হয়। তবে রাষ্ট্রপতির আদেশের বিরুদ্ধে আপিল না থাকায় আস্থা পুরোপুরি ফেরেনি।

ডিসেম্বরে ভাতার দাবিতে আন্দোলন

বছরের শেষভাগে সরকারি কর্মচারীদের ‘সচিবালয় ভাতা’ দাবিতে সচিবালয় আবার উত্তাল হয়ে ওঠে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই আন্দোলন তীব্র হতে থাকে। কর্মচারীরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারি ভাতা বাড়ানোর দাবিতে চাপ দিয়ে আসছিলেন। বিশেষ করে মাসের শেষ সপ্তাহে সচিবালয়ে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও ভাতার পুনর্বিন্যাসের দাবিতে আন্দোলন প্রকট আকার নেয়।

গত ১০ ডিসেম্বর আন্দোলন তার চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। ওইদিন আন্দোলনকারীরা অর্থ উপদেষ্টাকে প্রায় ছয় ঘণ্টা সচিবালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখেন। কর্মচারীরা ভাতা সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়া পর্যন্ত দপ্তর ত্যাগ করতে বাধা দেন। পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় পুলিশি সহায়তা নেওয়া হয় এবং ড. সালেহউদ্দিন বাধ্য হয়ে সচিবালয় ত্যাগ করেন। সরকারের পক্ষ থেকে ভাতা সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারির আশ্বাস দেওয়া হয়। তবে কর্মচারীদের মধ্যে এর মাধ্যমে আস্থা পুরোপুরি ফিরে আসে না এবং আন্দোলন অব্যাহত থাকে। পরদিন ১১ ডিসেম্বর ফের আন্দোলনে নামলে ১৪ জনকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরে তাদের ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। গত ১২ ডিসেম্বর সচিবালয়ের ১৪ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা মামলায় পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। এর পর ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৪ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

 বরখাস্ত হওয়া কর্মচারীদের মধ্যে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হলেন, সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি বাদিউল কবির, সহ-সভাপতি শাহীন গোলাম রাব্বানী ও নজরুল ইসলাম রয়েছেন। সাময়িক বরখাস্ত হওয়া কর্মচারীদের মধ্যে অন্যরা হলেন- স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মো. তায়েফুল ইসলাম, বিকাশ চন্দ্র রায়, ইসলামুল হক, মো. মহসিন আলী, রোমান গাজী, আবু বেলাল। এছাড়া, তথ্য মন্ত্রণালয়ের মিজানুর রহমান সুমন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী কামাল হোসেন ও মোহাম্মদ আলিমুজ্জামান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিপুল রানা বিপ্লব ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নাসিরুল হক।

এরপর ১৭ ডিসেম্বর ১৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নাজমিন আক্তার তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের জামিনের আবেদন নাকচ করে এ আদেশ দেন।

অধ্যাদেশকে কেন্দ্র করে আন্দোলন, ভাতা দাবিতে উত্তেজনা, অবরোধ, গ্রেপ্তার ও বরখাস্তের ঘটনাগুলো প্রশাসনিক কার্যক্রমে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। সরকারের পক্ষ থেকে দফায় দফায় আশ্বাস ও সংশোধন এলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আস্থাহীনতা পুরোপুরি কাটেনি।

ঢাকা/এএএম/ইভা 

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়