ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ও সরস্বতী পূজা

সন্দীপন ধর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৬, ৩০ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ও সরস্বতী পূজা

জগন্নাথ হলের মাঠে সরস্বতী প্রতিমা

যার মনের মধ্যে আছে সাম্প্রদায়িকতা সে বন্য জীবের সমতুল্য: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

সরস্বতী মূলত বৈদিক দেবি। বেদে সরস্বতী প্রধানত অধিষ্ঠাত্রী দেবি। সরস শব্দের অর্থ জল। অতএব সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো জলবতী অর্থাৎ নদী। সরস্বতী শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ সরস+বতু আর স্ত্রী লিঙ্গে ‘ঈ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে সরস্বতী। তিনি বিদ্যার দেবী, জ্ঞানদায়িনী, বীণাপাণি, কুলপ্রিয়া, পভৃতি নামে পরিচিত।

সরস্বতী নদীরূপা এবং দেবতারূপা। প্রাচীনকালে সরস্বতী নামে একটি নদী ছিল। আর্যরা এই নদীকূলে দীর্ঘকাল বাস করেছে। তাদের কাছে সেই নদী হয়ে গেছে মাতৃরূপা, দেবীরূপা। ধীরে ধীরে সেই নদীরূপা, মাতৃরূপা দেবী হয়েছেন ‘সরস্বতী’। সরস্বতী বাগ্দেবী। বাক্-এর স্তুতি দেখা যায় ব্রাহ্মণসাহিত্যে। আরও পরে তিনি হয়েছেন বাক্-এর অধিষ্ঠাত্রী দেবী, বাগ্দেবী। নানা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে নানা ভাবনায় আজকের সরস্বতীর রূপ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এ বিষয় রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন: ‘আর্য্যাবর্তে সরস্বতী নামে যে নদী আছে তাই প্রথমে দেবী বলে পূজিত হয়েছিল। বর্তমানে গঙ্গা যেমন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপাস্য দেবী হিসেবে পূজা পেয়ে থাকে, তেমনি সরস্বতী হলেন জ্ঞানের দেবী। সরস্বতীর প্রকৃত তাৎপর্য নিহিত রয়েছে সূর্যাগ্নির জ্যোতিতে। সূর্যাগ্নির তেজ, তাপ ও চৈতন্যরূপে জীবদেহে বিরাজ করায় চেতনা ও জ্ঞানের দেবী সরস্বতী, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে গোলোকে বিষ্ণুর তিন পত্নী লক্ষ্মী, সরস্বতী ও গঙ্গার মধ্যে বিবাদের ফলে গঙ্গার অভিশাপে সরস্বতীর নদী রূপ পাওয়াই হচ্ছে সরস্বতীর পৃথিবীতে দেবীরূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার তত্ত্ব।’

বর্তমানে সরস্বতীর বাহন হাঁস। পণ্ডিত কলহনের মতে, সরস্বতী দেবী হংসের রূপ ধারণ করে ভেড়গিরি শৃঙ্গে দেখা দিয়েছিলেন। এই ধারণার সঙ্গত কারণ হংসবাহনা সরস্বতীর মূর্তি প্রচুর দেখতে পাওয়া যায়। তিনি এ বাহন ব্রহ্মার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। কিন্তু ব্রহ্মা বা সরস্বতীর বাহন কিন্তু পাখি নয়। বেদ এবং উপনিষদে হংস শব্দের অর্থ সূর্য। সূর্যের সৃজনী শক্তির বিগ্রহাম্বিতরূপ ব্রহ্মা এবং সূর্যাগ্নির গতিশীল কিরণরূপা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব শক্তি সরস্বতী দেবীর বাহন হয়েছে হংস বা সূর্য, একেবারেই যুক্তিসঙ্গত কারণে। তবে বৈদিক সাক্ষ্য থেকেই জানা যায় সিংহ ও মেষ সরস্বতী দেবীর আদি বাহন ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময় দেবী দুর্গা সরস্বতী দেবীর কাছ থেকে সিংহ কেড়ে নিলেন আর কার্ত্তিক কেড়ে নিলেন ময়ূর। পরবর্তী সময়ে সরস্বতী দেবী হংসকেই তাঁর চিরস্থায়ী বাহনের মর্যাদা দিলেন।

সরস্বতীর এই বাহন সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সর্বত্রই তাঁর সমান গতি। ঠিক যেমনভাবে জ্ঞানময় পরমাত্মা সব জায়গায় বিদ্যমান। মজার ব্যাপার হলো, হংস জল ও দুধের পার্থক্য করতে সক্ষম। জল ও দুধ মিশ্রিত থাকলে হাঁস শুধু সারবস্তু দুধ বা ক্ষীরটুকু গ্রহণ করে। জল পড়ে থাকে। জ্ঞান সাধনায় হাঁসের এ স্বভাব যথেষ্ট তাৎপর্য বহন করে। তাই বিদ্যাদেবীর বাহন হিসেবে হাঁসকেই ভালো মানায়। হাতে বীণা ধারণ করেছেন বলেই তাঁর অপর নাম বীণাপাণি। বীণার সুর মধুর। পূজার্থী বা বিদ্যার্থীর মুখনিঃসৃত বাক্যও যেন মধুর হয় এবং জীবনেও মধুর সংগীতময় হয় এ কারণেই সরস্বতীর হাতে বীণা।

হিন্দুদের দেবী হয়েও কিন্তু বৌদ্ধ বা জৈনদের কাছ থেকেও পূজা পেয়েছেন সরস্বতী। অনেক বৌদ্ধবিহারে সরস্বতীর মূর্তি পাওয়া যায়। জৈনদের ২৪ জন শাসনদেবীর মধ্যে সরস্বতী একজন এবং ষোলজন বিদ্যাদেবীর মধ্যে অনন্যা মা সরস্বতী। হিন্দু তথা সনাতন সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব সরস্বতী পূজা। প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমা কিংবা শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সম্পন্ন হয়। এই পূজায় আলাদা কিছু সামগ্রী লাগে। যেমন অভ্র-আবির, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম, যবের শিষ, এছাড়া বাসন্তী রঙের গাদা ফুল। লোকাচার অনুসারে ছাত্রছাত্রীরা সরস্বতী পূজার আগ পর্যন্ত সাধারণত কুলবড়ই খায় না। সাধারণত পূজার আগের দিন ভক্তরা সংযম পালন করে। অর্থাৎ সেই দিন মাছ-মাংস পরিহার করে নিরামিষ খাবার খায়। তবে সব মিলে এসব আচার-অনুষ্ঠানেও রয়েছে আনন্দ।

পূজার দিন লেখাপড়া সাধারণত বন্ধ থাকে। পূজার পরে দোয়াত-কলম পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রের পূজার প্রচলন আছে। এ দিনে অনেক বাড়িতে শিশুদের পড়াশোনার জন্য হাতেখড়ি দেয়া হয়। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা থাকে উপোষ রেখে অঞ্জলি দেয়া। যেহেতু সরস্বতী বিদ্যা, জ্ঞান এবং ললিতকলার দেবি, সেই কারণে সাধারণত সকল প্রকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই উৎসব অনেক বড় করে পালন করা হয়। সাধারণত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সরস্বতী পূজার আগের দিন থেকে সরস্বতী পূজার পরদিন দধিকর্মা (দই, খই, মিষ্টি, কলা, বাতাসা, ক্ষীর দিয়ে মাখা) খাওয়া এবং মূর্তি বিসর্জন দিয়ে উৎসবের সমাপ্তি হয়। সাধারণত সরস্বতী পূজার দিন দুপুরে প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সকলে মিলে খিচুড়ি, লাবড়া, পায়েসসহ প্রসাদ খাওয়ার প্রচলন রয়েছে।

বাংলাদেশে সরস্বতী পূজা মহাসমারোহে পালিত হয়। বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা এই পূজা করে। ঘরে ঘরেও সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। ঢাকায় সরস্বতী পূজার প্রধান কেন্দ্র ও আকর্ষণের স্থান হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের মাঠ। শোনা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই এখানে সরস্বতী পূজার আয়োজন হয়ে আসছে। জগন্নাথ হলে সরস্বতী পূজার পূর্ব ঐতিহ্য বর্তমান কালেও অক্ষুণ্ন আছে। তবে বর্তমানে এই পূজা ব্যাপকতায় বহুমাত্রিকতা পেয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধীরে ধীরে একটি পূজার জায়গায় বহু পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। হলের কেন্দ্রীয় পূজাটি অবশ্য আছে এবং সেটি অনুষ্ঠিত হয় হলের উপাসনালয়ে।

পুরনো লেখা থেকে জানা যায় জগন্নাথ হলের সাবেক প্রাধ্যক্ষ শহীদ অধ্যাপক ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব ছাত্রদের সঙ্গে একনিষ্ঠ হয়ে পূজায় অংশগ্রহণ করতেন। শোনা যায় জগন্নাথ হলের সরস্বতী পূজা শুরুর সময় হলের আবাসিক শিক্ষক ইতিহাস বিভাগের শহীদ অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র পাঠ করাতেন। পূজা উপলক্ষে সন্ধ্যাবেলা আকর্ষণীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। হল ও দেশের খ্যাতিমান শিল্পীরা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। জগন্নাথ হলে গতবছর কেন্দ্রীয় পূজামণ্ডপ ছাড়াও ৬২টি বিভাগ মিলিয়ে ৭০টি পূজার আয়োজন করেছিল, যার মধ্যে ছয়টি ছিল কর্মচারীদের দ্বারা আয়োজিত। বরাবরের মতো জগন্নাথ হলের পুকুরের মাঝে ছিল চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের নির্মিত মনোজ্ঞ পূজামণ্ডপ ও ৪৫ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন প্রতিমা। বর্তমানে সরস্বতী পূজার পরের দিন এখানে বিভিন্ন মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। জগন্নাথ হলে এখন যে আকারে ও প্রকারে সরস্বতী পূজা হচ্ছে তার দৃষ্টান্ত বিরল। কেবল ঢাকা শহরেই নয়, সমগ্র বাংলাদেশে এর দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত নেই। পূজা উপলক্ষ করে শিল্পীসত্তার বিকাশেরও একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও বেগম রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হল, কুয়েত মৈত্রী হল, ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলসহ বিভিন্ন হলে সরস্বতী পূজার আয়োজন হয় মহা সমারোহে।

এর বাইরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেও মহাসমারোহে বিভিন্ন বিভাগের উদ্যোগে বেশ কিছু পূজার আয়োজন হয়। তাছাড়া বনানী, উত্তরা, শাঁখারী বাজার, তাঁতি বাজার, রামকৃষ্ণ মিশন, ঢাকেশ্বরী মন্দির,  রমনা কালী মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী মন্দির, ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বুয়েটসহ দেশের অন্যান্য স্থানে ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজা উদযাপিত হয়। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের উদ্যোগে সংসদ ভবনসংলগ্ন মানিক মিয়া এভিনিউ-এর রাজধানী উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সরস্বতী পূজা আয়োজিত হয়। গতবছর বাংলাদেশের মাননীয়া স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এই পূজার অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। 

বাংলাদেশে সরস্বতী পূজায় বর্তমানে, প্রাচীন ও আধুনিকতার মেলবন্ধনে বৈচিত্র্য এসেছে প্রতিমার অবয়বে এবং মণ্ডপের সাজসজ্জায়। সবচেয়ে বড় কথা এবং বড় প্রাপ্তি, এই পূজাকে কেন্দ্র করে কেবল শিক্ষার্থীরাই নয়, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব পেশা এবং শিশু-যুবক, বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সমাগম হয় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বিশেষ করে জগন্নাথ হল পরিণত হয় মিলনমোহনায়। সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মনে যে অসাম্প্রদায়িক সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন আছে তার লালন এবং জাগরণ হয়ে উঠছে এই সরস্বতী পূজাকে কেন্দ্র করে। আমার দেখা মতে, শুধু বাংলাদেশেই রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী সরস্বতী পূজা উপলক্ষে তাঁদের শুভেচ্ছা বাণী দেন প্রতিবছর।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ।
 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়