ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

সিআরবি: শুধু সবুজ নয়, ঐতিহ্য বাঁচানোর আকুতি

অনুষ্টুপ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:১৬, ১৫ জুলাই ২০২১   আপডেট: ২১:৩১, ১৫ জুলাই ২০২১
সিআরবি: শুধু সবুজ নয়, ঐতিহ্য বাঁচানোর আকুতি

চট্টগ্রামে সিআরবি প্রাঙ্গণে বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণের প্রতিবাদে মানুষের জমায়েত

চট্টগ্রাম শহর। আশি নব্বই শূন্য- তিন দশকে কেটেছে আমার শৈশব কৈশোর যৌবন। স্বর্গের মতো একটা শহর দেখতে দেখতে ধূলি-ধূসর হয়ে গেল! শহরের প্রত্যেকটি মোড়ে ফুলের বাগান ছিল। নিউ মার্কেট, টাইগারপাস, বাদামতলী, ষোলশহর, জিইসি...। কই গেল সেই বাগানগুলো?

টিলার উপর অপরূপ সুন্দর একটা সার্কিট হাউস! এর নিচে কি সুন্দর পাহাড়ি ঢাল! হাতের উপর ভর করে হেলান দিয়ে সারাটা বিকেল এখানে বসে কাটানো যেত। হুহু করে বাতাস আসত সাগর থেকে। কই গেল সেই খোলা প্রান্তর?

আমাদের স্কুলের পেছনে সারি সারি পাহাড় ছিল। সেই পাহাড় ধরে হেঁটে হেঁটে সুন্দর চলে যেতাম ফয়েজ লেক। বাঁয়ে পড়ে থাকত একটা দারুণ ঝিল! সেই পাহাড় কই? টিভি সেন্টার, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়- সবকিছুর নিচে চাপা পড়ে গেছে একটা সবুজ স্বর্গ। এখন একটু বর্ষা হলে কি নাকালই না হতে হয় এই শহরের লোকজনকে।

এতো হতাশার মাঝে চট্টগ্রামবাসীর গর্বের ধন হলো শহরের মধ্যে এক টুকরো পাহাড়ি সবুজ ভূমি- সিআরবি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এর ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছে। ফলে নগরবাসীর বৈকালিক ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হয়ে উঠেছে এই সিআরবি।

বাবা রেলে চাকরি করতেন। আমাদের বাসাটা সম্ভবত ১৮৯৭ সালের। আমাদের স্কুলের পাশেই ছিল বীরকন্যা প্রীতিলতার স্মৃতিধন্য ইউরোপিয়ান ক্লাব। অল্প দূরেই যুব বিদ্রোহের অন্যতম লক্ষ্যস্থল অক্সিলিয়ারি ফোর্সের অস্ত্রাগার। ফলে শৈশব থেকে ইতিহাসের সমান্তরালে বড় হয়েছি। তাই এই বয়সেও ইতিহাসের নেশা কাটেনি। সিআরবি আমার কাছে কেবল একটা সবুজ ভূ-খণ্ড নয়, তারও অধিক।

উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজরা কাঙ্খিত মুনাফা নিয়ে যেতে পারছিল না। কাপড় মশলা কিংবা আফিমের বাজার ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছিল। তখন ইউরোপজুড়ে চীনের চায়ের রমরমা বাজার। সেই বাজার ধরতে এখানকার ব্রিটিশরা মরিয়া হয়ে উঠল। আসামের বন কেটে গড়ে তোলা হলো বড় বড় চা-বাগান। কিন্তু যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে সেই চা কলকাতায় পাঠানো কষ্ট ও সময়সাপেক্ষ হয়ে উঠল। এই সমস্যা সমাধানে ১৮৯২ সালের ১৮ মার্চ টি-প্ল্যান্টাররা লন্ডনে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে। ১৯০৩ সাল নাগাদ এ কোম্পানি ৭৪০ মাইল রেললাইন তৈরির কাজ শেষ করে। ফলে আপার আসামের সঙ্গে চট্টগ্রাম ও চাঁদপুরের সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। প্রথম এ অঞ্চলে আধুনিক শিল্পায়নের সূচনা হয়।

এই রেল কোম্পানির প্রধান দপ্তর হিসেবে ১৮৯৯ সালে চট্টগ্রামে এক বিশাল লাল দালান তৈরি করা হয়। একে ঘিরে ১৬০ একর জায়গায় বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পিত শহর গড়ে তোলে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়াররা। জায়গাটি আগে সেনাবাহিনীর ছিল। ব্রিটিশ সরকার রেলওয়ে কোম্পানিকে দেয়। যেহেতু এটি কেন্দ্রীয় দপ্তর, তাই এর নাম দেওয়া হয় সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং। সংক্ষেপে সিআরবি।

আজকের সিআরবি থেকে একসময় পুরো আসাম এবং বাংলার একটি বড়ো অংশের রেল যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করা হতো। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের স্থলভাগের কাজ তদারকি করত। এ কোম্পানির হাতেই চট্টগ্রাম বন্দরের বিকাশ।

১৯৪২ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে, ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের সঙ্গে এক হয়ে বেঙ্গল অ্যান্ড আসাম রেলওয়েতে রূপান্তরিত হয়। সেই কোম্পানির সদর দপ্তর আর চট্টগ্রামে থাকেনি। চলে যায় কলকাতা। ১৯৪৭ সালে সিআরবি আবার তার হৃত গৌরব ফিরে পায়। এ অঞ্চলের রেলওয়ের সদর দপ্তর হয় সিআরবি। ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে বোর্ড গঠিত হলে এর সদর দপ্তর হয় সিআরবি। (তথ্যসূত্র: রেলকে ঘিরে- জয়দীপ দে)

সিআরবি তাই শুধু একটি সবুজে ঘেরা লোকালয়ই নয়, চট্টগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল অতীতের সাক্ষী। এই জায়গাটুকু আধুনিক ইমারতের তলায় চাপা পড়ে গেলে অনেক কিছুই বিস্মৃত হয়ে যাবে। চট্টগ্রাম শহরে এর আগেও রেলওয়ের ভূমিতে অনেক হাসপাতাল হয়েছে। ইউএসটিসি, হলিক্রিসেন্ট, কিডনি ফাউন্ডেশন, চক্ষু হাসপাতাল, ইম্পিরিয়াল হাসপাতাল, ডায়বেটিস হাসপাতাল ইত্যাদি। দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া বাকিগুলো থেকে রেলওয়ে কিংবা নগরবাসী কী উপকার পেয়েছেন একটু বিবেচনার দাবি রাখে। সিআরবিতে হাসপাতাল করার জন্য একটি শিল্পগোষ্ঠী বিশাল বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরেরও নাকি আগ্রহ আছে। খুব ভালো কথা। হাসপাতাল হোক। কিন্তু সরকার চাইলে চট্টগ্রামে প্রচুর ‘১০ একর’ জায়গা পাবে, কিন্তু সিআরবি পাবে না। অবশ্য সিআরবি হারিয়ে গেলে এ শহরে অনেক হাসপাতালের প্রয়োজন হবে- এটা নিশ্চিত।

হালিশহরে, ফৌজদারহাট, কুমিরার রেলওয়ের প্রচুর পরিত্যক্ত ভূমি আছে। কর্ণফূলি শাসন করলে হাজার হাজার একর ভূমি উদ্ধার করা সম্ভব। এসব ফেলে সিআরবিকেই কেন বেছে নেয়া হলো আমার বোধগম্য নয়।

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়