ঢাকা     সোমবার   ২৭ মে ২০২৪ ||  জ্যৈষ্ঠ ১৩ ১৪৩১

বিচার না-চাওয়ার সংস্কৃতি জোরদার হচ্ছে কেন?

জোবাইদা নাসরীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৩, ২৫ এপ্রিল ২০২২   আপডেট: ১১:০৩, ২৬ এপ্রিল ২০২২
বিচার না-চাওয়ার সংস্কৃতি জোরদার হচ্ছে কেন?

২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশে লেখক-প্রকাশক, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের উপর ধারাবাহিক হামলার মধ্যে আজিজ সুপার মার্কেটে নিজের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জাগৃতির কার্যালয়ে হত্যা করা হয় প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে। সেই হত্যাকাণ্ডের পর দীপনের পিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেছিলেন, ‘আমি বিচার চাই না, সকলের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক’।

তাঁর সেই বক্তব্য নিয়ে উপহাস করেছিলেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাসহ আরও অনেকে। তাঁর বক্তব্যের মূল পর্যবেক্ষণ সম্ভবত সরকারী দলের নেতারা বুঝতে পারেননি কিংবা সেটিকে ভিন্নখাতে নেওয়ার জন্য পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তিনি কেন  বিচার চান না?’ 

ঠিক একই বিষয়ের যেন পুনরাবৃত্তি শুনলাম দীপন হত্যাকাণ্ডের প্রায় ৭ বছর পর। ঢাকা কলেজ এবং নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী এবং কর্মচারীদের মধ্যেকার সংঘর্ষে প্রাণ হারানো নাহিদের বাবার মুখে। নাহিদের বাবা নাদিম হোসেন গণমাধ্যমে জানিয়েছেন নাহিদের মৃত্যর ঘটনায় তিনি মামলা করবেন না। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা অসহায় মানুষ। আমার ছেলে একটা ঘটনায় মারা গেছে। আমি চাই দোষীদের বিচার হোক। কিন্তু আমি মামলা করুম না’। যদিও নাহিদের স্ত্রী ডলি বলেন, ‘আমি এ ঘটনার বিচার চাই, ক্ষতিপূরণ চাই।‘

এই ঘটনায় আরও মারা গেছেন মুরসালিন নামে একজন দোকান কর্মচারী। তার ভাইও ঠিক একই কথা জানান সাংবাদিকদের। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী সাংবাদিকতরা যখন তাঁর ভাইয়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন- তিনি মামলা করবেন কিনা? তখন মুরসালিনের ভাই জানান, ‘... কার নামে মামলা করবো? ভাইটা কীভাবে মারা গেল, কিছুই জানলাম না। এটা কেবল ও আর আল্লাহ জানেন।‘

গত এক মাসে বেশ কয়েকটি মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে মৃতের পরিবারের সদস্যদের বিচার না-চাওয়ার মনস্কতা বুক ধুকধুক করার পাশাপাশি এক বড়সড় প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। গত মাসের ২৪ তারিখ রাজধানীর শাহজাহানপুরের আমতলা মসজিদ এলাকায় দুর্বৃত্তরা হত্যা করে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে। সে সময় দুর্বৃত্তদের গুলিতে আহত হন টিপুর গাড়ির পাশেই রিকশায় থাকা বদরুন্নেসা কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া আফরিন প্রীতি। পরে তিনি মারা যান। প্রীতির মা-বাবাও আদরের সন্তান হত্যার কোনো ধরনের বিচার চাননি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী প্রীতির মা-ও বিচার চাননি। বলেছেন, ‘বিচার চাই না। শুধু মেয়ের লাশ পৌঁছে দিলেই হবে।’ 

আর গণমাধ্যম প্রীতির বাবার বক্তব্য এভাবে জানিয়েছে: ‘আমি কোনো আইনগত ব্যবস্থা নিতে চাই না... মেয়ে হত্যার বিচার চাই না। মামলা চালানোর মতো অবস্থাও নেই। আমরা নিরীহ মানুষ। বিচার চাইলে আল্লাহর কাছে চাই।

গত পহেলা এপ্রিল রাতে খিলগাঁও তিলপাপাড়া এলাকায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় মোটর সাইকেলে স্বামীর সঙ্গে থাকা নাসরিন পড়ে যান এবং মারা যান। নাসরিনের স্বামীও স্ত্রী হত্যার বিচার চাননি।  

দীপনের বাবা, প্রীতির বাবা, নাসরিনের স্বামী, নাহিদের বাবা কিংবা মুরসালিনের ভাই কেউই কেন বিচার চান না? ধরে নেই নাহিদের বাবা কিংবা মুরসালিনের ভাই বিচার চান না, কারণ মামলা চালিয়ে নেওয়ার মতো তাদের অর্থনৈতিক সংগতি নেই। কিন্তু অন্যরা সেই ইঙ্গিত না দিলেও আরও অনেক ইঙ্গিতই দিয়েছেন। কেন এখন মানুষ আর বিচার চান না। কেউ কেউ মামলা করেই পিছিয়ে যায়, আবার কেউ কেউ আপোষ করতে বাধ্য হয়? আবার কেউ বিচার চাইলেও আইনের কাছে চায় না? আল্লাহ বা ঈশ্বরের কাছেই বিচার চায়। কেন এখন বিচারহীনতার সংস্কৃতি টপকে বিচার না-চাওয়ার সংস্কৃতি জোরদার হচ্ছে? কেন এই আস্থাহীনতার জায়গা?

এর উত্তর হতে পারে অনেক কিছুই। মানুষ জেনে গেছে মামলা করতে এবং সেটি চালিয়ে নিতে ঘাটে ঘাটে অনেক পয়সা খরচ করতে হয়। মামলা চালাতে গিয়ে বেশিরভাগই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর হয়ে যায়। এদেশে মামলার রায় পেতে বহু সময় লাগে। মানুষ  আরও জেনে গেছে, এদেশে  বিচার পেতে শুধু টাকা নয়, ক্ষমতাও লাগে। তা না-হলে উল্টো সমস্যা হয়, যেটি প্রীতির বাবার কথায় প্রতিফলিত হয়েছে। প্রতিপক্ষ শক্তিশালী হলে ন্যায়বিচার তো দূরের কথা উল্টো আরও জীবনের হুমকি তৈরি হয়। তৃতীয়ত নাহিদ কিংবা মুরসালিনের ক্ষেত্রে মামলা কার বিরুদ্ধে করবেন সেটি তারা জানেন না। কারণ তারা লাশ পেয়েছেন। খুনীর পরিচয় জানেন না। তারপর এতো কিছু পেরিয়ে ন্যায়বিচার পাবেন কিনা সেই বিষয়েও তাঁরা নিশ্চিত নন। আর দরিদ্রের জন্য এই বিচার পাওয়া অনেক দুরহের বিষয়ও। তাই বিচার এখন মানুষ আর চায় না। 

আমরা এতোদিন ধরে বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কথা বলছি, লড়াই করেছি। বিচার নেই বলেই বেড়ে চলেছে অপরাধ- বলে এসেছি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো এদেশে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থেকে শুরু করে যখন সাধারণ মানুষও বুঝে যায় দেশে বিচার বলতে খুব বেশি কিছু অবশিষ্ট নেই, তখন বিচারের কথা না বলাই ভালো। 

এই যে বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা, এটি হেলাফেলার বিষয় নয়, বরং বড় বিপদের সংকেত। বিচার না-চাওয়ার সংস্কৃতির বিকাশমান দুঃখজনক এই ধারা আমাদের এক গভীর সুড়ঙ্গের ইঙ্গিত করছে, আমরা যার কাছেই দাঁড়িয়ে আছি।  

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়