আ.লীগের ‘গলারকাঁটা’ বিদ্রোহী প্রার্থী
এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম
সাংগঠনিকভাবে বহিষ্কারের মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরও স্থানীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা দমছে না। চলমান পৌরসভা নির্বাচনের প্রতিটি ধাপেই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থী চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন দলের মনোনীত প্রার্থীদের।
প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে অনেকগুলো পৌরসভায় দলীয় প্রার্থীকে পেছনে ফেলে জয়ী হয়েছেন বিদ্রোহীরা। সবশেষ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও ৭জন কাউন্সিলর প্রার্থী জয়ী হয়েছেন, যারা দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচন করেছেন। শনিবার (৩০ জানুয়ারি) দেশের ৬৪টি পৌরসভায় নির্বাচন। সেখানেও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে।
বিদ্রোহী প্রার্থীদের এই উত্থান ভালো হিসেবে দেখছে না আওয়ামী লীগ। যে কারণে ভবিষ্যতে দলের কোনো পর্যায়ের নির্বাচনে মনোনয়ন না দেওয়া এবং সাংগঠনিক পদ কেড়ে নেওয়াসহ কখনোই দলের সঙ্গে যুক্ত না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।
দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, যারা নৌকার বিপক্ষে গিয়ে বিদ্রোহ করবে এবং জনপ্রতিনিধি বিদ্রোহে উসকানি দেবে তাদের ভবিষ্যতে মনোনয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ দলীয় কোনো পদ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে হবে।
‘যারা দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছে এবং এখনো মাঠে আসে তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ অবস্থান স্পষ্ট। বিদ্রোহীদের যারা মদদ অথবা উসকানি দিচ্ছে, তাদেরও একই শাস্তি পেতে হবে’, বলেন তিনি।
ওবায়দুল কাদের বিদ্রোহী ও উসকানিদাতাদের অনতিবিলম্ব সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়ে বলেন, তা না হলে দল কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে।
দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলীয় মনোনয়নের বিপক্ষে গিয়ে বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচনে স্থানীয় রাজনীতির গ্রুপিং দায়ী। দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতিতে গ্রুপিং রাজনীতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। নিজ এলাকায় নিজেদের প্রভাব বলয় ঠিক রাখতে কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতা, এমপি, মন্ত্রী পর্যন্ত জড়িয়ে পড়ছেন।
সম্প্রতি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট পৌরসভা নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোটভাই আবদুল কাদের মির্জা স্থানীয় নেতাদের সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। এর কিছুদিন পর নোয়াখালী-৪ (সদর ও সুবর্ণচর) আসনের সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী ফেসবুক লাইভে এসে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের পরিবার নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। এ নিয়ে স্থানীয় রাজনীতি তো বটেই পুরো দেশে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয় বিষয়টি। শুধু নোয়াখালী নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে। বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়ানো এটি প্রধান কারণ বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা।
তারা বলছেন, প্রতিপক্ষ বিএনপি রাজনীতিতে ম্লান হয়ে পড়ার কারণে আওয়ামী লীগে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতিতে গ্রুপিং আগেও ছিল, কিন্তু গত কয়েক বছরে তা বেড়েছে কয়েকগুণ। পরিস্থিতি বিবেচনায় তা কখনো কখনো রাজনৈতিক সৌজন্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। এই সংস্কৃতির লাগাম টেনে ধরতে না পারলে ভবিষ্যতে নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে মাশুল দিতে হবে পারে বলেও আশঙ্কা তাদের।
প্রথম দফার মতো দ্বিতীয় ধাপের পৌরসভা নির্বাচনে ৬০টি পৌরসভার মধ্যে ২১টিতেই ছিল আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। এর মধ্যে বেশ কয়েকটিতে জয়লাভ এবং কিছুসংখ্যক পৌরসভায় জয়ের কাছাকাছি ছিল তারা। এ নিয়ে কয়েকটি পৌরসভায় দলের অভ্যন্তরে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এতে নিহতও হয়েছেন দলের নেতাকর্মীরা। চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের দলীয় কাউন্সিল প্রার্থীর সমর্থকদের সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মারামারিতে প্রাণ গেছে একজনের। আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত অমান্য করে যারাই পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হয়েছেন, তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। তারপরও দমছে না বিদ্রোহী প্রার্থীরা।
তারা বলছেন, দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ, ত্যাগ এবং যোগ্যতা থাকার পরও অনেকে মনোনয়ন পাচ্ছে না। অভিমান আর ক্ষোভ থেকেই অনেকে প্রার্থী হচ্ছেন। আর সুযোগ বুঝে তাতে উসকানি দিচ্ছে দলেরই নেতাকর্মীরা।
এ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক খান রাইজিংবিডিকে বলেন, যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হচ্ছেন অনেককে আমরা নিরুৎসাহিত করছি, বোঝাচ্ছি; যে দলের সিদ্ধান্ত মানতে হবে। দলীয় শৃঙ্খলা মেনে অনেকে নির্বাচন থেকে সরেও দাঁড়াচ্ছেন। কিন্তু অনেকে বিষয়টি তোয়াক্কা করছে না। তাদের জন্য কঠোন হবে দল।
যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হচ্ছেন তাদের দুটি অংশে বিভক্ত করেছেন আওয়ামী লীগের অন্যতম এই নীতি নির্ধারক। তিনি বলেন, বিদ্রোহী প্রার্থীদের একটি অংশ হচ্ছে দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কারণে অনুপ্রবেশকারীরা। তারা বিভিন্ন সময়ে এসে দলে ঢুকে এখন সুযোগ নেওয়ার জন্য প্রার্থী হচ্ছেন, উসকানি দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের ভোট কমানোই তাদের উদ্দেশ্য। অন্য একটি দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ, ত্যাগী আছেন। তারা দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে অভিমান থেকে হয়তো দলের বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন।
দলের ত্যাগী নেতা, অথচ মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে দলের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন এমন নেতাদের দলীয় শৃঙ্খলা মানার পরামর্শ দিয়েছেন ফারুক খান।
‘দীর্ঘদিন রাজনীতি করে দলের যে অবস্থান তৈরি করেছেন মনোনয়ন না পেয়ে দলের বিপক্ষে গিয়ে সেই অবস্থান হারাবেন না। ভবিষ্যতে হয়তো আপনি মনোনয়ন পেতেও পারেন। কারণ যারা দলীয় শৃঙ্খলা মানবে না তারা কখনো দলের হবেন না’, সতর্ক করেন তিনি।
পারভেজ/সাইফ
আরো পড়ুন