ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

২০০৯ থেকে ২০২১ উন্নয়নের স্বর্ণালী যুগ

কেএমএ হাসনাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:০২, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১  
২০০৯ থেকে ২০২১ উন্নয়নের স্বর্ণালী যুগ

২০০৯ থেকে ২০২১ উন্নয়নের স্বর্ণালী যুগ। উন্নয়নের প্রায় প্রতিটি সূচকেই অকল্পনীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফলতার প্রমাণ বহন করে। নানা ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে মাথাপিছু আয়, খাদ্য ও পুষ্টিপ্রাপ্তি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সামাজিক নিরাপত্তাসহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। এমনকি, ভয়াবহ করোনা মহামারি ও দীর্ঘ লকডাউনও বাংলাদেশের অগ্রগতিকে আটকাতে পারেনি।

ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার টানা এক যুগ অতিক্রম করেছে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘদিন বাংলাদেশের অর্থনীতির বুকে এক জগদ্দল পাথর চেপে বসেছিল। ১৯৯৬ সালে ৫ বছরের জন্য আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পায়। এ সময় অর্থনীতির চাকা কিছুটা সচল হয়েছিল। ২০০১ সালের পর ৫ বছর জামায়াত-বিএনপি জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে অর্থনীতির গতি আবার স্থবির হয়ে পড়ে। পরে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার নির্বাচিত হয়। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতা পাওয়ার পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটিকে। দেশি-বিদেশি চক্রান্তকে পিছে ফেলে নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সক্ষমতা প্রমাণ করে। সেই থেকে শুরু হয়েছে সামনে এগিয়ে যাওয়া। এর মধ্যেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও হয়েছে।

সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বর্তমান সরকারের টানা এক যুগের শাসনামল ‘উন্নয়নের স্বর্ণালী যুগ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে দেশের সার্বিক অথনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.০১ শতাংশ, ২০১৯-২০২০ অর্থবছর তা দাঁড়ায় ৮.১৫ শতাংশে। অর্থাৎ এ সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২.১৪ শতাংশ বেড়েছে। সে সময় জিডিপির আকার ছিল ৯১.৬ বিলিয়ন ডলার, তা বেড়ে হয়েছে ৩৩০.১ বিলিয়ন ডলার। জিডিপির আকার বেড়েছে ২৩৮.৫ বিলিয়ন ডলার। একইভাবে মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল ৬৮৬ মার্কিন ডলার। তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৪ মার্কিন ডলারে। অর্থাৎ মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১ হাজার ৩৭৮ মার্কিন ডলার।

২০০৭-২০০৮ অর্থবছর দেশে মোট কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছিল ৪ কোটি ৭৩ লাখ। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় ৬ কোটি ৮২ লাখ। কর্মসংস্থান বেড়েছে ২ কোটি ৯ লাখ। এ সময় মূল্যস্ফীতির বার্ষিক গড় ছিল ১২.৩০ শতাংশ। তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫.৬৫ শতাংশে। উচ্চ দারিদ্র‌্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ। তা কমে দাঁড়ায় ২০.৫ শতাংশে।  নিম্ন দারিদ্র‌্যের হার ছিল ২৫.১ শতাংশ। তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০.৫ শতাংশে। অর্থাৎ ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরের তুলায় ২০১৯-২০২০ অর্থবছর উচ্চ দারিদ্র‌্যের হার কমেছে ১৯.৫ শতাংশ এবং নিম্ন দারিদ্র‌্যের হার কমেছে ১৪.৬ শতাংশ। এছাড়া, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকায়। এক্ষেত্রে বরাদ্দ বেড়েছে ৭৯ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা।

২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে বিনিয়োগ-জিডিপির অনুপাত ছিল ২৬.১৯ শতাংশ। তা ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ৩১.৭৫ শতাংশে। সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) ছিল মাত্র ৭৬৮.৬৯ মিলিয়ন ডলার। তা ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে ৩.৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ পূর্ববর্তী বিএনপি-জামায়াত শাসনামলের চেয়ে বর্তমান সরকারের সময় এ ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় উন্নয়ন হয়েছে।

বাজেট বরাদ্দ থেকেও বিগত আর বর্তমান সরকারের শাসনামলে তুলনা করা যায়। ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে তৎকালীন সরকারের বাজেট বরাদ্দ ছিল ৭৯ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা।

২০০৭-২০০৮ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ছিল ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ২ লাখ ৫ হাজার ১৫ কোটি টাকায়। ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল ৫৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয় ২ লাখ ৬৩ হাজার ৬০ কোটি টাকা।

মার্চেন্ডাইজ রপ্তানি এক যুগের ব্যবধানে প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে এ খাতে আয় হয়েছিল ১৪.১ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০২০ অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০.৫ বিলিয়ন ডলারে। বিএনপি- জামায়াত জোট সরকারের সময় অর্থাৎ ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল ৭.৯ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বিদেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ১৮.২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠায়।

২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৬.১ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩৬ বিলিয়ন ডলার। ব্যাংকের মোট ঋণ স্থিতি ছিল ২ লাখ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ১০ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকায়। ব‌্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১০.৮ শতাংশ, তা কমে দাঁড়ায় ৮.৮৮ শতাংশে। ঋণের সুদের হার ছিল ১২.৩ শতাংশ। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ৭.৬ শতাংশে। পুঁজিবাজারের বাজার মূলধন ছিল ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে তা ৪ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। জামায়াত-বিএনপি শাসনামলে পুঁজিবাজারের দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২৮.৫ কোটি টাকা। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে ৬৪৮ কোটি টাকায়।  অর্থাৎ দেশের ভগ্নপ্রায় পুঁজিবাজারের ভিত্তি অনেক মজবুত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার শুরু থেকেই কৃষি খাতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের তৃতীয় ধান উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে সারের দাবিতে কৃষককে জীবন দিতে হয়েছে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ সরকার কৃষি খাতে ভর্তুকি এবং কৃষি ঋণের পরিমাণ কয়েক গুণ বাড়িয়েছে। ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে কৃষি খাতে মোট ভতুর্কি দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৪০ কোটি টাকা এবং কৃষি খাতে গড়ে ঋণ বিতরণ করেছে ৬ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা। ২০১৯-২০২০ অর্থবছর কৃষি খাতে মোট ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ৭ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা। ঋণ বিতরণ করেছে ২২ হাজার ৭৪৯ টাকা। গত এক যুগে চাল উৎপাদনে এক বৈপ্লবিক উন্নয়ন হয়েছে। এ সময় দেশে জনসংখ্যা বেড়েছে, শিল্পায়নের প্রয়োজনে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমেছে। এক পর্যায়ে সরকার কৃষিজমিতে শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে দেশে চাল উৎপাদন হয়েছিল ২ কোটি ৮৯ লাখ মেট্রিক টন। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে চাল উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৬৫ লাখ মেট্রিক টন চাল।

বিএনপি-জামায়াত জোটের পর সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দেশে বিদ্যুতের অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। যার প্রভাব সামাজিক-অর্থনৈতিক খাতের উন্নয়নকে ব্যাহত করেছিল। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ সরকার বেসরকারি খাতে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ওপর জোর দেয়। এতে বিরোধী দলসহ দেশের এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৫ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে তা ২১ হাজার ২৩৯ মেগাওয়াটে দাঁড়ায়। এছাড়া, সে সময় বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠি ছিল ৪৭ শতাংশ, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে তা ৯৯ শতাংশে দাঁড়ায়। পার্বত্য অঞ্চলের কিছু দুর্গম অংশে এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তবে এসব এলাকায় সোলার বিদ্যুৎ দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। তাহলে সরকারের প্রতিশ্রুতি দেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় চলে আসবে।

নাগরিক সুবিধা খাতেও ঘটেছে ব্যাপক উন্নয়ন। ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে সুপেয় পানির আওতায় ছিল ৮৪ শতাংশ জনগণ। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৯৯ শতাংশ জনগণ এর আওতায় এসেছে। স্যানিটাইজেশনের আওতায় ছিল ৭৬ শতাংশ মানুষ। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৯৯ শতাংশ জনগণ এ সুবিধার আওতায় এসেছে। গড় আয়ু ৬৬.৮ বছর থেকে ৭২.৬ বছরে উন্নীত হয়েছে। শিশুমৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ৪১ জন, তা নেমে এসেছে ২২ জনে। শিক্ষার হার ৫৪.৪ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৭৩.৯ শতাংশ হয়েছে। কারিগরি শিক্ষার হার ছিল ২ শতাংশ, তা বেড়ে হয়েছে ১৭ শতাংশ। প্রাথমিক বিদ‌্যারয়ে ভর্তির হার ছিল ৮৭ শতাংশ, তা হয়েছে ৯৮ শতাংশ।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগকেন্দ্রিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. আবু এম ইউসুফ বলেন, ‘আমরা যদি পরিসংখ্যানগুলো বিশ্লেষণ করি, তাহলে এক বাক্যে বলতে হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের গুণে দ্রুত উন্নয়ন হয়েছে। বাংলাদেশ শুধু এশিয়ায় নয়, বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শুধু বিস্ময় নয়, উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে অভিহিত।‘

তিনি আরও বলেন, ‘খুব শিগগির আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিচিত লাভ করব। উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত থাকলে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বাংলাদেশ উন্নত দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।’

হাসনাত/রফিক

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়