ঢাকা     সোমবার   ০৬ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৩ ১৪৩১

ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাড়ছে জীবনের বোঝা  

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:০৩, ১২ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১২:৩৮, ১২ মার্চ ২০২১
ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাড়ছে জীবনের বোঝা  

নদীর এক পাশে সুন্দরবন, অন্যপাশে ঝুলন্ত বাড়ি। খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার কালাবগি থেকে তোলা ছবি

১২ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১০ ফুট প্রস্থের একটি ঘর। এ ঘরেই ফারুক হোসেন সরদার (৫৫)পরিবার নিয়ে বাস করেন। এক ঘরেই পরিবারের ৬ সদস্যের বসবাস। রান্নাও হয় এই ঘরেই। রাতে পরিবারের সবাই ঘুমানোর পর ফারুক হোসেনের জন্য জায়গা থাকে না। তিনি তখন আশ্রয় নেন স্থানীয় মসজিদের বারান্দায়। ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ফারুক হোসেনকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে। নিজ গ্রাম, বাবার ভিটে ছেড়ে তিনি চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন ১০৬ কিলোমিটার দূরের শহরে।

‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমার জীবনের বোঝা বাড়িয়ে দিয়েছে। কৃষি এবং চিংড়ি খামার করে জীবন ভালোই চলছিল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় আম্পান আমাকে এলাকা থেকেই বিতাড়িত করেছে। এখন আমি খুলনা শহরতলীতে ভ্যান চালাই। ১৯৮৮ সালের ঘূর্ণিঝড় থেকে শুরু করে প্রতিটি দুর্যোগেই আমার ক্ষতি হয়েছে।’ বলছিলেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধাক্কায় অসহায় ফারুক হোসেন।

তার বাড়ি ছিল বাংলাদেশের পশ্চিম উপকূলের সাতক্ষীরা জেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের চাকলা গ্রামে। কপোতাক্ষ নদীর গা ঘেঁষে থাকা গ্রামটি আম্ফানের আঘাতে প্রায় বিলীন! ফলে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসতে হয়েছে ফারুক হোসেনসহ আরও অনেককে। 

চাকলা গ্রাম পরিদর্শনের সময় সেখানকার বিপন্ন চিত্র চোখে পড়ে। গ্রামের বয়স্ক বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ১৯৮৮ সালের সাইক্লোন এই এলাকায় আঘাত করেছিল ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে। এরপর ২০০৭ সালে সাইক্লোন সিডর, ২০০৯ সালে সাইক্লোন আইলায় গ্রামটির ব্যাপক ক্ষতি হয়। বুলবুল, ফণীসহ আরও কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে এই গ্রামের উপর দিয়ে। সর্বশেষ আম্ফান গ্রামটিকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। ২০২০ সালের এই দুর্যোগে গ্রামের মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিয়েছে। যারা বসতভিটা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন তাদের অনেকেই পুনরায় আর নিজ বাড়িতে ফিরতে পারবেন না।

শুধু চাকলা নয়, আম্পানের আঘাতে আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়ন ৯ মাসেরও বেশি সময় ধরে পানির তলায় ডুবে আছে। গোটা ইউনিয়নের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষ পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছে। অনেকেই কাজের সন্ধানে শহরে চলে গেছেন। এমন বেশ কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

শাহজাহান মোড়ল যেখানে নৌকা চালাচ্ছেন, সেখানেই ছিল তার কৃষি জমি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাকে কৃষক থেকে নৌকার মাঝি বানিয়েছে। সাতক্ষীরার কুড়িকাহুনিয়া গ্রামের ছবি

দুর্যোগ জীবনের বোঝা

‘ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে আমাদের জীবন আজ বিপর্যস্ত। অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। অথচ ব্যয় বাড়ছে। মানুষ ঋণের জালে আটকা পড়ছে। দুর্যোগের কারণে এই এলাকায় নদী ভাঙন এবং খাবার সংকটও বেড়েছে।’ বলছিলেন সুতারখালী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোনতাজ উদ্দিন সানা।

তিনি জানান, আইলার পরে বিভিন্ন সময়ে কালাবগি গ্রাম থেকে দুই শতাধিক পরিবার অন্যত্র চলে গেছে। এলাকায় স্বাভাবিকভাবে বসবাসের সুযোগ নাই। কিন্তু যাদের অন্য কোথাও যাওয়ার সামর্থ্য নেই, তারা এলাকায় কষ্ট করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ক্ষয়ক্ষতি অনুযায়ী পুনর্বাসনে সরকারি সহায়তা খুবই সামান্য। আইলার পরে ইউনিয়নের সব পরিবার সরকারি তরফে ২০ হাজার টাকা করে অর্থ সহায়তা পেয়েছেন। কিন্তু পুনর্বাসনের জন্য বড় কোনো সহায়তা পাননি।

দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নের বেশ বড় গ্রাম গুনারী। আইলার আঘাতে এই গ্রামের বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। এই গ্রামের প্রকাশ বিশ্বাসের স্ত্রী রুদ্রা রানী বিশ্বাস (৩৫) বলেন, ‘আইলা আমাদের সব নিয়ে গেছে। শিবসা নদীর তীরে বারবার বেড়িবাঁধ দেওয়া হলেও আমাদের রক্ষা হয়নি।’ পুরনো বেড়িবাঁধ দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘ওর পাশেই আমাদের বাড়ি ছিল। আইলার পরে প্রায় পাঁচ বছর ওই বাঁধের উপরে ছিলাম। নতুন বাঁধ হওয়ার পরে সেই বাঁধের উপরেও ছিলাম অনেক দিন। দুর্যোগ এলেই এখন আমাদের ভয় হয়!’

খুলনা অঞ্চলে কর্মরত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রূপান্তর-এর নির্বাহী পরিচালক রফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘এ অঞ্চলে এক সময় ধান চাষ হতো। জমিতে লবণাক্ততা বেড়েছে। ফলে মাছ চাষ করতে হচ্ছে। পাঁচ বছর পরে সেই লবণাক্ততার পরিমাণ আরো বেড়ে যাচ্ছে। ফলে মাছ চাষ বাদ দিয়ে কাঁকড়া চাষ করতে হচ্ছে। এই যে পরিবর্তন, এখান থেকেই এলাকার মানুষ জলবায়ু পরিবর্তন বুঝতে পারে। দক্ষিণাঞ্চল বা উপকূল অঞ্চলকে এক সময় খাদ্য ভাণ্ডার বলা হতো। এখন পরিস্থিতি উল্টো হয়ে গেছে। এখন উত্তারাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে আমাদের এলাকায় চাল আসে। এটি ব্যাপক পরিবর্তন।’

সাইক্লোন আইলার ক্ষত এই ঝুলন্ত গ্রাম। এক সময় এখানে ছিল সবুজের সমারোহ। খুলনা জেলার কালাবগি থেকে তোলা ছবি

নাজুক যাতায়াত ব্যবস্থা

‘আমরা এখন জলহস্তির মতো বেঁচে আছি।’ এক বাক্যে নিজের অবস্থা এভাবেই তুলে ধরেন কালাবাগি গ্রামের ফকিরকোনা গ্রামের বাসিন্দা কুলসুম বেগম। বসবাসের ঘর প্রসঙ্গে এ কথা বলেন তিনি। কুলসুম বলেন, ‘বর্ষাকালে পানিতে ভাসি। ঘর ডুবে যায়। পানি থেকে বাঁচতে ঘর উঁচু করেছি। আগে আমরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে হাটবাজারে যেতে পারতাম। এখন সেই সুযোগও নাই। আম্ফান রাস্তাও ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আমরা এখন দ্বীপের বাসিন্দা।’

দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নের কালাবগি গ্রামের বেড়িবাঁধের ওপরে দাঁড়ালে বেড়িবাঁধের বাইরে চোখে পড়ে কয়েকশ ঝুলন্ত বাড়ি। নতুন বেড়িবাঁধ হলেও এই বাড়িগুলো বেড়িবাঁধের বাইরে। প্রাকৃতিক সম্পদ নির্ভর এই মানুষেরা এখানেই টিকে থাকার লড়াই করছে। ঠিক একই দৃশ্য চোখে পড়ে সুতারখালী ইউনিয়নের গুনারী গ্রামে। এই গ্রামের নতুন বেড়িবাঁধের উপরে উঠেছে সারি সারি ঘর। এই গ্রামের রুদ্রা রাণী বিশ্বাস, আমিনুর গাজী, আবদুস সাত্তার সরদার, ননী গোপাল মণ্ডলসহ আরও অনেকে এই বেড়িবাঁধের নিকটেই থাকেন। তারা বলছেন, অনেক দুর্যোগ গেছে তাদের ওপর দিয়ে। একটার পর একটা বেড়িবাঁধ দেওয়া হয়, কিন্তু সেগুলো টেকে না। কংক্রিটের ব্লক না দিলে বেড়িবাঁধ টেকসই হবে না।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কোস্টাল লাইভলিহুড এন্ড এনভায়রনমেন্ট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (ক্লিন)-এর প্রধান নির্বাহী হাসান মেহেদি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গত এক বা দেড় দশকে ঘূর্ণিঝড়ের পরিমাণ বেড়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে নতুন নতুন এলাকায় লবণাক্ততা বেড়েছে। দুর্বল অবকাঠামোর কারণে বেড়িবাঁধ ভেঙে বিপুল এলাকায় ক্ষতি হচ্ছে। পরিবেশগত বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন এলাকায় উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার জালিয়াখালী নামের গ্রামটি পুরোপুরি হারিয়ে গেছে আইলার পরে। একই উপজেলার কালাবগি ও নলিয়ান এলাকায় ব্যাপক হারে নদী ভাঙছে। ফলে কালাবগি বিলুপ্তির পথে।’

এক সময় সবকিছুই ছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগে এখন তারা নিঃস্ব। খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার কালাবগি থেকে তোলা ছবি

তিনি আরো বলেন, ‘অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে গাছপালার পুনর্জন্ম হতে পারছে না। সুন্দরী গাছ খুবই ঝাকরা এবং ছোট হয়ে গেছে আগের তুলনায়। পরিবেশগত সংকটের কারণে পেশাগত নিরাপত্তা নেই। আশেপাশের জেলা সদর; বিশেষ করে সাতক্ষীরা, খুলনা, বরিশাল, যশোরে প্রান্তিক এলাকার মানুষের ভিড় বাড়ছে। তারা সেখানে বিভিন্ন কাজে যুক্ত হচ্ছেন।’

সুতারখালী ইউপি চেয়ারম্যান মাসুম আলী ফকির বলেন, ‘দুর্যোগ আমাদের ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় সমস্যা। গুনারী, কালাবগি, নলিয়ান গ্রামের বেড়িবাঁধের উপরে প্রায় ২০০০ পরিবার ভাসমান অবস্থায় বাস করছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সরকার এই ইউনিয়নের চারদিকে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেছে। তবে সেই বেড়িবাঁধও এখন ঝুঁকির মুখে।’

তিনি আরো বলেন, ‘কালাবগিতে প্রায় ৪৫০ পরিবার বেড়িবাঁধের বাইরে বসবাস করছে। তারা নদী এবং পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছে। তাদের সুরক্ষার জন্য বেড়িবাঁধের ভেতরে আনার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু জায়গার অভাবে তাদের ভেতরে আনা যাচ্ছে না। খাসজমিতে তাদের পুনর্বাসন করা জরুরি। তারা সরকারের নাগরিক সেবাও পাচ্ছে না।’ 
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়